ছল চাতুরি, জবরদস্তি, হুমকি ধামকি, খুন খারাবির মাধ্যমে দুনিয়াময় খ্রিস্টধর্ম আর ইসলাম ছড়িয়েছে। ও না হলে ও দুটো ধর্মের কোনওটিই মধ্যপ্রাচ্যের গ-ি ছেড়ে বেরোতে পারতো না। ধর্মান্তরণটা ইহুদি আর হিন্দু ধর্মে ওভাবে চলে না জানতাম। কিন্তু এখন দেখছি আগের সেই বাছবিচার উবে গেছে। কেউ চাইলে ইহুদি হতে পারছে। কেউ চাইলে হিন্দু। হরেকৃষ্ণ গোষ্ঠীর বিদেশিরা কপালে তিলক পরে আর সংস্কৃত শ্লোক আওড়ে হিন্দু সাজে জানি। কিন্তু ধর্মান্তরণ মনে হচ্ছে শুধু কৃষ্ণভক্তদের মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই। বেশ কিছুদিন হলো, ভারতবর্ষে রীতিমত গণ-ধর্মান্তরণ চলছে, মুসলিমরা দলে দলে হিন্দু হয়ে যাচ্ছে। মুসলিমরা কি হিন্দু ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে হিন্দুত্ব বরণ করছে? যদি হিন্দু ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে করে, তবে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু জোর খাটালে আপত্তি করবো। আমি কোনওকালেই কাউকে জোর খাটিয়ে কিছু, যে কোনও কিছুই, করানোর বিরোধী। শুনেছি হিন্দু মৌলবাদীরা ধর্ম পরিবর্তন করার জন্য মুসলিমদের ওপর জোর খাটাচ্ছে। হিন্দু মৌলবাদীদের ভয়ে নাকি অনেক মুসলিম ধর্ম পরিবর্তন করছে। ধর্মের চেয়ে জীবন বড়। সুতরাং জীবন বাঁচাতে যে কোনও মানুষই চেষ্টা করবে। টাকা পয়সাও নাকি দেওয়া হচ্ছে, তার মানে ধর্মান্তকরণের জন্য লোভও দেখানো হচ্ছে। এই ধর্মান্তরণ খাতে হিন্দু মৌলবাদীরা দু’হাতে টাকা ঢেলেছে। মোটাসোটা একটা ফা-ও বানিয়ে ফেলা হয়েছে। এ একেবারই খ্রিস্টান মিশনারীয়, আর সুফিদের খানকাশরিফীয় পদ্ধতি। হিন্দুরা এই ধর্মান্তকরণের নাম দিয়েছে ‘ঘরওয়াপসি’। এর অর্থ প্রত্যাবর্তন, বুঝিয়ে বললে, তোমরা তো বাধ্য হয়ে হিন্দু থেকে মুসলিম হয়েছিলে, এখন আবার ভালোয় ভালোয় স্বধর্মে ফেরো, অথাৎ ঘরে ফেরো। ঘরওয়াপসির কথা যখন হচ্ছে, তখন এক হিন্দু মৌলবাদীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কতদিন পর এই ঘরে ফেরার ঘটনাটা ঘটছে। চুপ করে রইলো। আমি নিজেই তারপর বললাম, আটশ’ বছর, তাই না?
ভারতবর্ষের অধিকাংশ মুসলিমই ধর্মান্তরিত। ছোটজাত নিচুজাত দুঃস্থ দরিদ্র হিন্দুরা মগজধোলাইএর কারণে হোক, টাকা পয়সার লোভে হোক, সুফিদের আচরণে মুগ্ধ হয়ে হোক, ব্রাহ্মণদের ঘৃণা পেয়ে হোক, মুসলিমের মার খেয়ে হোক, মুসলিম হয়েছে। এখনও হচ্ছে। হিন্দু-মুসলিমে বিয়ে হওয়া মানে হিন্দুকে মুসলিম হতে হবে। এর উল্টোটা, মুসলিমের হিন্দু হওয়া, ঘটে না বললেই চলে। শত শত বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। আজ হিন্দু মৌলবাদীরা যখন প্রতিশোধ নিতে চাইছে, বা উল্টো ঘটনাটি ঘটাতে চাইছে, দিল্লির মসনদ অবধি কেঁপে উঠছে! হিন্দুদের মুসলিম বানানো বা খ্রিস্টান বানানো যাবে, কিন্তু কাউকে হিন্দু বানানো যাবে না! এই বৈষম্য মেনে নেওয়া উচিত নয়। হিন্দুরা মহাউৎসাহে মুসলিমদের ধর্মান্তরিত করছে, কিন্তু পঁচিশ কোটি মুসলমানকে কি ধর্মান্তকরিত করা সম্ভব? পচিঁশ জনকে করতে গিয়েই তো গোল বাঁধছে। চারদিকে নিন্দার ছিছি!
ধর্ম পরিবর্তনের অধিকার সবারই থাকা উচিত। চুলের স্টাইল, পোশাক আশাকের ফ্যাশন, গাড়ি বাড়ি, রাজনৈতিক দল, নীতি-আদর্শ, স্বামী স্ত্রী সবই পরিবর্তন করা যায়, তবে ধর্ম পরিবর্তন না করার কী কারণ থাকতে পারে! ধর্ম কী এমন জগদ্দল পাথর যে জীবন থেকে একে সরানো যাবে না! মানুষ যত খুশি ধর্ম পরিবর্তন করুক, যখন খুশি করুক, যে ধর্ম খুশি সে ধর্মই গ্রহণ করুক। হিন্দু থেকে মুসলিম হোক, মুসলিম থেকে হিন্দু হোক, খ্রিস্টান থেকে ইহুদি, ইহুদি থেকে মরমন, মরমন থেকে জিওভাস উইটনেস, জিওভাস উইটনেশ থেকে বৌদ্ধ, বৌদ্ধ থেকে জোরোআস্ট্রিয়ান, জোরোআস্ট্রিয়ান থেকে বাহাই, বাহাই থেকে পেগান হোক,যা ইচ্ছে তাই হোক। ধর্ম পরিবর্তন মানবাধিকারের অংশ। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মানুষ ধর্ম পরিবর্তন করুক। অথবা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মানুষ নাস্তিক হয়ে যাক। ধর্মের শৃংখল থেকে মুক্ত হোক। আমি তো ধর্মের শৃংখল থেকে সেই শৈশব থেকেই মুক্ত। কোনও শিশুকেই আসলে কোনও ধর্ম দ্বারা চিহ্নিত করা উচিত নয়। কোনও শিশুই কোনও ধর্মবিশ্বাস নিয়ে জন্ম নেয় না। শিশুর ওপর বাবা-মা’র ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া হয়। সব শিশুই বাধ্য হয় বাবা-মা যে ধর্মে বিশ্বাস করে, সেই ধর্মকে নিজের ধর্ম বলে মেনে নিতে। সবচেয়ে ভালো হয়, শিশু বড় হওয়ার পর বা বুদ্ধি হওয়ার পর যদি তাকে পৃথিবীর সব ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া হয়, শুধু ধর্ম নয়, নাস্তিকতা বা মানবতন্ত্র সম্পর্কেও জ্ঞান দেওয়া হয়, তারপর সে নিজের বিশ্বাসের জন্য যে কোনও একটি ধর্ম বেছে নেবে, অথবা নাস্তিকতা পছন্দ হলে সেটি গ্রহণ করবে। রাজনৈতিক বিশ্বাসকে গ্রহণ করার বেলায় তো প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হয়, তবে ধর্মীয় বিশ্বাস গ্রহণ করার বেলায় প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার প্রয়োজন নেই কেন!
ধর্মীয় বিশ্বাসের বেলায় অন্ধত্বের প্রয়োজন! অনভিজ্ঞ শিশুরা তাই ধর্ম বিশ্বাসের জন্য চমৎকার। চোখ খুলে যাওয়া লোক ধর্মের রূপকথাকে সহজে মেনে নেয় না। যদি ধর্ম দিয়ে শিশুদের মগজধোলাই আজ থেকে বন্ধ হয়, তবে ধর্ম জিনিসটা বিলুপ্ত হতে খুব বেশি দশকের দরকার হবে না।
যখন ধর্মের অস্তিত্ব আদৌ থাকে কি না থাকে এই নিয়ে ভাবছি, তখন হিন্দু মৌলবাদীরা মুসলিমদের অনুকরণ করতে ব্যস্ত। দায়িত্ব নিয়েই বলছি, হিন্দু মৌলবাদীরা মুসলিম মৌলবাদীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলছে। মুসলিমরা ভায়োলেন্স করে, সুতরাং হিন্দুরাও করবে। মুসলিমরা বিধর্মীদের ধর্মান্তরিত করে, সুতরাং হিন্দুদেরও তা করতে হবে। মৌলবাদীতে মৌলবাদীতে আসলে খুব একটা পার্থক্য নেই। সব মৌলবাদীর একটিই ধর্ম, একটিই মন্ত্র : মানুষকে বিভ্রান্ত করো, সমাজকে স্থবির করো।
শুনছি ধর্মান্তরণ বিরোধী একটি আইন নাকি জারি হবে। এ আবার বাড়াবাড়ি। জীবনের অন্য যে কোনও বিশ্বাসই পরিবর্তন করার অধিকার মানুষের থাকবে, শুধু ধর্ম পরিবর্তন করার অধিকার থাকবে না। এর কোনও মানে হয়? কোনও একটা নির্দিষ্ট ধর্মের খাঁচায় মানুষকে বন্দি করে রাখা রীতিমত অন্যায়। সংবিধানে যদি গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের কথা লেখা থাকে, তবে ধর্মান্তরণ বিরোধী আইনটি আইনত জারি করা যায় না। আমি বুঝি না এত ভয় কেন ধর্মের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নিয়ে? ধর্মকে কি কোনও শক্তি দিয়ে আঁকড়ে রাখা যায়! কখনও রাখা গেছে? সুমেরীয়, মেসোপটেমীয়, মিশরীয়, গ্রীক, রোমান, ভাইকিং ইত্যাদি কত দাপুটে ধর্ম মরে ছাই হয়ে গেছে। আজকের হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, ইহুদি ধর্ম, খ্রিস্ট ধর্ম,ইসলামও একদিন মরবে। প্রকৃতির কাছে প্রার্থণা করি, তখন মিথ্যে, অবিজ্ঞান আর কুসংস্কারনির্ভর নতুন কোনও ধর্ম যেন এই পৃথিবীকে আর না জ্বালাতে আসে।
মানবতন্ত্র বেঁচে থাকুক। কোনও ধর্ম মানব সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখবে না। মানুষের প্রতি মানুষের মমতাই মানবসভ্যতাকে বাঁচাবে। মানুষের মুক্তচিন্তা, কুসংস্কারমুক্তি, বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবুদ্ধিই মানুষকে বাঁচাবে।