মানুষ যত সভ্য হয়, মেয়েদের বিরুদ্ধে বর্বরতা তত কমিয়ে ফেলে। যে দেশে মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার, সে দেশে মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়ানোটা সে দেশের সভ্য হবার লক্ষণ। বাংলাদেশেও তাই করা হয়েছিল, কিন্তু এখন আবার কমানো হচ্ছে সেই বয়স। আঠারো থেকে ষোলোতে নামানো হচ্ছে। কচি কুমারী মেয়েকে যেন আইনের কোনো ঝামেলা ছাড়াই পুরুষেরা ভোগ করতে পারে, বা ধর্ষণ করতে পারে তার ব্যবস্থা হচ্ছে। সভ্য আইনে, এবং মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্সেও আঠারো বছরের কম বয়সী মেয়েদের অনুমতি নিয়ে সেক্স করলে সেটা সেক্স নয়, সেটা ধর্ষণ। বাংলাদেশ নামের দেশটা যখন জন্মেছিল, সভ্য ছিল, দিন দিন দেশটা অসভ্য হচ্ছে।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ যেসব দেশে ঘটছে, যেসব অনুন্নত বর্বর দেশগুলোতে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে প্রতি তিনটে বিয়ের একটি বিয়েই বাল্যবিবাহ। শতকরা ৬৮ ভাগ মেয়ের বাল্যবিবাহ হচ্ছে। বাংলাদেশের চেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ ঘটে মাত্র তিনটে দেশে। আফ্রিকার নাইজের [৭৫%], চাদ [৭২%], আর মালি [৭১%]তে। জাতিসংঘ বলছে, আঠারো বছরের কম বয়সী ছেলেমেয়েরা প্রাপ্তবয়স্ক নয়, তারা শিশু। পৃথিবীর সভ্য আইনগুলোর মতো বাংলাদেশের আইনও সম্ভবত আঠারো বছরের কম বয়সী ছেলেমেয়েদের প্রাপ্তবয়স্ক বলে গণ্য করে না। তাহলে জেনেবুঝে বাংলাদেশ কেন শিশুদের বিয়ে বৈধ করছে!
এ কথা কে না জানে যে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে হলে সামাজিক বা অর্থনৈতিক কোনও উপকার তো হয়ই না, বরং অপকার হয়! অল্প-বয়সী মেয়েরা স্বামীর অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয় অতি সহজেই। অশিক্ষিত থেকে যায় জীবনভর, কারণ বিয়ের পর ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিতে তারা বাধ্য হয়। যৌনরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকাটাও বেশি। গর্ভবতী হওয়ার জন্য শরীর এবং মন প্রস্তুত হওয়ার আগেই তাদের গর্ভবতী হতে হয়। অল্প বয়সে গর্ভবতী হওয়া এবং সন্তান প্রসবের কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার মেয়ের মৃত্যু ঘটে। সত্যি কথা বলতে কী, কোনও মেয়ের বাল্যবিবাহ হওয়া মানে তার মৃত্যুদণ্ড হওয়া। আমার বিশ্বাস হয় না বাংলাদেশ সরকার এসব তথ্য জানে না। প্রসবসংক্রান্ত জটিলতায় প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের চেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের, সরকার জানে না? অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের সন্তানের মৃত্যুও ঘটে প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের সন্তানের চেয়ে অনেক বেশি, সরকার জানে না? সমাজটাকে হাজার বছর পেছনে ঠেলে দেওয়ার জন্য সরকার কি কোনওরকম অনুদান পেয়েছে কোথাও থেকে?
বাংলাদেশে ছেলেদের বিয়ের বয়সও কমানো হচ্ছে, একুশ থেকে আঠারো করা হচ্ছে। কিন্তু আঠারো বছর বয়সে খুব কম ছেলেই বিয়ে করে। এই আইনের ভুক্তভোগী হবে মেয়েরাই। ষোলো বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ে করতে বাধ্য করা হবে। দরিদ্র বাবা মা’র ওপর যথারীতি চাপ আসবে। শিশুধর্ষকদের হাত থেকে মেয়েদের রেহাই নেই। শিশু পাচারকারীর হাত থেকেই রেহাই নেই। এই আইনের মাধ্যমে সরকার আসলে ধর্ষণকে বৈধ করবার ব্যবস্থা করছে।
ধনী এবং শিক্ষিত পরিবারের মেয়েরা কিন্তু ষোলো বছর বয়সে বিয়ে করবে না। তারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, স্বনির্ভর হবে, সমাজে মাথা উঁচু করে চলবে। অন্তত সেই সুযোগটা তাদের আছে। কিন্তু দরিদ্রদের এই সুযোগটা দিচ্ছে না বাংলাদেশ সরকার। দরিদ্র মেয়েরা এমনিতে নানা নির্যাতনের শিকার, প্রায় সমস্ত অধিকার থেকেই বঞ্চিত, তাদের নির্যাতনকে এখন আইনি বৈধতা দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। যে বয়সটায় একটা মেয়ে খুব অসহায়, সেই বয়সটায় তার বিয়েটা বৈধ করা হচ্ছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে স্ত্রী মানেই সংসারের দাসী, স্ত্রী মানেই রান্না করো, কাপড় কাঁচো, বাড়িঘর সাফ করো, স্বামী সেবা করো, শ্বশুর শাশুড়ি দেবর ভাসুরের ফুটফরমাশ খাটো, সন্তান জন্ম দাও, লালন পালন করো। এর একটু এদিক ওদিক হলেই শারীরিক নির্যাতন, অথবা তালাক। মেয়েদের জন্য বিয়ে মানেই নিজের জীবনের সর্বনাশ ডেকে আনা। শুধু দুটো ভাত কাপড়ের কাছে নিজের জীবন বিক্রি করে দেওয়া। যেখান থেকে মুক্তি নেই কোনও মেয়ের। অনেকটা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মতো। বিনা অপরাধে যাবজ্জীবন। অথবা, অপরাধ একটিই, মেয়ে হিসেবে জন্ম নেওয়ার অপরাধ। পতিতালয় থেকে অসহায় মেয়েরা যেমন বেরোতে পারে না, নারী-পুরুষের বৈষম্যের সংসার থেকেও তেমনি বেরোতে পারে না। সে কারণে একটি মেয়ের শিক্ষিত আর স্বনির্ভর হওয়াটা খুব জরুরি। শিক্ষিত এবং স্বনির্ভর মেয়েরা অশিক্ষিত এবং পরনির্ভর মেয়েদের চেয়ে সামাজিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে, মানসিকভাবে, শারীরিকভাবে অনেক বেশি ভালো অবস্থায় আছে, তা কি অস্বীকার করবে বাংলাদেশ সরকার? একটা মেয়ের অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় বিয়ে হওয়া মানে, তার স্বাস্থ্য, তার শিক্ষা, তার সম্ভাবনা সব নষ্ট করে দেওয়া। জেনেশুনে বাংলাদেশ সরকার কার বা কাদের স্বার্থে এই আইনটি তৈরি করতে চাইছে?
বাংলাদেশে আঠারো বছর বয়স ছিল মেয়েদের জন্য বিয়ের নূ্যনতম বয়স। তারপরও আইনটিকে না মেনে অসাধু লোকেরা নিজেদের ১৫/১৬ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল। এই সমস্যার সমাধান কিন্তু বিয়ের বয়স আঠারো থেকে ষোলো বছরে কমিয়ে এনে হয় না। এর সমাধান হয় ওই অসাধু লোকদের সাধু বানানোয়। এর সমাধান হয় মেয়েদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যাপারে দেশব্যাপী মানুষকে সচেতন করিয়ে। যখন মানুষকে সচেতন করার কাজটি পরিশ্রমের বলে মনে হয়, তখনই সরকার দুষ্ট লোকদের তুষ্ট করতে মন্দ কাজটি করে।
একটা সমাজ কতটা সভ্য, তা নির্ভর করে ওই সমাজে মেয়েদের অবস্থাটা কেমন, তার ওপর। বাংলাদেশে একগাদা আইন রাখা আছে মেয়েদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের সমাজ নারী-বিদ্বেষী সমাজ, এই সমাজ মেয়েদের যৌন বস্তু, পুরুষের দাসী আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ছাড়া আর কিছু মনে করে না। এই নারী-বিদ্বেষী মানসিকতা যখন পরিবর্তনের প্রয়োজন, যখন নারী পুরুষের সকল বৈষম্য দূর করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া উচিত, তখনই সরকার কি না হায়েনার মুখে হরিণ ছুড়ে দেওয়ার মতো শিশুধর্ষকদের বিকৃত যৌনলালসা মেটাতে শিশুদের বিয়ে বৈধ করছে।
ঋতুস্রাব শুরু হয়ে গেলে বা গায়ে গতরে বাড়লেই যে মেয়েরা বিয়ের জন্য মানসিকভাবে, এবং শারীরিকভাবে প্রস্তুত হয়ে গেলো, তা নয়। ঠিক যেমন ছেলেদের দাড়িগোঁফ গজালেই বিয়ে করার যোগ্য হয়ে ওঠে না। বিয়ে শুধুই দৈহিক সম্পর্ক নয়, বিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। বিয়ে খুব বড় দায়িত্ব পালন, বিশেষ করে সন্তানের।
শৈশব যাপনের অধিকার প্রত্যেক শিশুরই আছে। মেয়েদের শৈশব আর কৈশোরকে ছিনিয়ে নিয়ে হুটহাট যৌবন দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অচিরে মেয়েরা বার্ধক্যকে বরণ করে নিতে বাধ্য হচ্ছে। মেয়েদের জীবনকে এভাবে নষ্ট করে দেওয়ার কোনও অধিকার কোনও সরকারের নেই। আমি আমার মা’র কথা জানি। আমার মা অসম্ভব ভালো ছাত্রী ছিলেন ইস্কুলে। পরীক্ষায় সবসময় প্রথম হতেন। মা’র যখন দশ বছর বয়স, তখনই মা’কে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। মা খুব চাইতেন লেখাপড়া করতে। বিয়ের পর ইস্কুলে গিয়েছেন বটে, কিন্তু বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর আর সম্ভব হয়নি। বাচ্চা খানিকটা বড় হলে তিনি আবার ইস্কুলে যাওয়া শুরু করলেন, তখন তাঁর আত্মীয় স্বজন সবাই বাধা দিল। মা’র অল্প বয়স ছিল, মা পরনির্ভর ছিলেন, মা’র পক্ষে সম্ভব ছিল না নিজের সিদ্ধান্তের মূল্য দেওয়া। লেখাপড়া করার আর স্বনির্ভর হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্য মা’কে দুঃখ পেতে দেখেছি সারাজীবন।
অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থার একটি বিয়েই মা’র জীবনের সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু ঘটিয়েছিল। মা’র সমস্ত সম্ভাবনার সর্বনাশ করেছিল। মা’কে পরনির্ভর হওয়ার যন্ত্রণা সারাজীবন বইতে হয়েছে। সংসারে সুখ ছিল না মা’র। কিন্তু মা’র কোনও উপায়ও ছিল না সুখী হওয়ার। সারাজীবন নিজের ওপর নানান অবহেলা, অত্যাচার, অনাচার, অবিচারকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। নিজের সম্ভ্রম আর সম্মান নিয়ে তাঁর বাঁচার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল সেদিনই, যেদিন দশ বছর বয়সে তাঁর বিয়েটা হয়েছিল।
আমার মা’র মতো আর কোনও মেয়েকে যেন ভুগতে না হয়। বাল্যবিবাহ মেয়েদের জন্য চরম অভিশাপ। শেখ হাসিনা নিজে নারী হয়ে বাংলাদেশের অসহায় নিরীহ নারীদের এত বড় সর্বনাশ যেন না করেন। তিনি নিজে যেমন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন, দেশের মেয়েরাও যেন সেই সুযোগ পায়, তিনি যেন মেয়েদের সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত না করেন।