গল্পের ঘন নীল পথের ওপর সবুজ সোনালি রঙে একটা বাঁশি এসে পড়ে। আহা, বাঁশি। সেই বাঁশি, বুকে যার সাতটি ছিদ্র। এই ছিদ্র গরম লোহার শিকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে তৈরি।
পোড়া ছিদ্রের ভেতর থেকে আগুনের দগ্ধতাকে ফুলের বাগান করে স্বর্গ থেকে সুর টেনে আনে। কৃষ্ণ বাজায়, রাধা ঘর ছেড়ে যমুনার তীরে বাহিরায়। আমাদের পল্লি গায়ক টুংসু মামুদের কণ্ঠে গান ফোটে—ভাওয়াইয়া অভ্যাসের বিপরীতে—ও লো সই, আমি কার কাছে যাই
আমি কার কাছে বা যাই।
বাঁশির শব্দে প্রাণ করে আইঢাই। কিন্তু আমাদের গল্পপটে সে বাঁশির ছবি এখন নয়। আমরা কানে শুনতে পাই জলেশ্বরীর দিকে আসা ট্রেনের বাঁশি।
রাজারহাট, নবগ্রাম আর জলেশ্বরীতে পাট আর সুপারির চালান অধিক হয়ে গেলে রাতদুপুরে, জলেশ্বরীতে মালগাড়ি আসে। গভীর রাতে স্তব্ধতার ভেতরে আকাশের নক্ষত্র পোড়া অগ্নির নিচে মালগাড়ি এসে রাজারহাটে থামে। ফিরবার পথে এখান থেকে মালের চালান তুলবে। নবগ্রামেও তুলবে না। একেবারে জলেশ্বরী এসে থামবে। তারপর মারোয়াড়িদের পাটের গাঁইট আর ব্যাপারির বস্তা ঘুমজাগা চোখে কুলিরা মালগাড়িতে তুলতে থাকবে, বাঁশি দিয়ে গাড়ি ছেড়ে যাবে।
অসময়ের গাড়ি, মধ্যরাতের গাড়ি নবগ্রাম থেকেই তার বাঁশির আওয়াজ পাওয়া যায়—আ, আ, আ বলে সে ডাকতে থাকে—আমি আসছি। আমি আসছি।
বাঁশির তো এই কাজ। আসবার খবর দেওয়া। শ্যামের বাঁশি তার ভেতরেও খবর দিয়ে আধকোষার পাড়ে—না, না, যমুনার পারে তমাল তলে ডেকে এনেছিল। বাঁশি দিতে দিতে গাড়ি ফিরে যায়। ক্রমে তার বাঁশির শব্দ অন্ধকারের নক্ষত্রের ছোট্ট একটি বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যায়।
খুব ছোটবেলা থেকেই এই বাঁশির সঙ্গে আমরা পরিচিত। দিন দশটায় ব্রিটিশ আমলের কাঁটায় কাঁটায় গাড়ি আসে। এগারোটায় ফিরে যায় গাড়ি। আমরা মাগরিবের নামাজের পর সন্ধ্যাকালে ডিসট্যান্ট সিগন্যালের কাছে জলেশ্বরীর দিকে আসা ট্রেনের বাঁশি শুনি। তখন আমাদের পড়তে বসার সময় হয় নাই। আমরা কেউ কেউ দুঃসাহসী বালকেরা মা-বাবার চোখ এড়িয়ে ইস্টিশনে ছুটে যাই গাড়ি দেখতে, মানুষ দেখতে। মানুষের ওঠানামা দেখতে।
সেই বালক বয়সে যাত্রীদের এই আসা-যাওয়া নিয়ে আমাদের মনে একটা ভাবের উদয় হয়। সেই ভাবের সঙ্গে ইস্টিশনে দাঁড়িয়ে থাকা এক্ষুনি ছেড়ে যাবে গাড়িটির বাঁশি বেজে ওঠে। সাত ছিদ্রের বাঁশি তো নয়। ইঞ্জিনের খোলের ভেতরে তামার নলের ভেতরে জমে থাকা বাষ্প—ড্রাইভারের হাতে সুতো ঝুলছে, সেই সুতো ধরে টান দিলেই নানা সুরে বেজে ওঠে ইঞ্জিনের বাঁশি। সবার হাতে ইঞ্জিনের এই কলের বাঁশির সুর ফোটে না। সুতোয় টান দিলে মনে হয় তাদের হাতে পাগলা ঘোড়া হি হি করে ডেকে ওঠে, সামনে বড় চাকার নিচে সাদা বাষ্পের মেঘ তুলে নবগ্রামের দিকে রওনা হয়ে যায়।
আর ওই যে ভাবের কথা আমরা বলেছি, আমরা জানি না এর কী অর্থ। আমরা দুই চোখ ভরে যাত্রীদের দেখি, তারই জন্য ট্রেনের বাঁশি শুনে জলেশ্বরীর ছোট্ট ইস্টিশনের প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াই। আমরা এ তল্লাটে বালক বলে টিকিট মাস্টার আমাদের চ্যালেঞ্জ করে না। যাত্রী বেরোবার গেট দিয়ে আমাদের বের করে দেয় পিঠে থাবড়া মেরে। হাসতে হাসতে বলে, দুই বেলা ইস্টিশানে আসিয়াও টেরেন দেখিবার হাউস না মিটিল?
আমাদের ভেতরে দুষ্টু মোফাজ্জল বলে, হাউস কি আপনার মিটিছে?
তুই তো বড় নঙ্গর হইছিস রে?
মোফাজ্জল দৌড়ে বেরিয়ে যায় টিকিট মাস্টারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে।
ইঞ্জিনের বাঁশি বেজে ওঠে। গাড়ি ছেড়ে চলে যায়।
এর চেয়ে কত হাসকাব্য হয়। একবার নবগ্রাম থেকে এক পোয়াতি বউকে জলেশ্বরী হাসপাতালে আনা হচ্ছিল রাতের গাড়িতে। ব্যথা উঠেছে আর জলেশ্বরী ঘনিয়ে আসছে। ইঞ্জিনটাও বুঝি টের পেয়েছে তার গাড়িতে পোয়াতি বউ। তীব্র স্বরে ড্রাইভার বাঁশি বাজাচ্ছে। ইস্টিশন মাস্টার অবাক হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে—প্ল্যাটফর্মের কাছে এত ঘন ঘন বাঁশি? তবে কি কেউ কাটা পড়েছে নাকি? আত্মহত্যা করল কেউ? কিন্তু বাঁশি থেমে যায়। ড্রাইভার লাফ দিয়ে নামে। ওদিকে গার্ড সাহেব তার সাদা গাড়ি থেকেও লাফ দিয়ে নামে। আমরা দেখি স্বপ্নে কি বাস্তবে, এই বয়সে এখন আর মনে নেই, দুজনের হাতে দুটি বাচ্চা। যমজ বাচ্চা। ইঞ্জিনের বাঁশির শব্দে ভীত নারীটির গর্ভ থেকে সন্তান দুটো বেরিয়ে এসেছে। তাদের নাম রাখা হয় খুব গোপনে, খুব কানে কানে—যেন কেউ শুনতে না পায়, ছেলেটির নাম জয়, মেয়েটির নাম বাংলা। উনিশ শ একাত্তর সাল।
এটা তো হাসকাব্য নয়। তবু যে বালকবেলায় আমাদের মনে হয়েছিল, তার কারণ বুঝি, জগতের আমরা তখন বুঝি কিছুই জানি না। সবখানে উজ্জ্বল অকারণ হাসির একটা লাফিয়ে ওঠা চোখেই দেখতে পাই। আমাদের ভেতরে বড় পণ্ডিতের পণ্ডিত নফলচন্দ্র দাস, সে বলে, আরও শুনিয়া রাখ, টকি সিনেমা যে দেখিতে যাস ছবির আওয়াজ তো শুনিস, কথা কয়, কাঁই কথা কয়? সিনেমার সাদা পর্দার পেছনে পিতলের থরে থরে গেলাস আর সেই গেলাসের ভেতর হতে আওয়াজ ফুটি ওঠে।
আমাদের বিশ্বাস হয় বা হয় না। আবার মনে পড়ে ইস্টিশন রোডে মিষ্টির দোকানের মালিক হানিফ ভাই বলেন, বাঁশি এমন চিজ। স্তব্ধ মারি পড়ি থাকার নয়। নিশীত রাইতে একা বাঁশি বাজি ওঠে। আগুন পোড়া বাঁশি সাত ছিদ্র হতে বুড়িয়া আঙুলের ডগার মতো সাত পরি বিরায় আর বিলাপ করে আর বাঁশি বাজায়।
আমাদের মন বিষণ্ণ হয়ে যায়। আমাদের ভেতরে অতি বড় হাসিঅলা বালকটিও গম্ভীর হয়ে যায়।
হানিফ ভাই রাতের শেষে গাড়িটির ছেড়ে যাবার বাঁশি শুনে হাতঘড়িতে টাইম মেলায়, রাইতের এখন এগারোটা। ব্রিটিশ আমল বলিয়া কথা, টাইম ধরিয়া গাড়ি আসে, গাড়ি যায়। সেই দূর নবগ্রাম হতে তার বাঁশির আওয়াজ পাওয়া যায়।
একদিন বাঁশির আওয়াজ আর আসে না। ইঞ্জিনের বাঁশি আর বাজে না। কিন্তু গাড়ি আসবার ঘড়ঘড় খড়খড় শব্দ পাওয়া যেতে থাকে। এত সংকেতময় সেই শব্দ যেন সে স্তব্ধ হয়ে এগোতে পারলেই আরাম পেত। আমরা কান পেতে থাকি। ট্রেনের বাঁশি কি বিকল হয়ে গেছে? নাকি এটা ভূতের গাড়ি? রাতদুপুরে আপন মনে জংশন থেকে জলেশ্বরীর দিকে আসছে?
জলেশ্বরীতে ট্রেন লাইন বসবার হুকুম যখন হয়, তখন পয়সার বরাদ্দে টান পড়ে। অতএব রেল লাইনের জন্য পুরাতন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের আঁকাবাঁকা নরম রাস্তার ওপরে লাইন পাতা হয়। তাই রাজারহাট থেকে জলেশ্বরী পর্যন্ত গাড়ি সাত-আট মাইলের বেশি বেগে চলতে পারে না।
আমরা আতঙ্কে বিছানায় বসে থাকি। ঘরে ঘরে মানুষেরা জেগে ওঠে। তারাও জেগে বসে থাকে। যুবকেরা লাথি দিয়ে পথে নামে। তারা কী করে যেন টের পায় রংপুর থেকে মিলিটারির গাড়ি নিঃশব্দে জলেশ্বরীর দিকে আসছে শত শত খুনি পাঞ্জাবি সৈন্য নিয়ে।
গাড়ির গতি ধীর এগিয়ে আসছে। থামা নেই। এগিয়ে আসছেই। রাতের শেষ অন্ধকারেও ট্রেনের জানালা দিয়ে তাদের উঁচিয়ে ধরা রাইফেলগুলোর নল চোখে পড়ছে। যুবকেরা চৌরাস্তায় বেরিয়ে এসে পুরোনো দিনের কলের গানের চোঙ খুলে চিৎকার করে ডাকছে, মা-বোনেরা, মাও জননীরা ঘর হতে বির হয়া আসেন, পাঞ্জাবিরা আসিচ্ছে। কাউকে না ছাড়ান দিবে। যার যা আছে ঘরে থুইয়া বির হয়া আসেন।
তারপর জলেশ্বরীর নারীরা-যুবতীরা দীর্ঘ সারি বেঁধে আধকোষা নদীর ওপারে ভোগডাঙায় চলে যায়। ওদিকে ভোর হয়ে আসে। ভোরের আলো পাপী পুণ্যবান সাধু বা শয়তান বিচার করে না। সবার ওপরে আলো পড়ে। জলেশ্বরীর প্ল্যাটফর্মে খুনি ট্রেন এসে থামে। জানালায়-জানালায় রাইফেলের ফলায় সূর্যের আলো পড়ে ঝিকমিক করে ওঠে। যেন আলো নয়, রক্তেই ওদের পিপাসা। ঠিক তখন একাত্তরে শেষবারের মতো জলেশ্বরীর দিকে আসা ট্রেনটিতে বাঁশি বেজে ওঠে। তীব্র তীক্ষ্ম সেই স্বর। সংগীতের স্বর নয়, যেন একটি চিৎকার, আদমি নেহি, মিট্টি চাহিয়ে, মিট্টি চাহিয়ে, আদমি নেহি। সব মুক্তিকো তালাশ করো, তালাশ করো। তারা সারা শহরে ছড়িয়ে যায়। তারপর থেকে জলেশ্বরীতে আসা-যাওয়া আর কোনো ট্রেনেরই বাঁশি বাজে না। নীরবে, নিস্তব্ধে জলেশ্বরী লাশ হয়ে যেতে থাকে। গানের গলা ছিল আমাদের খোকা ভাইয়ের। সে গাইত, শোনো একটি মুজিবরের কণ্ঠ থেকে—তার গলা চেরা লাশ জলেশ্বরীর রাস্তায় পড়ে থাকে, কিন্তু তার গান আকাশে-বাতাসে মানুষের মধ্যে ভাসে।
চাঁদবিবির পুকুরে চাঁদবিবির লাশ পড়ে থাকে উপুড় হয়ে। হাইস্কুলের কমনরুমে মুমূর্ষু বাঙালিদের হাতের রক্তাক্ত ছাপ। কেউ একজন খুব বড় করে বর্গীয়-জ লিখেছিল, তারপর আর লিখতে পারে নাই। সম্ভবত তার রক্ত ফুরিয়ে গিয়েছিল। তারপর পাশেই কে একজন শক্ত হাতে খুব বড় করে অন্তস্ত-অ লেখে, দেয়ালে ফুটে ওঠে বিশাল অক্ষরে জয়। রক্তের রং লাল, সেই লাল দিনে দিনে শুকিয়ে কালো হয়ে যায়, যেন পৃথিবীর সব রং শোষণ করে যে সাদা তার বিপরীতে এই কালো রং দুষ্ট-নষ্ট রং হয়ে পৃথিবীকে এখনো শাসন করতে চায়।
পারে না। হঠাৎ চারদিক থেকে বাঁশির শব্দ শোনা যায়। ট্রেনের বাঁশি—যেন শত শত গাড়ি এখন জলেশ্বরীর দিকে। এই ট্রেনেরও জানালায়-জানালায় বাংলার যুবকেরা, সাথে তাদের সাইকেল, সাইকেলের ডগায় নতুন সূর্যের আলো। তারা চুপ চুপ করে জলেশ্বরীতে নামে আর চিৎকার করে বলে—জয় বাংলা। তারই সঙ্গে সুর মিলিয়ে ট্রেনের শত শত বাঁশি বেজে ওঠে। পৃথিবী আচ্ছন্ন হয়ে যায়। বাঁশির সেই শব্দে ট্রেনের বাঁশি নয়, যেন উত্তাল একপাল ঘোড়া আকাশের দিকে মুখ তুলে হ্রেষা নয়, বাঁশির শব্দ করছে আর একটি বাঁশি তার বুকে সাত ছিদ্র থেকে বাংলার চোখের অশ্রু আধকোষা নদীর ঢলের মতো সরছে—ঝরে পড়ছে।
lসেপ্টেম্বর ২০১৬–তে গল্পটি হাসপাতালের রোগশয্যায় রচিত। অনুলিখন করেছেন লেখকের স্ত্রী কথাশিল্পী আনোয়ারা সৈয়দ হক