আমি তাকে চিনি না। আগে কখনো দেখিনি। লোকটিকে আমি ভিড়ের ভেতরে ঠিক পছন্দ করতে পারছিলাম না। এ রকম হয়। অনেক মানুষের দেখা পাওয়া যায় পথে। পথ চলতি মানুষ তারা। এই দেখা হলো, আর কখনো দেখা হবে না। তবু ওইটুকুর ভেতরেই পছন্দ অপছন্দ গড়ে ওঠে। কখনো এমন হয়, মানুষটির কথা বহুদিন পর্যন্ত মনে থাকে। কোনো কারণ ছাড়াই।
দৌলতদিয়ার ফেরি জাহাজের জন্যে আরিচা ঘাটে অপেক্ষা করছি গাড়ি নিয়ে। নিজেই চালাই। মনটা ভালো নেই। সাবধানে চালিয়ে এসেছি ঢাকা থেকে। বন্ধুরা মানা করেছিলো। একজন তার ড্রাইভারসহ গাড়ি দিতে চেয়েছিলো। ওহে, এ সময়ে নিজে গাড়ি না চালানোই ভালো। আমার জেদাজেদি দেখে একজন তো সঙ্গে আসতেও চেয়েছিলো। কাউকে আনিনি।
জাহাজ আসতে এখনো অনেক দেরি। গাড়ি সাইড করে নেমে এসেছি। এক পেয়ালা চা খেয়েছি দোকানে দাঁড়িয়ে। এখন ইতস্তত পায়চারি করছি। দূরপাল্লার বাস কয়েকটা এসে থেমে আছে পারের অপেক্ষায়। যাত্রীরা সব নেমে পড়েছে। নেমে হাঁটাহাঁটি করছে। বেশ একটা ভিড়ই হয়ে গেছে। পায়ের নিচে নদী পাড়ের বালি। রোদে তপ্ত।
মানুষজন কেউ নাশতার জন্যে হোটেলে হোটেলে ঢুকে পড়েছে। হোটেলের সমুখে পাতা তাওয়ার ওপরে ছ্যাঁক ছ্যাঁক করে ডিম ভাজা হচ্ছে। ঘন ঘ্রাণ বেরিয়েছে। টিনের থালার ওপরে খবর কাগজের টুকরো পেতে তার ওপরে ডিম পরোটা পাচার হচ্ছে মুহুর্মুহু। কেউবা ইলিশভাজা লালপোড়া লংকা পেঁয়াজে ডলে গোগ্রাসে গিলছে।
দোকানিরা অভয় দিয়ে বলছে, আরে, আস্তে খান সায়েবেরা। টাইম অনেক পাবেন। আরেকখান মাছ দেই? পদ্মার ইলিশ!
ঘাটের সুপারভাইজারের কাছে শোনা গেলো, ফেরি আসতে দেরি হবে। কোথায় নাকি একটা জাহাজ ডুবো চরে ধাক্কা খেয়ে আটকা পড়েছে।
সেই ডিম পরোটা ইলিশভাজা গরম ভাত আর মানুষজনের ভিড়ের মধ্যে লোকটি হঠাৎ আমার চোখে পড়ে যায়। লোকটির চোখ দুটি ফড়িংয়ের মতো চঞ্চল। যে ফুলে মধু সেই ফুলেই ফড়িং গিয়ে বসে। লক্ষ করি লোকটির চোখ বাসযাত্রী মোটরযাত্রী মহিলাদের ওপর ঘনঘন গিয়ে বসছে। স্থির হচ্ছে না কোথাও। এক মহিলা থেকে আরেক মহিলার ওপরে তার চোখ নাচানাচি করছে। হয়তো এর জন্যেই লোকটি আমার চোখে পড়ে।
ছাই রঙা ময়লা সাফারি সুট পরণে। গায়ের রঙ তার চেয়েও ময়লা ছাইরঙা। সায়েব সাজলেও মনে হয় লোকটি আড়তদারটার হবে। টাউট কিসিমের চেহারা। বয়স আন্দাজ করা মুশকিল। তিরিশ থেকে পঁয়তালি্লশ। গালে তিনদিনের না-কামানো দাড়ি উঁকি দিচ্ছে। দাঁত উঁচু। হাতে সিগারেট। ফসফস করে টানছে।
কাউকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখলে দেখা-লোকটার ঘাড়ে কী একটা ঘটে যায়। ঘাড়ের কাছে শিরশির করে। ফিরে তাকায়। লোকটিও আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। আমাকে তার চোখে পড়ে। চোখে চোখ পড়তেই সে চোখ ফিরিয়ে নেয়। আবার ফিরে আমাকে দেখে।
তারপর এক কান্ড ঘটে। এক মহিলা থেকে আরেক মহিলার দিকে তার চোখ ফেরাবার মাঝখানে সে আমাকেও এবার থেকে একবার করে দেখে নিতে থাকে।
এরপর সে আর আমি যেন একটা বাঁধনের মধ্যে পড়ে যাই। অচিরে আমিও দেখি আমারও চোখ তারই মতো এক মহিলা থেকে আরেক মহিলার ওপরে গিয়ে বসছে। আর তারই মতো আমিও মাঝখানে একবার করে লোকটিকেও দেখে নিচ্ছি।
লোকটি এক মহিলা থেকে আরেক মহিলার ওপর চোখ ফেরাচ্ছে। ফিরিয়েই চলেছে। আর আমিও যেন তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছি। আমারও চোখ তারই মতো একবার মহিলাদের দিকে পড়ছে, একবার তার দিকে।
অথচ, ঈশ্বর জানেন, এ রকম মেয়ে দেখার স্বভাব আমার মোটেই নয়। আমি বরং বরাবরই কোনো মেয়ের ওপর চোখ পড়তেই চোখ ফিরিয়ে নিই। যেন জগতের সব দেখা আমার জায়েজ, শুধু মেয়ে দেখা নয়। যেন ওতে একটা ঘোর অসভ্যতা আছে। বিয়ের রাতেও আমি ভালো করে স্ত্রীর দিকে তাকাতে পারিনি। পাঁচ বছর আগের কথা। এই সেদিন পর্যন্ত আমার স্ত্রী এ নিয়ে বড় মর্মান্তিক রকমে ঠাট্টা করে এসেছে আমাকে।
লোকটি ভিড় ঠেলে ভিড় গুঁতিয়ে হাঁটতে থাকে। আমিও হাঁটতে থাকি। সে আমাকে আকর্ষণ করে কি আমি তাকে আকর্ষণ করি, বুঝে উঠি না। আমরা দু’জনে দু’জনকে নজর থেকে আড়ালে আর এখন রাখছি না। লোকটিকে পছন্দ করছি না সত্যি, কিন্তু চোখও ফিরিয়ে নিতে পারছি না।
লোকটি কি বিশেষ কাউকে খুঁজছে? নাকি কেবলি নারী চেহারা দেখার লোভ? আমি ভালো করে ঠাহর করে দেখি লোকটিকে। তার চোখে আমি একই সঙ্গে উৎকণ্ঠা এবং লালসা দেখে উঠি। এর ভেতরে কোনটি প্রধান বুঝে উঠতে পারি না।
লোকটিকে আমি ভিড়ের ভেতরে অনুসরণ করে চলি।
মহিলাদের অধিকাংশই গাড়িতে বা বাসে। তারা নামেনি। তারা জানালায় মুখ ঠেসে বসে আছে। এদের ভেতরে অনেকেই ঘরগেরস্ত করা বৌ মানুষ। কারো কারো সঙ্গে ছানাপোনা। কয়েকজন তরুণী। তাদের কারো কারো চোখে সানগ্লাস। কারো ঠোঁটে ঘন লাল লিপস্টিক। একজন ওই যে নেমে এলো গাড়ি থেকে। আহ্! মেয়েটির পরণে জিন্স ট্রাউজার, ওপরে শাদা শার্ট। কাঁধে ক্যামেরা। হাতে চায়ের ফ্লাস্ক। ট্রাউজারের পেছনটা টানটান হয়ে আছে তানপুরার খোলের মতো।
মেয়েটি পাড়ের একটা পিলারের সঙ্গে পাছা ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। তারপর ক্যামেরা বের করে নদীর বুকে পালতোলা ডিঙি নৌকোর দিকে তাক করলো। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। মেয়েটি নৌকোর ফটো তুললো কি তুললো না, বোঝা গেলো না। চায়ের ফ্লাস্ক বের করে কাপে ঢাললো।
চা কয়েক ফোঁটা বেরিয়েই বন্ধ হয়ে গেলো। তখন সে ফ্লাস্কটার ওপর ভারি রাগ করে ঠোঁট কুঁচকে দাঁড়ালো। ফ্লাস্কটার বরাতে কি আছে কে জানে। ছুঁড়েই ফেলে দেবে হয়তো। দিলো না। কষে মুখ এঁটে ফ্লাস্কটা বাঁ কাঁধে ঝোলালো।
তারপর তাকিয়ে দেখতে লাগলো ভিড়, মানুষ।
তারপর মেয়েটি একটা পান দোকানে হেঁটে গিয়ে কোকের বোতল কিনলো। বোতলটার ছিপি খুললো সে দাঁত দিয়ে কামড়ে। সেই কামড়টা বড় দুঃসাহসী দেখালো। আর সেটা দেখে হাঁ করে দাঁড়িয়ে গেলো ঘাটের দুটি টোকাই।
মেয়েটি এবার আকাশের দিকে মাথা তুলে ঢকঢক করে কোক গিলতে লাগলো। আকাশের দিকে মুখ তোলার সময় হাতও উঠেছিলো তার বোতল সমেত। তখন বুকের শার্ট তার উঁচু হয়ে উঠলো। কোমরের গোলাপি রঙের বেল্ট বেরিয়ে পড়লো। স্তন দুটো ঠেলে উঠলো, যেন প্রতিবাদে, যেন তারাও খাবে কোক। সব কিছু ঝকঝক করতে লাগলো বেলা এগারোটার চোখ ধাঁধানো রোদে। লক্ষ করি, লোকটিও চোখ ফেলে আছে মেয়েটির বুকের দিকে। মেয়েটি গলা নামালো, বোতল নামালো, তৎক্ষনাৎ তার বুকের ওপর ঢিলে শার্ট ঝুলে পড়লো। স্তনের উচ্চতা মিলিয়ে গেলো শার্টের ভেতরে। ঠিক তক্ষুনি একটা জোর বাতাস উঠলো। বাতাস যেন বললো, আরে আমি তো ভালো করে দেখতেই পাইনি। তাই সেই বাতাসের দাপটে মেয়েটির বুকের বল দুটো আবার উঁচু হয়ে দেখা দিলো। বাতাস এবার বড় অসভ্যতা করলো। শার্টে চেপে ধরে বল দুটোকে ফুটিয়ে রাখলো।
আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। লোকটি তখনো তাকিয়ে আছে মেয়েটির বুকের দিকে। তার চোখে উৎকণ্ঠা? নাকি লালসায় চকচক করছে?
আমি মেয়েটিকে আবার ফিরে দেখি। বাতাস এখনো বদমাশ। মেয়েটি কি সর্বনাশা। এতগুলো মানুষের সমুখে বুকের কোনো খবরই নেই তার! নাকি এতই সে সরল যে নিজের শরীরটা নিয়ে কোনো ভাবনাই নেই! একবারও কি তার চোখে পড়ছে না লোকটি তাকে অসভ্য চোখে দেখছে?
কিম্বা আমিও দেখছি! আর আমিও যে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছি না! বারবার চেষ্টা করছি। বারবারই ঘুরে ঘুরে মেয়েটির বুকের ওপর আমার চোখ গিয়ে পড়ছে।
লোকটির চঞ্চল চোখ বুঝি হঠাৎ অন্য কোনো দর্শনীয় খুঁজে পায়। সে দূরে চোখ পাঠায়। আর সেই চোখ ধরেই সে এবার দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। তাঁর হাঁটবার সঙ্গে সঙ্গে আমিও একটা টান অনুভব করি। যেন আমাকেও সে সঙ্গে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে।
চট করে আমি মেয়েটির দিকে একবার ফিরে তাকাই। কিন্তু হতাশ হই। বাতাসটা তখন মরে গিয়েছিলো, ঢিলে শার্টের গভীরে মেয়েটির স্তন হারিয়ে গিয়েছিলো। তারপরই কি হয়? বাতাস আমাকে বঞ্চিত করে না। বাতাসটা আবার ঝাঁপিয়ে ওঠে, মেয়েটির শার্ট আবার লেপটে যায় বুকে। যেন অদৃশ্য একটা হাত থপথপ করে বলটাকে বেশ দৃশ্যমান করে তোলে।
কী বেহায়া? কোথায় শার্ট টেনে ধরে বুক সামলাবে, লোকের চোখ থেকে স্তনের ডোল বাঁচাবে, তা নয়, দ্যাখো দিব্যি আছে। বুক ঠেলে আছে। বুকের ভেতরে বোঁটা পর্যন্ত চোখে পড়ছে এখন! লম্পটের মতো হামলে পড়ে নদীর দমকা বাতাস যেন ওদুটি নিয়ে ছানাছানি করছে।
আর একি! আমার চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি আবছা মিষ্টি হেসে উঠলো যে!
আমি অবাক হয়ে যাই। টের পাই, আমার মুখেও আবছা হাসি ফুটে উঠছে। যেন আমি তার হাসির জবাবে সাড়া দিচ্ছি। আমি সম্মোহিত হয়ে যাই। আমার পা একবার মেয়েটির দিকে চঞ্চল হয়ে ওঠে। বুঝি একটি পা আমার অগ্রসরও হয়ে যায়। কিন্তু ব্যাপারটা টের পাওয়া মাত্র আমি নিজেকে গুটিয়ে নিই। সন্ত্রস্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিই।
পাড়ে বাস আর গাড়ি লাইন দিয়ে দাঁড়ানো। তাকিয়ে দেখি, লোকটি এখন সেই লাইন ধরে পায়ে পায়ে হাঁটছে। মেয়েটি থেকে চোখ ফিরিয়ে আমিও সেই লাইন ধরে হাঁটতে থাকি। লোকটিকে নজর থেকে বাইরে যেতে দিতে রাজি নই। কিন্তু আমার যেন মনে হতে থাকে মেয়েটিও আমাকে দেখছে।
দূর থেকে আমি ফিরে তাকাই। অনুমান সত্যি। মেয়েটি আমারই দিকে তাকিয়ে আছে। আমার ভেতরে মৃদু একটা উত্তেজনা টের পাই। একটা গন্ধ পাই। রাতের একটা হাতছানি পাই। আমি এর হাত থেকে নিস্তার চাই। আমি ভিড়ের ভেতরে ঢুকে যাই।
আর কিছু না পেয়ে আমি লোকটিকেই অনুসরণ করতে থাকি। কেন তাকে অনুসরণ করি আমার বোধে আসে না। সত্যি এই, এ নিয়ে আমি যে ভাবছি, তাও নয়। কেবল অনুভব করি, কী একটা কারণে যেন লোকটি আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে।
অথচ লোকটিকে আমি চিনি না। আগে কখনো তাকে দেখিনি।
আমি চিন্তিত হয়ে পড়ি। চিন্তাটিকে ঈষৎ দুশ্চিন্তা বলেই বোধ হয় আমার। আমি ঠাহর করতে পারি না দুশ্চিন্তার কারণটি কী হতে পারে?
লক্ষ করি লোকটি এবার দাঁড়িয়ে পড়েছে। বছর পঁচিশ কি সাতাশের কোঠায় এক ভদ্রমহিলা শাদা একটা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। সঙ্গে এতটুকু একটি বাচ্চা। মেয়ে বাচ্চা। মায়ের আঙুল ধরে মায়েরই চারপাশে টলমল করে ঘুরছে। মেয়েটির স্বামী গাড়ি থেকে বেরিয়ে সিগারেট ধরিয়ে উপভোগ করছে নদী, মানুষ, ভিড়। বারবার হাতঘড়ি দেখছে।
ভদ্রমহিলা নিচু হয়ে ধরে আছে শিশুটিকে। শিশু বারবার বেসামাল হয়ে পড়ছে। আর ভদ্রমহিলারও বুকের কাপড় পড়ে পড়ে যাচ্ছে। বাচ্চার দুধে পুষ্ট স্তনজোড়া বিশাল ফলের মতো গড়িয়ে পড়ছে নিচু হতেই। কিন্তু অাঁচল তোলার তেমন বিশেষ তাড়া নেই ভদ্রমহিলার। আর হাসছে। আর বারবার গড়ানো অাঁচলের কোণ ধরে চারদিকে তাকিয়ে হাসছে। খোলা বুক ব্লাউজের দিকে খেয়াল নেই, ঠোঁট মচকাচ্ছে। যেন একটা গরব। গরবটা নতুন মা হবার কি নিজের যৌবন এখনো উপচে পড়া বোধেই কিনা কে জানে!
লোকটিও কম টাউট নয় দেখছি। ভদ্রমহিলার একেবারে কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ফ্যালফেলে চোখ মেলে একবার সে মহিলাকে দেখছে, আরেকবার তার বাচ্চাটিকে। আমিও দেখি আমিও একেবারে তাদেরই কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়েছি।
রোদের তপ্ত বেলায় মহিলার বস্নাউজের বগল ঘামে জবজবে। ঘামে বোধহয় নুন থাকে। বগলের কাছে শাদা চিতুই দাগ পড়েছে। এ আজকের ঘাম নয়। কতদিন কাচেনি? মুখে কড়া প্রসাধন ছিলো। এখন গলে একাকার। কাজল লিপস্টিক পাউডার সব লেপটালেপটি। মহিলার গালের কাছে একটা মাছি ভনভন করছে। বোধহয় গায়ে মাখা কড়া সুগন্ধের টানে। স্বামীটি তার দিকে তাকিয়ে আছে এক ধরনের ঘোর লাগা চোখে।
তখন আমি চোখ ফিরিয়ে নিই। একটু তফাতে সরে যাই। লোকটিও সরে যায়। গলা টান করে দূর থেকে সে নিরিখ করতে থাকে। তারপর একটা দূরপাল্লার বাসের কাছে যায়। আমি আমার জায়গা থেকেই তাকে লক্ষ করতে থাকি।
কিন্তু আমার মনের মধ্যে ভদ্রমহিলার ঘামে ভেজা বস্নাউজের বগল আর লেপটানো প্রসাধনে উষ্ণ মুখখানা জবরদস্তি বসে থাকে। ছবিটা আমি মুছে ফেলতে চাই। পারি না। আমি একবার মহিলার দিকে আরেকবার লোকটির দিকে চঞ্চল চোখ ফেরাতে থাকি।
একবার, মহিলা থেকে লোকটির দিকে চোখ ফেরাতেই দেখি লোকটি নেই। আরে! গেলো কোথায়? এই তো ছিলো! আমি ভিড়ের ভেতরে আতিপাতি করে খুঁজি তাকে। না, দৌড়ে নয়। চোখ দিয়ে খুঁজি। পাই না। আমি তখন একটু একটু করে সরতে থাকি। সরতে সরতে আবার সেই ভদ্রমহিলার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি।
শুনি, ভদ্রমহিলার স্বামী চাপা গলায় শাসন করছে স্ত্রীকে। হঠাৎ কী বিষয়ে চটে গেলো ভদ্রলোক? তপ্তগলায় স্ত্রীকে সে বলছে, তোমার বড্ড ইয়ে দেখছি! কোনো হুঁশ নাই! গাড়িতে এসে বোসো!
স্ত্রীও কম যায় না। সে বলছে, তুমি বোসো গিয়ে গাড়িতে। আমি নদীর হাওয়া খাবো।
খাই তোমার মেটে না!
চুপ!
তুমি চুপ!
বুক সামলাও!
তুমি চোখ সামলাও! জার্নিতে এ রকম হয়!
জার্নি জার্নি জার্নি। মনের মধ্যে শব্দটা আমি দোহরাতে থাকি। আমার স্ত্রীকে নিয়ে অনেক জার্নি করেছি। ঢাকা থেকে ঝিনেদা। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল। ঢাকা থেকে কুমিল্লা চট্টগ্রাম। বেড়াতে পেলে ওর আর কথা নেই। চোখ ভরে দুনিয়া দেখবে। সাধ্য নেই ব্যাংকক কি সিঙ্গাপুরে যাই। তাই দেশের মধ্যেই। ময়নামতি, মুজিবনগর, পাহাড়পুর, সমুদ্র, চা বাগান।
কিন্তু ওর খুব ভয় জার্নিতে। বাড়ি থেকে বেরুবার সময় দোয়া কালাম পড়বে। হাতব্যাগের ভেতর পুরো টয়লেট রোল নিয়ে বেরুবে। কী জানি বাবা, জার্নিতে কোথায় বাথরুম! সেখানে টয়লেট রোল পাওয়া যায় কি না যায় ঠিক কি! পানির বোতল নেবে চার পাঁচটা। বাবা, পথে পানি খেয়ে কি ডায়রিয়াই হয়! আর সারাটা পথ অাঁচল টেনে শরীর ঢেকে রাখবে। বাবা! পথে অজানা অচেনা মানুষের নজর বড় নষ্ট হয়!
আরে! অজানা অচেনা বলেই তো! দেখলেই বা!
সকলে তো আর তোমার মতো না! নিজের বৌকেও দেখতে যার লজ্জা!
এতক্ষনে আমি হদিশ পাই কেন আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো। কেন ওই লোকটিকে আমার পছন্দ হচ্ছিলো না। ওই লোকটির জন্যেই তো যা কখনো দেখি না তাইই আমাকে আজ দেখতে হলো।
আমি কি তবে নজর নষ্ট মানুষ হয়ে যাচ্ছি এতদিন পরে আজ এই নদীর পাড়ে, ফেরি জাহাজের অপেক্ষায় ভিড়ের ভেতরে? জিন্সের ট্রাউজার পরা ওই মেয়েটি, ঘামে বগল জবজবে ওই ভদ্রমহিলাটিকে আমিও যে লোকটির মতো লম্পটের চোখে দেখছি!
দেখছি তো বটেই! দেখে ফেলেছি। চোখ ফেলে দেখেছি! ঘুরে ঘুরে দেখেছি!
আমার স্মরণ হয়, এই প্রথম আমি একা বেরিয়েছি গাড়ি নিয়ে। একা। শুধু আমি। আজ আমার স্ত্রী সঙ্গে নেই। এই প্রথম সে নেই। ঊনচলি্লশ দিন আগে আমার স্ত্রী মারা যায় স্তনের ক্যানসারে। আগামিকাল তার কুলখানি। আমি শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। সেখানে তার কুলখানি হবে।
লোকটিকে হঠাৎ আবার আমি দেখতে পাই। বাস থেকে নেমে আসছে। সম্ভবত এই বাসে করেই সে কোথাও যাচ্ছে। বাসের মাথায় লেখা দেখি_ ঢাকা টু মেহেরপুর। মেহেরপুরে আমিও গেছি স্ত্রীকে নিয়ে। মুজিবনগর দেখে এসেছি। স্বাধীন বাংলার সরকার যেখানে শপথ নিয়েছিলো সেই বৈদ্যনাথতলায়।
আমরা বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে। আমি উদ্ভ্রান্তের মতো এলোপাতাড়ি হাঁটতে থাকি। আমি বাসের ভেতরে গাদাগাদি করা নারীদের দেখি। তাদের একজন জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে ওয়াক ওয়াক করে বমি করছে। হলুদ ভাত উঠে আসছে। সকালে বুঝি ভাত খেয়ে বেরিয়েছিলো।
আরেক জানালায় দুটি গেঁয়ো কিশোরী রাজ্যের ভয় নিয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে বসে আছে। তাদের মাথায় তেল জবজবে বিনুনি। তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে জগতের দিকে তাকিয়ে আছে।
আরেক জানালায় দেখি এক বুড়ি মুখ বাড়িয়ে পানের পিক ফেলছে। বাসের গা থেকে পিক গড়িয়ে পড়ছে থসথস করে।
হঠাৎ দেখি কোথা থেকে সেই লোকটি এসে জানালার কাছে দাঁড়ালো। তারপর বুড়িকে সে ধমক দিয়ে উঠলো।
আম্মা, পানের পিক প্যাসেঞ্জারের গায়ে পড়বো! বাসের গাও বা কি করছো! সাবধানে ফালাও।
আর তর সাবধান! বুড়াকালে তুই কি আমারে দেখস? পান ছাড়া দুনিয়ায় আমার আর আছে কী? দ্যাখ তুই জর্দা নি পাওয়া যায়! আমার জর্দা ফুরায়া গেছে।
লোকটি দ্বিগুণ ধমক দিয়ে এবার বলে, মওতের সময় হইলো তও তোমার জর্দার হাউস গেলো না।
মওত! মওতের ডর দেহাস আমারে? খলখল করে হেসে উঠলো বুড়ি।
লোকটি তখন আরো খেপে গিয়ে বললো, কব্বরে তোমার জর্দা দিমু, চিন্তা কইরো না।
বুড়ির তখন চোখ পড়ে আমার দিকে। বলে, হুনছেন, কথা হুনছেন হারামজাদার? এই বুকের দুধ খাওয়াইছি, মানুষ করছি।
লোকটি বিদ্রুপ করে বলে, দুধের খোঁটা আর কত দিবা? শুকায়া গেছে!
বুড়ি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বাসের জানালা দিয়ে শীর্ণ শরীরের প্রায় সবটা বের করে চেঁচিয়ে ওঠে, আরে আভাগির পুত, এই বুকে অখনো দুধ আছে। জগত খায়া শেষ করতে পারবো না এত দুধ! তুই তো তুই! নাদানের বাচ্চা নাদান! তর মতো হাজারটা পোলারে অখনো আমি দুধ দিবার পারি!
এই বলে বুড়ি জানালা ঠেলে মাথা খাড়া করে দাঁড়ায়। বুক থেকে চাদর ফেলে দিয়ে জগতকে দেখায়। আমিও দেখি। মরা স্তন। শীর্ণ স্তন। কবেকার মায়ের স্তন। কোন কতকাল শত বছরের সেই দুধেল স্তন। এখন চুপসে আছে। স্তনের চিহ্নমাত্র এখন আর সে বুকে নেই। শস্তা সবুজ বস্নাউজ ঢলঢল করছে।
লোকটি আমার দিকে হঠাৎ ফিরে তাকায়। এই প্রথম সে আমার সঙ্গে কথা বলে।
আম্মার মাথাটা বুঝলেন না, ঠিক নাই। অনেক দিনের ব্যারাম।
আমি কাতর হয়ে পড়ি কথাটা শুনে। আমি পায়ে পায়ে পেছন হটে আসি।
শুনতে পাই লোকটি তার মাকে এবার ঠা-া গলায় বলছে, আম্মা, বুক ঢাকো। বুক ঢাকো। বুড়া হয়া তোমার শরমভরম সব গেছে। চাদরটা গায়ে দেও। দুনিয়া যে দ্যাখে।
জগত প্রকাশিত হয়ে থাকে। জগত দেখতে থাকে। শিশু মেয়েটির মা সেই ভদ্রমহিলা গাড়িতে গিয়ে বসে। পিলার থেকে পাছা তুলে তরুণী মেয়েটি বুকের ওপর তার শার্ট ঢিলে করে টেনে দেয়। নদীর বুক ভেঙে ফেরি জাহাজের ভোঁ শোনা যায়। আমি আমার স্ত্রীর কথা স্মরণ করে উঠি। ওগো, আমি মরে গেলে তুমি আর কারো দিকে চোখ দেবে না তো?
আমাদের কোনো সন্তান নাই। আমাকে সে স্তন দিয়েছিলো, সন্তানকে দেবার মতো ভাগ্য হয় নাই রাহেলার ।