শহীদ আবু তাহেরকে আমরা কী চোখে দেখব?আমরা তার প্রশংসা করতে পারি, কিন্তু তিনি তো নিন্দা-প্রশংসার বাইরে গেছেন চলে; কে তার প্রশংসা করবে কে আসবে চাপড়ে দিতে তার পিঠ? আমরা পারি তাকে করুণা করতে। সে হবে আরো বেশি অন্যায়, তার জন্য। করুণার পাত্র ছিলেন না তিনি কোনো হিসাবেই। অথবা পারি আমরা কাঁদতে তার স্মৃতিকে স্মরণ করে, তার অদৃশ্য লাশকে দৃশ্যমান করে। সেও তিনি চাননি। আক্ষেপ বলি, ক্রন্দন বলি, অথবা বিলাপ কিংবা মাতম এসব অতিশয় প্রাচীন কাজ আমাদের। তাহের সেই ঐতিহ্যের অন্তর্গত ছিলেন না এবং ছিলেন না বলেই শহীদ তিনি; ব্যথা আছে টিকে, তিনি আজ নেই। না, প্রশংসা, করুণা বা্ ক্রন্দন কোনোটাই প্রাপ্য নয় শহীদ আবু তাহেরের। প্রাপ্য যদি হয় তবে তার কাজের মূল্যয়ন যা ছিল, তার আকাক্সক্ষা, তার তাৎপর্য নির্ণয় এবং সেই প্রসঙ্গেই তাকে স্থাপন করতে হয় আমাদের জীবনযাপনের সাধারণ পটভূমিতে। আমাদের সাধারণ প্রবণতা পলায়নের ও আত্মসমর্পণের। কেউ কেউ পালায়, অনেকেই আত্মসমর্পণ করে, যুদ্ধ করে মাত্র অল্প ক’জন। পলাতকরা হয়তো জানে না তারা পালাচ্ছে, আত্মসমর্পণকারীরাও পারে বেখেয়াল হতে, কিন্তু যোদ্ধার পক্ষে কোনো উপায় নেই যুদ্ধকে না জেনে। প্রতিনিয়ত, প্রতিমুহূর্তে যোদ্ধা জানেন তিনি আছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। আরো এক যুদ্ধ আছে, জীবনযুদ্ধ। সে যুদ্ধে নিয়োজিত আমরা সবাই। প্রাণপণ চেষ্টা করে কোনোমতে বাঁচি। বাঁচার মধ্যে মরি, মরতে মরতে বাঁচি। কী পলায়ন, কী আত্মসমর্পণ সব কিছুই ওই যুদ্ধেরই অন্তর্গত। জীবনযুদ্ধে নিন্দা প্রশংসার স্থান আছে, স্থান আছে করুণা ক্রন্দনেরও। আমরা একে-অপরের প্রশংসা করি না পারলে নিন্দা; ভিক্ষাও দিয়ে থাকি কখনো,কখনো ঘৃণার কিংবা করুণায়।কিন্তু যে লড়াই সমবেত, সমষ্টিগত, সামাজিক,রাজনৈতিক সে তো ভিনড়ব যুদ্ধ। সেখানে পক্ষ দুটোÑ শত্রু ও মিত্র। নিরপেক্ষ কেউ নয়, দর্শক কেউ নেই। তবে হ্যাঁ, পলায়ন আছে, আত্মসমর্পণও আছে। অনেকের পলায়ন এবং বহুজনের আত্মসমর্পণ সত্ত্বেও যুদ্ধটা চলছে নির্মম ও বিরামহীন এক যুদ্ধ। শহীদ আবু তাহের এই সুদীর্ঘ ও আপসবিহীন যুদ্ধেরই অগ্রসৈনিক ছিলেন একজন। পলায়ন করেননি, আত্মসমর্পণের কথা ভাবেননি, লড়তে লড়তে মারা গেছেন এবং মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে ধিক্কার দিচ্ছেন তাদের যারা পালিয়েছে, তাদেরও যারা আত্মসমর্পণ করেছে, কিন্তু প্রধানত তাদের যারা আধমরা করে রেখেছে মানুষকে, পোষক যারা, যারা নিপীড়নকারী। এ যোদ্ধাকে আমাদের সাধ্য কি প্রশংসা, করুণা কিংবা ক্রন্দন দিয়ে আামাদের নিজেদের স্তরে নামিয়ে আনি? ওই লড়াইয়ের প্রথম শর্ত বিবেক, দ্বিতীয় শর্ত সাহস। বিবেক আবেগনির্ভর। আবেগহীনের বিবেক নেই, অথবা থাকে যদি বা তবু থাকে ব্যাঙাচির লেজের মতো, পরিণতিতে ঝরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায়। অধিকাংশ মানুষ বিবেককে গুটিয়ে রাখে, অব্যবহারে তা আড়ষ্ট হয়, এক সময়ে অজান্তে, অলক্ষ্যে অব্যবহার্য হয়ে পড়ে। পলায়নকারীর পক্ষে বিবেক একটি বোঝা, আত্মসমর্পণকারীর পক্ষেও তাই। মানুষের মুক্তির জন্য লড়ছেন যিনি তাকে তো অতি অবিশ্যি বিবেকবান হতে হবে। কিন্তু তার বিবেকে আবেগের সাথে বিবেচনাও থাকে কার্যকর। মানুষের প্রতি করুণা আছে বলে যুদ্ধ করেন না, যুদ্ধ করেন মানুষকে ভালোবাসেন বলে, কিন্তু সেই ভালোবাসা অন্ধ করে দেয় না তাকে, তার দৃষ্টিতে বৈজ্ঞানিকতা থাকে, তিনি বোঝেন কে শত্রু কে-ই বা মিত্র, এবং লড়েন সেই চিহ্নিত শত্রুর বিরুদ্ধে। অস্বীকার করবে কে যে শত্রুমিত্রের সঠিক নির্ধারণ যে কোনো যুদ্ধের একেবারে প্রাথমিক পদক্ষেপ। সমাজ পরিবর্তনের লড়াই যে যোদ্ধাদের আত্মত্যাগের তুলনায় কম এগোয় তার কারণ শত্রুকে মিত্র থেকে আলাদা করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান ভ্রান্তি। কিন্তু শুধু বিবেচনাসমৃদ্ধ বিবেক থাকলে তো চলে না, সা
হসও লাগে। নইলে বিবেক চুপ করে যায়, লুকিয়ে পড়ে, পলাতক হতে পারে, হতে পারে আত্মগোপনকারীও। সাহস একটি উচ্চস্তরের মানসিক গুণ, সব দেশেই বিশেষ করে আমাদের দেশে যে কোনে যুগ-যুগান্তরে পরাধীনতা দাস মানসিকতার সৃষ্টি করে রেখেছে, সেখানে স্থানীয় শাসনকর্তারাও সন্ত্রস্ত থাকে, ভীত জোরদার নয় বলে। শহীদ আবু তাহেরের সাহসের সঙ্গে কার সাহসের তুলনা করব? তার সঙ্গে তুলনীয়রা আমাদের আশপাশে প্রায় নেই-ই, আছেন যারা তারা ইতিহাসের। স্বার্থ ত্যাগ নয়, তথাকথিত আত্মত্যাগও নয়,জীবন দিয়েছিলেন তিনি। আমরা জানি এর আগে,আরেক সামনাসামনি যুদ্ধে,দেহের একটি অঙ্গকে ত্যাগ করেছিলেন তিনি। পা হারিয়েছিলেন।শারীরিকভাবে পঙ্গু মানুষের সংখ্যা আমাদের সমাজে মোটেই কম নয়। পরিসংখ্যান বলে,বাংলাদেশে পঙ্গুর শতকরা হার ক্রমেই বাড়ছে পুষ্টির অভাব, অভাব খাদ্যের। মানসিক পঙ্গুত্বের পরিমাণও বৃদ্ধির পথেই। শিক্ষিতরাও কুশিক্ষিত বহু ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। কিন্তু নৈতিক পঙ্গুত্ব? সেটা অনেক বেশি ভয়াবহ, অনেক বেশি ব্যাপক বলেই ন্যায়-অন্যায়ের বোধ কেবলই অস্পষ্ট হয়ে যায়। ক্রন্দন শোনা যায় কখনো কখনো, সংগঠিত প্রতিবাদের বড় অভাব। দালালি, তোষামোদি, চাটুকারিতা, বিশ্বাসঘাতকতা কেমনভাবে যে সার্বজনীন হয়ে উঠেছে দ্রুত তা দেখলে শিউরে উঠতে হয় ভয়ে। পলায়নকারী ও আত্মসমর্পণকারীদের নৈতিকতাই প্রধান সত্য নৈতিকতার ক্ষেত্রে। সমাজ প্রশংসা করে এ নৈতিকতারই। কেননা সমাজের মুখপাত্র যারা, যারা সমাজের নিয়ন্ত্রণকর্তা তারা যে টিকে আছে এবং বাড়ছে শশীকলার মতো সে তো বিদেশি প্রভুদের সঙ্গে দালালি ইত্যাদির সম্পর্ক স্থাপন করেই, নইলে কোথায় যেত ভেসে। তদুপরি যারা বিদ্রোহ করে,যারা বলে যে পাল্টে দেবে ব্যবস্থা তারা সরাসরি শত্রুতা করছে বলেই ধরে নেয়া হয় স্বাভাবিকভাবেই। তখন আসে প্রলোভন, আসে গর্জন। কাজ না হলে প্রহার, শেষ পর্যন্ত হত্যা। তাহের শহীদ হয়েছেন নরম হননি বলেই। নৈতিক পঙ্গুতার এ হতাশাদীর্ণ লোকালয়ে স্বাস্থ্যবান মানুষ তিনি, এখানে তার স্থান সঙ্কুলান হবে কেন? স্থান সঙ্কুলান হতে পারত যদি বদলা তো সমাজ। সে জন্যই চেষ্টা করছিলেন পুরাতন সমাজ ভেঙে নতুন সমাজ গড়ার জন্য উদ্যম নিয়েছিলেন, পলায়ন করেননি, আত্মসমর্পণের পথে যাননি, গিয়েছেন যুদ্ধের পথে। তার শাহাদাত প্রমাণ করল সত্যিকারের যোদ্ধা ছিলেন তিনি।
সমাজ টিকে আছে। তার পাহারাদার প্রতিষ্ঠান,আইন-কানুন সব কিছু ঠিক আছে। শুধু তিনি চলে গেছেন। যেমন আরো অনেকে গেছেন।সেই চলে যাওয়া আমাদের সাধারণ অপব্যয়েরই অংশ মাত্র। সবচেয়ে বিবেকবান যারা, যারা সবচেয়ে সাহসী তাদের সহ্য করা হয় না;
সমাজের সন্ত্রস্ত অধিপতিরা হত্যা করে তাদের। আমাদের মতো দরিদ্র দেশে দারিদ্র্যের একটি কারণ সীমিত সম্পদ যেটুকু আছে তারও অপব্যয়। একই সঙ্গে যারা বিবেকবান ও সাহসী
সেই মানুষই এ সমাজের সবচেয়ে মূল্যবান এবং একই সঙ্গে সবচেয়ে দুর্লভ সম্পদ, অথচ তাদেরই হয় নিশ্চুপ করে দেয়া হয় ধমকে, প্রলোভনে নয়তো হত্যার মাধ্যমে। ফলে দারিদ্র্য পথ পায় স্থায়ী হওয়ার। বিবেকবান ও সাহসী মানুষই কাজ করেন,সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে কাজ সেই কাজ অর্থাৎ সমাজ পরিবর্তনের কাজ। এ কাজ যেমন কঠিন তেমনি অবিরাম, অফুরন্ত। আমাদের দেশে কাজের বড় অভাব, যে জন্য লাখ লাখ মানুষ বেকার থাকে, এমনকি যারা কর্মে নিয়োজিত তারাও যথেষ্ট কাজ পায় না, অথবা করে না। শুধু ওই একটি ক্ষেত্র, সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্র যেখানে কাজের কোনো শেষ নেই। এ কাজ যারা করতে যান, বাগাড়ম্বরের রঙিন পোশাক পরিহার করে, শান্ত অথচ অনমনীয় সাহস নিয়ে যারা এ কাজে ব্রতী হন, অসুস্থ দুষ্ট সমাজ কিছুতেই তাদের ক্ষমা করে না। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানির তবু ক্ষমা আছে, সমাজ পরিবর্তনে প্রচেষ্টা নেই।এ অপরাধ সবচেয়ে কঠিন অপরাধ আমাদের সমাজে। এ অপরাধেই ফাঁসি হয়েছে আবু তাহেরের। যেমন আরো অনেক অনেক অপরাধীর হয়েছে তার আগে এ দেশে, অন্য দেশে, সব দেশেই। না, প্রশংসা, করুণা, ক্রন্দন, কোনোটাই নয়।
আমরা তাকে করতে পারি না শুধু শোষণবিহীন নতুন সমাজ গড়ার কাজে ভিনড়ব। সেই কাজের মধ্যেই বাঁচবেন তিনি। সহযোদ্ধারাই শুধু পারে তাকে সম্মান করতে, অন্য কোনো পঙ্গু মানুষের সে ক্ষমতা নেই। তাহের আমাদের অভিযুক্ত করছেন, আমরা যারা হয় পলাতক নয়তো আত্মসর্ম্পণকারী এবং অবশ্যই পঙ্গু, যাদের হয় বিবেক কিংবা সাহস অথবা দুটোর কোনোটাই নেই। এবং সেই সঙ্গে অনিবার্যভাবে জিজ্ঞাসা করছেন এ প্রশড়ব, আমরা কে কোন পক্ষে? শহীদরা মানুষের ভাগ করে দেন দুই পক্ষে- শত্রু ও মিত্র। তাহেরও দিয়েছেন। হয়
মিত্র, নইলে-এর মধ্যে তৃতীয় কোনো অবস্থান নেই।