অভিজ্ঞতা ছাড়া মহৎ সাহিত্য তৈরি হবে না

আমার আগ্রহটা ছিল বই পড়ায়। শিশুসাথী, শুকতারা, পুজোবার্ষিকী পড়তাম শৈশব, কৈশোরে। একটা দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে সাহিত্যের প্রীতিটা জেগে উঠল। তখন রাজশাহীতে, বোধ হয় সিক্সে পড়ি। ফুটবল খেলতে গিয়ে পা ভেঙে গেল। প্লাস্টার করে শুয়ে থাকি। আজাদ পত্রিকায় ‘মুকুলের মাহফিল’ বেরোত। ওটা খুব প্রিয় ছিল। বাবা ‘মুসলিম ইনস্টিটিউট’-এর লাইব্রেরির বই এনে দিতেন। কিশোরদের বই, শরৎচন্দ্রের বই, মোহন সিরিজ। পড়তে পড়তে দেড় মাসের মধ্যে সাহিত্যের অনুরাগ জন্মাল। মুকুলের মাহফিলে চিঠি লিখতাম। জবাবও পেতাম। খুব ভালো লাগত। দেশভাগের পর ঢাকায় এসে লেখালেখির পরিবেশ পেলাম। আত্মীয়ের মধ্যে ছিলেন কবি ফয়েজ আহমেদ। কাছেই থাকতেন। ‘হুল্লোড়’ বলে পত্রিকা বের করতেন, লিখতাম। বন্ধু শফিক রেহমান ও আমি একসঙ্গে স্কুলে এক ক্লাসে পড়েছি। ‘সচিত্র টেন’ বলে হাতে লেখা পত্রিকা বের করত। লিখতাম। পাড়ার ছেলেরা মিলে হাতে লেখা ‘ফোয়ারা’ পত্রিকা বের করতাম। আজিমপুর কলোনিতে এসে দেয়াল পত্রিকা বের করলাম ‘ঝামেলা’। আরেকটা আগ্রহ ছিল পড়া। খুব পড়তে ভালোবাসতাম। সম্পাদনার আগ্রহও ছিল। লেখা আসছে, সম্পাদক কেটে দিচ্ছেন, মনোনীত করছেন- খুব উপভোগ করতাম। পরবর্তী সময় অনেক পত্রিকা সম্পাদনা করেছি। কিন্তু ওগুলোর সূত্রপাত কৈশোরেই হয়েছিল। আজাদ অফিস ছিল পাশেই, ঢাকেশ্বরীতে। ভেতরে ঢুকতে সাহস পেতাম না, দারোয়ান থাকত। তার কাছে লেখা দিয়ে আসতাম। পরে দেয়ালে টাঙানো পত্রিকায় দেখতাম। কোনোটা ছাপা হতো, কোনোটা হতো না। মেট্রিক পরীক্ষার পর তো অনেক অবকাশ, অনেক বই পড়লাম। এক আত্মীয়ের বাড়িতে ‘বেস্ট শর্ট স্টোরিস’ নামে বই পেলাম, মোঁপাসার ‘ডায়মন্ড’ গল্পটা ছিল। নিজের মতো করে অনুবাদ করে দারোয়ানের কাছে দিয়ে এসেছি। আজাদ অফিস থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘মোহাম্মদী’ আহসান হাবীব সম্পাদনা করতেন। পরের মাসে অনুবাদ হিসেবে গল্পটা ছাপা হলো। খুব অনুপ্রাণিত হয়ে মোঁপাসার আরেকটা গল্প ‘এ পিস অব স্টিং’ ‘এক টুকরো সুতো’ নামে অনুবাদ করলাম। ‘খেলাঘর’ ছিল সংবাদে। হাবিবুর রহমান দাদাভাই সম্পাদক। ডাকে একটি লেখা পাঠিয়েছিলাম, ছবিসহ ছাপা হয়েছিল। তখন ইলাস্ট্রেট্রেড (ছবি দিয়ে ছাপা) খুব একটা গৌরবের বিষয় ছিল। আজিমপুর কলোনিতে ছাত্রসংঘ, সাহিত্যসভা করি। নিউজ দিতে গিয়েছিলাম সংবাদ অফিসে। হাবিবভাই নিউজ টেবিলে, বললেন- ‘এখানে তোমার নাম, স্বাক্ষর দিতে হবে কে নিউজ দিল।’ নাম লিখলাম, ঠিকানা দিলাম। ‘ও তুমি লেখ, না?’ আমার লেখা ছাপা হয়েছে তাঁর ওখানে। বললাম, হ্যাঁ হাবিব ভাই লিখি। একটা বিল আছে। একদিন এসে টাকা নিয়ে যেও।’ ইনভেলাপে পোস্টকার্ড পাঠালাম- ‘কবে যাব আপনি যদি পোস্টকার্ডে লিখে দেন তাহলে গিয়ে নিয়ে আসব। পোস্টকার্ডটা এলো, ‘এসে নিয়ে যেও।’ ১০ টাকা পেয়েছিলাম। ওই ১০ টাকাই আমার লেখার প্রথম উপার্জন। এভাবে শিখেছি।
উপদেশ বলে কিছু নেই। অভিজ্ঞতা থেকে দুটো পরামর্শ হতে পারে- লেখককে পড়তে হবে। অনেক পড়তে হবে। না পড়লে লেখা যাবে না। তৈরি করতে হবে নিজস্বতা। নিজস্ব স্টাইল থাকতে হবে। সে স্টাইলটা গড়ে উঠবে অন্যের প্রভাবে। এতে লজ্জা নেই। কিন্তু সব প্রভাবকে একত্র করে নিজের মতো করতে হবে। খালি স্টাইল দিয়ে তো হবে না। কল্পনাশক্তি বিকশিত করা দরকার হবে, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হবে। এই দুটোই বাড়বে বাস্তব জীবন থেকে আর বই পড়ে। অন্যের লেখা পড়ে। কাজেই অন্যের লেখা পড়া, সাহিত্য পড়ার কোনো বিকল্প নেই। আমি ভুল জায়গা থেকে আরম্ভ করেছিলাম মনে হয়। আমি প্রথমে স্টাইল তৈরি করার চেষ্টা করেছি। উচিত ছিল, প্রথমে অভিজ্ঞতাটা বাড়ানো। এটা ব্যক্তিগত, বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা ও গ্রন্থ পাঠ থেকে আহরিত অভিজ্ঞতা- দুটোই সঞ্চয় করা উচিত ছিল। বাস্তবগত অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। আমরা মধ্যবিত্ত গণ্ডির মধ্যে মানুষ হয়েছি এবং ওর বাইরে সামাজিক তেমন একটা জীবন ছিল না। ফলে আমি উল্টোদিক থেকে আরম্ভ করেছি। স্টাইলটা আগে তৈরি করে পরে অভিজ্ঞতার কাছে গেছি। এ দুটোই সমান্তরালে যাবে এবং অভিজ্ঞতাকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। অভিজ্ঞতা ছাড়া কোনো মহৎ সাহিত্য তৈরি হবে না। এটি একটি অনুশীলনের ব্যাপার। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, লেখক কখনো সন্তুষ্ট থাকবেন না এবং লেখার কোনো শেষ নেই। এটার উন্নতি করা, সংশোধন করা, পরিমার্জনের কোনো শেষ নেই। সে জন্য বড় লেখকরা ক্রমাগত কাটাকুটি করেন, সন্তুষ্ট হন না, শব্দ নিয়ে চিন্তা করেন।