ভোরবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলতে পারে না সন্ধ্যা। দুচোখ জলে ভিজে আছে। আজ উৎসব। বছরের প্রথম দিন। নববর্ষের ভোরের আলো ফুটেছে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে আলো ছড়িয়েছে ঘরে। সন্ধ্যা জলভেজা চোখে বিছানায় উঠে বসে। একটু পরে সবাইকে নিয়ে নোম্যান্স ল্যান্ডে যাবে। দেখা হবে বকুলের সঙ্গে। কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশ থেকে বকুল আসবে। কাঁটাতারের বেড়ার এপাশ থেকে যাবে সন্ধ্যা। তারা দুই বান্ধবী।
নিজের ঘরে একই ভঙ্গিতে বকুলও বিছানায় উঠে বসেছে। দরজা খুললে ওর মনে হয় ভোরের আলোর সবটুকু নিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সন্ধ্যাতারা। সেদিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলে, আজ আমাদের মিলনমেলা। তোকে দেখতে আমি যাব সন্ধ্যা। আমি জানি তুই আমার আগেই এসে পৌঁছে যাবি সীমান্তে। আমাদের একদিনের ঘরবাড়ি এখন এই সীমান্ত। এই সীমান্ত আমাদের একদিনের ছোটবেলা।
নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যা ছেলেমেয়ে-নাতি-নাতনিদের ডাকে। তৈরি হতে বলে। নিজে সীমান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য খাবারের পোঁটলাগুলো গোছায়।
পঞ্চগড়ের বোদাপাড়া গ্রামে একই দিনে জন্ম হয়েছিল দুজনের। দুজনের বয়স এখন ৮২ বছর। দুজনই পয়লা বৈশাখের জন্য অপেক্ষা করে। কাঁটাতারের সীমানা দেওয়া বেড়ার এপাশে আর ওপাশে বসে আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে। হাত ধরাধরি করে বসে থাকে। বকুল মোয়া-মুড়ি-জিলাপি নিয়ে হাজির হয়। সন্ধ্যা নিয়ে আসে তেলে-ভাজা পিঠা, নারকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু কিংবা মুড়ি-গুড়। এভাবে পয়লা বৈশাখ ওদের কাছে অন্য আত্মীয়স্বজন কিংবা পরিচিতজনের সঙ্গে মেলামেশার উৎসব। আনন্দের জোয়ার। দুজনই ভাবে কাঁটাতার দিয়ে কি ভালোবাসার টান আলাদা করা যায়? আজ আমাদের সামনে কাঁটাতার থাকবে না।
বকুলের বাবা হাসমত মিয়া চাষবাস করে সংসার চালায়। খুব অভাবের সংসার না। মেয়েকে স্কুলে পড়িয়েছে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। সন্ধ্যার বাবা হরিপদ দাস। সে-ও কৃষিজমিতে চাষবাস করে সংসার চালায়। মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবে এমন চিন্তা করত।
মেয়েদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠায় দুজনের দিনকাল বেশ স্বচ্ছন্দে কেটেছে। দুজনে দুজনকে নতুন নামে ডাকে। সন্ধ্যা বলে, ওরে আমার ঝরাবকুল তোকে কুড়িয়ে কোঁচড় ভরি। বকুল বলে, ওরে আমার সন্ধ্যাতারা, তোর দিকে তাকিয়ে থাকি। তুই আমার আকাশ। চল আমরা হাত ধরে মাঠে দৌড়াই।
: চল, চল। ওই দেখ বুলবুলিটা আকন্দ গাছে বসে আছে। ওটাকে বলব, বুলবুলি তুই আমাদের মাথার ওপর দৌড়া।
: পাখির আবার দৌড় কিরে সন্ধ্যাতারা?
: ওদের উড়ে যাওয়াই দৌড় রে ঝরাবকুল।
: শ্বশুরবাড়িতে গেলে তুই মার খাবি।
: কেন মার খাব কেন? মা আমাকে অনেক ভালো ভালো রান্না শিখিয়েছে।
: এমন পাগলের মতো কথা বললে মার খাবি। রেঁধে বাঁচতে পারবি না।
: ঠিক আছে, তখন আমি পাগলের মতো কথা বলব না। কথা বলাই বন্ধ করে দেব। বোবা হয়ে থাকব।
: বাবা, তুই অনেক চালাক রে। আমি তোর মতো হতে পারব না।
: না পারলে মার খাবি।
: শ্বশুরবাড়ি মানে কি মার খাওয়ার বাড়ি?
হি-হি করে হাসে দুজন। বেশ অনেকক্ষণ হেসে সন্ধ্যাতারা বলে, আমি সবার মন খুশি রেখে চলব। কেউ আমাকে মারতে পারবে না।
: তুই কি নিজেকে সংসারে ডুবিয়ে দিবি?
: হ্যাঁ, দেব। দেব।
নাচের ভঙ্গিতে ঘুরতে ঘুরতে গানের মতো বলতে থাকে সন্ধ্যাতারা। বকুল ওর দিকে তাকিয়ে ভাবে, ও সবাইকে খুশি করতে পারবে না। ওরা যদি ওকে খুশি না করে তাহলে ওর কি দায় পড়েছে অন্যদের খুশি করার? প্রশ্নটা বকুলকে নিজের জন্যও ভাবিয়ে তোলে।
: কিরে তুই কী ভাবছিস?
: কিছু না। চল বাড়ি যাই।
: চল। বাড়ি গিয়ে মায়ের সঙ্গে কাজ করব।
দুই বান্ধবী যার যার বাড়িতে ফিরে যায়।
প্রাইমারি পরীক্ষায় পাস করা হলে দুজনের বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়। প্রথমে বিয়ে হয় বকুলের। ছেলে বাপের সঙ্গে খেতে কাজ করে। ধান কাটে, ঘরে ফসল তোলে। পড়ালেখায় প্রাইমারি পাস করেছে। সন্ধ্যা বিয়ের আগের দিন বকুলকে নিয়ে পুকুরঘাটে বসে গল্প করে। বকুল জিজ্ঞেস করে, বিয়ে কী রে সন্ধ্যা?
: আমি তো জানি না বকুল। আমি তো আগে বিয়ে দেখিনি।
: যেদিন ওরা সবাই এসেছিল আমাদের বাড়িতে, সেদিন লোকটাকে দেখে আমার ভয় করেছিল। কেমন ধামড়া, চ্যাপ্টা। একটুও সুন্দর না। আমাকে মারবে কি না কে জানে!
বকুলের কথা শুনে সন্ধ্যার মন খারাপ হয়, কিন্তু কিছু বলতে পারে না। লোকটাকে ও দেখেছে। একটুও পছন্দ হয়নি। এমন একটা ভোতকা-মার্কা চেহারার লোকের সঙ্গে বকুলের বিয়ে হবে, তা ও মানতে পারে না। দুজনের মাথার ভেতর চক্কর মারতে থাকে একই চিন্তা বিয়ে কী? বিয়ের অনুষ্ঠান দেখেছে। মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি যেতে হয়। তাহলে বিয়ে মানে কি শুধু শ্বশুরবাড়ি যাওয়া? হঠাৎ করে সন্ধ্যা হাসতে হাসতে বলে, বিয়ে মানে বোধ হয় একটা লোকের সঙ্গে ঘুমানো। তাই তো দেখেছি।
বকুল চুপ করে থাকে। মন খারাপ। ওই ভোতকা লোকের সঙ্গে ঘুমাতে ওর মন সায় দেয় না। সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলে, ওই লোকটার সঙ্গে ঘুমানোর চেয়ে আমার মরে যাওয়া ভালো।
: এমন কথা বলিস না ঝরাবকুল। আমাদের একই দিনে জন্ম। আমরা দুই বান্ধবী একই দিনে মরব।
: তা কী করে হবে?
: জানি না কী করে হবে। তবে আমার ইচ্ছা এমন।
: তাহলে আমরা অনেক বছর বন্ধুত্ব ধরে রাখব।
বকুল উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, আমরা ৮০ বছর বেঁচে থাকলে আমাদের বন্ধুত্ব ৮০ বছর থাকবে।
: খুব ভালো, খুব ভালো। আমাদের আশি বছরের আয়ু হোক।
দুজনে হাত ধরে লাফালাফি করে। তারপর এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে। বিয়ে নিয়ে ওদের আর চিন্তা থাকে না। ওদের কাছে শৈশব অনাবিল আনন্দের হয়ে ওঠে। শৈশবের ফুর্তি তো ওদের কাছে উৎসবের জোয়ার। দুজনে সেই আনন্দে কলকলিয়ে ওঠে। বকুল বলে, আমার শ্বশুরবাড়ি তো পাশের গ্রামে। আমি যখন খুশি তখন বাবার বাড়িতে আসতে পারব। তখন তোর হাত ধরে ঘুরব মাঠে। ধরব ফড়িং আর পাড়ব জাম-আম-বরই-জলপাই।
সন্ধ্যাও খুশিতে মেতে উঠে বলে, তোকে পেলে আমার দিনে আলো ফুটবে। আকাশের সন্ধ্যাতারা নিভে যাবে না।
: খুব সুন্দর করে বলেছিস রে। কিন্তু তোর বিয়ে কোথায় হবে সন্ধ্যাতারা? তোর শ্বশুরবাড়ি দূরে হলে আমার মন খারাপ হবে।
: আমারও মন খারাপ হবে।
দুজনে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। শুধু হাত ধরে থেকে মনের ভাব প্রকাশ করল। বোঝাল যে সব কথা ভাষায় বলা যায় না। অনুভবের তীব্রতা দুজনকে বিপন্ন করে রাখে।
কয়েক দিনের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায় বকুলের। ওর শ্বশুরবাড়ি যাওয়া কাছ থেকে দেখল সন্ধ্যা। কাঁদল নিজে নিজে। ঠিকমতো ঘুমাতে পারল না কয়েক দিন। একা একা ঘুরে বেড়ানোর কষ্ট ওকে বয়সী করে দিল। শেষে ছয় মাসের মধ্যে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো সন্ধ্যাকে। বিয়ে ঠিক হলো জলপাইগুড়ির রায়গঞ্জ গ্রামে। পঞ্চগড় থেকে বেশ খানিকটা দূরে। চাইলেই যাওয়া-আসা করা যাবে না। সে জন্য বকুলের মন খারাপ হলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল, তোর সঙ্গে আমার বছরে একবার দেখা হবে কি সন্ধ্যাতারা?
: জানি না। শাশুড়ি যদি মায়া করে তাহলে হতে পারে।
: তা ঠিক। আমাদের এখন আর এক জীবন বুঝতে হবে। আমাদের দিন আমাদের থাকল না। দুজনে আবার হাত ধরাধরি করে বসে থাকে।
আজ পয়লা বৈশাখের ভোর। হেঁটে যেতে হবে অনেকটা পথ। দুজনের মানসিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। মনে হচ্ছে হাঁটার গতি ঠিকই থাকবে। রাস্তার ধারে বসতে হবে না।
দুজনের স্মৃতির সময়ের ঝাঁপ বন্ধ হয়। দুজনে উদ্বুদ্ধ হয় সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার ধারে যাওয়ার জন্য। ওখানে আজ মিলন উৎসব হবে। বকুল আর সন্ধ্যার একসঙ্গে মনে হয় ওখানে গিয়ে দাঁড়ালে সারা বছরের অপেক্ষার সময় ফুরোয় না। কখন গিয়ে নোম্যান্স ল্যান্ডে দাঁড়াবে সেই প্রতীক্ষার প্রহর শুরু যে পাঁচ-সাত দিন আগে থেকে। দুজনেই ভাবে চৈত্রের ঘূর্ণিঝড় কি ওই কাঁটাতারের বেড়া উড়িয়ে দিতে পারে না!
প্রতিদিন যে কথাগুলো বলা হয় না, অথচ যে কথার জন্য মন উন্মুখ হয়ে থাকে তার একটি দিনের অপেক্ষায় কেটে যায় সারা বছর। সেই দিন ফুল ফোটাতে আসে। বিচ্ছেদ রুখতে আসে। ভালোবাসার সৌরভ বুকে টানার সুযোগ দিতে আসে। প্রিয় মুখের মিলনমেলায় সীমান্ত এলাকা ভরিয়ে দিতে আসে। সেই দিন বেঁচে থাকার ঘর ভরিয়ে দিতে আসে। ওই দিনটির কোনো শেষ নেই। মাঝেমধ্যে মনে হয় ছোটবেলার হাত ধরাধরি করে দৌড়ানোর সময়ের সঙ্গে এই সময় যোগ হয়েছে। আনন্দের অনাবিল স্রোত বয়ে যায় পয়লা বৈশাখের এই উৎসবে। ছোটবেলায় এই দিনে মেলা বসত। দুজনে মেলা থেকে মোয়া-মুড়ি-হাতি-ঘোড়া কিনে বাবাদের হাত ধরে বাড়ি আসত। এখন এই দিন ভাগ হয়ে গেছে। দৌড়ে বাবার বাড়ি আসতে পারে না সন্ধ্যা। ওর সামনে এখন কাঁটাতারে বেড়ার দিন। আরও আছে বন্দুক হাতে সৈন্যরা। ওদের দিকে তাকালে বেঁচে থাকা এলোমেলো হয়ে যায়। সন্ধ্যার মনে হয়, ও সীমান্ত বোঝে না। শুধু বোঝে ইচ্ছা করলেই বাবার বাড়ি যাওয়া হবে না। এদিক থেকে বকুল ভালো আছে। ওর কষ্ট শুধু বান্ধবীর জন্য। নিজের শৈশবের জন্য। ফেলে আসা দিনের স্মৃতিকে উৎসবে মেতে উঠতে দেখার আনন্দে নববর্ষের অপেক্ষা করা।
এদিকে পঞ্চগড় জেলা, ওদিকে জলপাইগুড়ি। একদিকে আছে অমরখান ইউনিয়নের অমরখান ও বোদাপাড়া গ্রাম। ওদিকে আছে জলপাইগুড়ি জেলার রায়গঞ্জ থানার ধলেপাড়া, ভিমভিটা, গোমস্তবাড়ি ও বড়ুয়াপাড়া। মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সীমান্তরেখা টানা হয়েছে। দেশভাগের সময় এই সীমান্তরেখায় টানা হয়ে গেছে ওর বেঁচে থাকা। বাবার বাড়ি পঞ্চগড় জেলার বোদাপাড়া গ্রাম। শ্বশুরবাড়ি হয়েছিল রায়গঞ্জ। গড়িয়েছে কত জল। কেটেছে কত হাজারো দিন।
একসময় অবাধে যাতায়াত করেছে। দেশভাগ হলেও মানুষ ভাগ হয়নি। যাওয়া-আসা নিয়মিত ছিল। সীমান্তের রক্ষীরা বলত, ঠিক আছে, যান। সন্ধ্যার আগে ফিরে আসবেন। এমন কথা সন্ধ্যা নিজেও শুনেছে। তখন কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। এখনো সেই কথা দুকানে জমে আছে সন্ধ্যার, যান ঘুরে আসেন। সন্ধ্যার আগে ফিরবেন। তখন সন্ধ্যা ছিল দিনযাপনের আনন্দের সময়। এখন সন্ধ্যা মানে রাতের আঁধার ঘনিয়ে তোলা। এই তো বছর পাঁচেক আগের কথা। বাবা মরে গেলেও কাঁদতে কাঁদতে যেতে পারেনি সন্ধ্যা। এই কষ্ট জীবনকে তোলপাড় করে। বান্ধবীর কষ্টের কথা শুনলে বকুলও অস্থির হয়ে যায়। এই কষ্টের জন্য পথ খোঁজার কোনো সুযোগ নেই। দুই ভিন্ন দেশের বাসিন্দা হয়ে দুই বান্ধবীর এখন দিন গোনার দিন কাটছে। ৮০ বছর জীবনযাপনে দিন গোনাও যে স্বপ্নের মতো হতে পারে, এমন ভাবনা তো যৌবন বয়স থেকে ভাবতে শুরু করে, যখন দেশভাগ হলো আর সন্ধ্যার বাবার বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি দুটো ভিন্ন দেশের দুটো গ্রামে হলো। নিজের সংসার হলো জলপাইগুড়ির রায়গঞ্জে। পাঁচ মেয়ের জন্ম হলো। বড় মেয়ে চলে গেল কোতোয়ালি থানার পরেশ গ্রামে। অন্য মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি জলাইগুড়ির বিভিন্ন গ্রামে। দেখতে দেখতে পার করেছে ৮০ বছর। গতকাল চৈত্রসংক্রান্তি গেছে। বছরের শেষ দিনে নানা কাজের খাটুনিতে ক্লান্ত হওয়ার কথা ছিল সন্ধ্যাতারার। কিন্তু নববর্ষের ভোরে টের পায় শরীরে ক্লান্তি নেই, সীমান্তের মিলন উৎসবে যাওয়ার খুশিতে ভরে আছে সবটুকু। সন্ধ্যার মনে হয়, চারদিকে ঝমঝমিয়ে শব্দ হচ্ছে। শব্দ বুকের ভেতর বাজনা বাজাচ্ছে। মাথা আলুথালু হয়ে যাচ্ছে উৎসব উৎসব শব্দে। মনে হয়, কোথাও সীমান্ত নেই। মুছে গেছে সীমানা। উড়ে গেছে কাঁটাতারের বেড়া। বুকের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সীমানাহীন এক দিন।
উৎসবে যাওয়ার জন্য সন্ধ্যা শাড়ি বের করে। নতুন শাড়ি। এই উৎসবে পরার জন্য বড় মেয়ে পাঠিয়েছে। মেয়েরা সবাই জানে, মাকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এক দিনের এই উৎসব সবাইকে নিয়ে বাড়িতেও পালন করতে হয়। মেয়েদের কথা ভাবতে ভাবতে সাদার ওপর লাল ফুলের নকশার শাড়িটা পরে সন্ধ্যা। মুখে হাসি ফুটে থাকে। উৎসব, উৎসব-বুকের ভেতরের ধুক্ ধুক্ শব্দটি ঘূর্ণির মতো চক্কর দেয়, যেন দুহাতে মথিত হবে উৎসবের আনন্দ। একজীবনে এই আনন্দের সুখ পাওয়া কঠিন। সন্ধ্যা সাদা শাড়ির লাল ফুলের নকশায় নিজের যৌবন অনুভব করে। তখন শৈশবের দিন ফুরিয়েছে মাত্র। শ্বশুরবাড়িতে যেতে হয়। পুরুষের গায়ের ছোঁয়ায় দিন বদল শুরু হয়েছে। বুঝতে পারে যেতে হবে অনেক দূর। যার সঙ্গে ঘর করেছে সে মানুষটি ভালোই ছিল। বড় ধরনের কোনো ঝামেলা হয়নি সংসারে। বকুলও ভালোই সংসার করেছে। লোকটির চেহারা খারাপ হলেও ব্যবহার ভালো ছিল। কোনো দিন বকুলের গায়ে হাত তোলেনি। উৎসবের এক দিনে কাঁটাতারের সীমান্তে বসে দুজনের এসবই গল্প হয়। দুঃখ ভোলার গল্প। শেষ দিনেরও টান আছে। বছর ফুরিয়ে যায়, বাড়িতে বসে কেঁদে বুক ভাসায় সন্ধ্যা। কেবলই ফেলে আসা দিন স্মৃতিকে জাপটে ধরে। বেদনার বালুচরে ভরে যায় চোখের জল। এক নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নববর্ষের মিলনমেলার ভালোবাসার টান এলাকার লোকজনকে মাতিয়ে রাখে। দুই দেশের সারিবদ্ধ মানুষ আসতে থাকে সীমান্তের কাছে। পাসপোর্ট-ভিসা করতে না পারার কষ্টে দূরে থাকা স্বজনদের ভালোবাসার টান ফুল ফোটায় কাঁটাতারে। এক আশ্চর্য মধুর সময় জীবনকে ভরিয়ে দেয়।
সেজো মেয়ের ছেলের হাত ধরে নোম্যান্স ল্যান্ডে পৌঁছে যায় সন্ধ্যা। কাঁটাতারের ওপাশ থেকে বকুল আসবে ওর নাতি-নাতনির হাত ধরে। আসবে আত্মীয়স্বজন। বকুল ছাড়াও সন্ধ্যার ভাইবোন, তাদের ছেলেমেয়েরা আসবে। সন্ধ্যা দেখতে পায় ওদিকের আত্মীয়স্বজন তখনো আসেনি। নাতির হাত ধরে পিলারের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায় সন্ধ্যা। কান্নার দমকে শরীর কাঁপে। যতীন জিজ্ঞেস করে, কাঁদিস কেন দিদিমা? কী হয়েছে?
: সুখের আনন্দ হচ্ছে। আজ তো সবার সঙ্গে দেখা হবে।
: নোম্যান্স ল্যান্ড কী দিদিমা?
সন্ধ্যা চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, আমার হারানো দিন।
: হারানো দিন? দিন আবার হারায় নাকি?
: হারায় সোনাভাই। ছোটবেলায় এই জায়গা দিয়ে চলে যেতে পারতাম। কেউ আটকাত না। এখন আটকায়। সে জন্য আমার দিন খুঁজে পাই না।
: সীমান্ত কী দিদিমা?
: দুই দেশের কাঁটাতার।
যতীন অবাক হয়ে চারদিকে তাকায়। দেখতে পায় কাঁটাতারের দুই পাশ থেকে এসে মানুষেরা জড়ো হচ্ছে নোম্যান্স ল্যান্ডে। এই শব্দের অর্থ জানে যতিন। আর সন্ধ্যারানী বোঝে। এই শব্দ তার গলার কাঁটা। চেপে ধরে আছে জীবন-নদীর দুই পাড়। এই নদীতে স্রোত নাই। কুলকুল শব্দ নেই। এই নদী ওর নিশ্বাস নিয়ে স্রোতে ভাসায় না।
তখন সন্ধ্যা দেখতে পায় আসছে বকুল। সঙ্গে অনেকে। প্রায় ১০-১৫ জন হবে। পেছনে আসছে সন্ধ্যার আত্মীয়স্বজন। বকুলের নাতি তাজুল লাফাতে লাফাতে বলে, ওই যে সন্ধ্যাতারা দিদিমাকে দেখা যাচ্ছে দাদি। ওই যে ওই যে, সাদা-লাল রঙের শাড়ি পরে আছে। সঙ্গে যতীনকে দেখতে পাচ্ছি। আমি ওকে লাল রঙের গেঞ্জিটা দেব।
বকুল হাত তুলে চেঁচিয়ে বলে, সন্ধ্যাতারা আমি আসছি। তুই আমার নোম্যান্স ল্যান্ডের সন্ধ্যাতারা। আকাশের তারা না রে।
: ঝরাবকুল তুই আমার নববর্ষ। নোম্যান্স ল্যান্ড তোর আর আমার দেশ। আমরা ওখানে গিয়ে পা ছড়িয়ে বসে কথা বলব।
: আয় রে সোনাবন্ধু আয়।
যতীন দিদিমার হাতে টান দিয়ে বলে, নববর্ষ তোমার জন্ম সার্থক করে দিয়েছে, না দিদিমা?
: কী বললি?
: আমি কি বলেছি তা কি তুমি বোঝনি দিদিমা? তুমি তো সারা বছর এই একটি দিনের জন্য অপেক্ষা করো। সবার সঙ্গে দেখা হলে তোমার মন ভরে যায়।
: হ্যাঁ, তুই ঠিকই বলেছিস। এই বুড়ো বয়সে নববর্ষের দিন আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
যতীন হাততালি দিয়ে নাচতে নাচতে বলে, বেঁচে থাক দিদিমা, বেঁচে থাক।
ওর হাততালি বন্ধ হয় না। ওর দিকে তাকিয়ে আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলে, তোরও তো খুব ফুর্তি দেখছি রে ছেলে—
: দিদিমার মতো নববর্ষের দিনে আমিও মজা পাই। অনেক মজা। বাংলাদেশের তাজুলের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে। ওই যে ও আসছে।
: আসছি আসছি। আম নিয়ে আসছি। আমার বন্ধুকে আমাদের গাছের আম খাওয়াব। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ কণ্ঠস্বর বয়ে নিয়ে আসে। কাঁটাতারের এপারে-ওপারে বয়ে যায় আনন্দের জোয়ার। কখনো কারও দুঃখ হয়। বলে, বড় দাদা আসেনি কেন? ওকে দেখতে খুব মন চাচ্ছিল।
: দাদাও তোর কথা খুব মনে করেছে দিদি। অসুখ তো। এত দূর হেঁটে আসতে পারবে না। তাই তো তুই দাদার দেখা পেলি না। দাদা তোর জন্য শাড়ি পাঠিয়েছে।
নতুন শাড়ি নিয়ে চোখের পানি মোছে বোন। চারদিকের এমন কথা শুনতে শুনতে সন্ধ্যা আর বকুল দুজনে দুজনের হাত ধরে। কাঁটাতারের ফাঁকে দুজনের হাত আটকে থাকে। দুজনেরই মনে হয়, উৎসবের আনন্দ-জোয়ার দুজনকে ডুবিয়ে দিয়েছে। বকুল বলে, আমাদের চারদিকে উৎসবের আনন্দের নদী বইছে। চল সাঁতার কাটি।
: বুড়া হয়েছি না। এখন কি আর ছোটবেলা আছে।
: উৎসবের জোয়ারে সাঁতার কাটার জন্য ছোটবেলা লাগে না। বুড়াকালেও হয়।
: ঠিকই বলছিস রে ঝরাবকুল।
: সন্ধ্যাতারা আয় আমরা মোয়া-মুড়ি খাই। পাটিসাপটা পিঠা—
: আমি তোর জন্য তিলের নাড়ু—
: বুঝেছি, অনেক কিছু এনেছিস। তোর পোঁটলা অনেক বড়।
দুজনের হাসিমুখে সীমান্তহীন সূর্য থেকে রোদ ঝরে। সূর্যের সীমান্ত নেই। সে জন্য একই রোদ গায়ে ছড়িয়ে থাকে। একই আলো দুজনের দৃষ্টি ছুঁয়ে থাকে। দুজনেই দুঃখ ভুলে ভাবে, জীবন অনেক সুন্দর। নববর্ষ সীমান্তবাসী সবার জীবনে ভালোবাসার দিন।
কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে দুজনে দুজনের হাত ধরে রাখে। আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যরা হা-হা হাসিতে ভরিয়ে তোলে প্রান্তর। বলতে থাকে, আমাদের নববর্ষ, আমাদের উৎসব। আমাদের নববর্ষ আমাদের মিলনমেলা। জয় হোক মিলনমেলার। জয় হোক…।
উৎসবের আনন্দ ছড়াতে থাকে দিগ্বিদিক। শুধু সন্ধ্যা আর বকুল হাত ধরে ভাবে, আমাদের জন্মের মতো মরণও হোক এক দিনে। এই মিলনমেলায় থাকুক মরে যাওয়ার আনন্দ। আমরা হাত ধরে মরতে চাই।
যতীন আর তাজুল হাত ধরে বলে, দিদিমা আর দাদিকে খুব সুন্দর লাগছে, একদম পরির মতো।