দুপুরেই শহরটার অনেকখানি উৎসবে যোগ দিতে আসা মানুষে ভরে গেল। এবার শহরের সব রাস্তায় যেতে দেওয়া হচ্ছে না। তাদের। বিগ্ৰহ থাকবে যে মাঠে সেখানেই ভিড়টা বেশি। উৎসব শুরু হতে এখনও চব্বিশ ঘন্টা বাকি। যতই চিতার পোস্টার পুলিশ ছড়িয়ে দিক, রাজনৈতিক উত্তেজনার চেয়ে ধমীয় আচারঅনুষ্ঠানের প্রতি আগ্রহগ্রামের মানুষের মনে প্রবল। কৌতূহলের ব্যাপার হল শুধু বিশেষ এক ধর্মের মানুষ নয়, উৎসবের আকর্ষণ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরও কিছু কম নয়। অন্যান্য বছর এই উৎসবে প্রচুর বিদেশিদের দেখা যেত। এ বছর সেটি বন্ধ করা হয়েছে। ভারতবর্ষের মানুষদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে আজ ভোর থেকে।
ডেভিডের পক্ষে পুলিশকে এড়িয়ে রাস্তায় হাঁটা মুশকিল। ওয়ারেন্ট তালিকায় তার নাম তিন নম্বরে। এখন দীর্ঘদিন আন্দোলন থিতিয়ে থাকবে। আকাশলাল যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা যদি শেষ পর্যন্ত সফল হয় তাহলে অন্তত তিন মাস তাকে ঘরের ভেতর আটকে থাকতে হবে। আর এই তিন মাস দেশের বাইরে সরে যেতে হবে তাদের। পরিকল্পনা সফল হতে অবশ্যই পুলিশ আর ঝামেলা বাড়াবে না। পুলিশ অসতর্ক হয়ে পড়লেই চুড়ান্ত আঘাত হানতে হবে। এসব ব্যাপার সম্ভব হবে অনেকগুলো যদি ঠিকঠাক চলে। ডেভিডের মনে এই কারণেই স্বস্তি নেই। অথচ আকাশলালকে বাদ দিয়ে আন্দোলনের কথা এই মুহুর্তে চিন্তা করা যায় না। কেউ অপরিহার্য নয় কথাটা শেষ পর্যন্ত সত্যি হলেও সময় বিশেষে মেনে নেওয়া যায় না। এটা সেই সময়।
গাছতলায় কিছু মানুষ তিনটে পাথরে হাড়ি চাপিয়ে কিছু ফুটিয়ে নিচ্ছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে গল্প করছে। কেউ কেউ। পুরুষদের সঙ্গে নারীরাও এসেছে। ডেভিড বসে গেল এই দলে। তার পোশাক এখন একজন দেহাতি খেতে মানুষের মতন।
যে লোকটির পাশে সে বসেছির তার কোলে একটি কোলে একটি শিশু ঘুমোচ্ছে। বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ডেভিড বলল, বাঃ, খুব ভাগ্যবান ছেলে তো।
লোকটা অবাক হয়ে তাকাল, কি দেখে ভাগ্যবান মনে হল?
ডেভিড হাসল, তোমার ছেলে নিশ্চয়ই।
অন্যের ছেলে কোলে নিয়ে আমি বসে থাকব নাকি। গ্রামে হলে এ দৃশ্য দেখতে পেতে না। শহরে এসে বউয়ের ডানা গজিয়েছে, তাই একঘন্টা একে সামলাতে হচ্ছে।
ডিানা গজিয়েছে মানে?
ওই যে চুড়ির দোকান, ফুলের দোকান, ওখানে গিয়েছে।
তাই বলো। তোমার ছেলের ভুরু দেখেছ? জোড়া ভুরু। এ ছেলের কপালে অনেক যশ আছে।
আর যশ! লোকটা মুখ তুলে পোস্টার দেখোল যেখানে আকাশলালের ছবির সঙ্গে পুরষ্কারের ঘোষণা রয়েছে, ওই তো কত নাম হয়েছে, কিন্তু কি হল?
ডেভিড হাসল, তোমার ছেলে বড় হলে ওই রকম নাম করুক তা চাও না?
না। আমি চাইব পুলিশ যেন আমার ছেলেকে না মেরে ফেলে!
ডেভিড মাথা নাড়ল, ঠিক ঠিক। তবে শুনেছি লোকটা নিজের জন্যে কিছুই করছে না।
লোকটা সন্দেহের চোখে তাকাল, তুমি কে হে? একথা আজ সবাই জানে।
বোকার অভিনয় করল ডেভিড। মাথা নাড়ল তারপর বিড়ি বের করে লোকটাকে একটা দিয়ে নিজেও ধারার। টুকটাক গল্প করে একসময় উঠে পড়ল সে। এই হল জনসাধারণ। সবাই আকাশলালকে পুছন্দ এবং শ্রদ্ধ করে, কিন্তু কেউ ওর সঙ্গে পথে নেমে জীবন বিপন্ন করতে চায় না। আকাশলাল নিজের জীবন দিয়ে স্বাধীনতা এনে দিলে ওরা সেটা আরাম করে ভোগ করবে, এইরকম বাসনা। গত কয়েকবছরে মানসিকতা একটুও পালটাল না। মাঝে মাঝে হতাশ হয় সে। আকাশলালকে একথা বলেছেও। আকাশ মাথা নেড়েছে, এখন ওরা একথা বলছে বটে। কিন্তু যখন সত্যিকারের লড়াই শুরু হবে তখন দেখবে এরা এই সব কথা ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমাদের সঙ্গে অত্যাচার আমাদের যেমন কষ্ট দেয়। ওদেরও তেমনি। তাই না?
কে কাকে বোঝাবে? এখন আর পিছিয়ে যাওয়ার কোনও পথ নেই।
ডেভিড ভিড় কাটিয়ে ধীরে ধীরে চলে এল শহরের একপাশে। আজ রাস্তায় দুপা যেতেই পুলিশের পাহারা। কবরখানার গেটে পুলিম নেই বটে কিন্তু রাস্তায় প্রায়ই জিপ পাক খাচ্ছে। সে শরীরটাকে একটু একটু করে দুমড়ে নিল। এই মূহুর্তে তাকে দেখলে প্রতিবন্ধ ছাড়া কিছু মনে হবে না। শরীরটাকে বাকিয়ে চুরিয়ে সে। রাস্তায় শুয়ে পড়ল। তারপর এমনভাবে গড়াতে লাগল। যাতে স্পষ্ট মনে হবে একটি প্রতিবন্ধী মানুষ প্ৰাণপণে চেষ্টা করছে রাস্ত পার হতে। সেপাই ভর্তি জিপ যাচ্ছিল সামনে দিয়ে দেখে ওদের দয়া হল। জিপটা থামল। দুটো সেপাই ডেভিডকে চ্যাংদোল করে রাস্ত পার তরে দিল। ডেভিড সেখানে পড়ে রইল যতক্ষণ না জিপটা চোখের আড়ালে চলে যায়। সে শুয়ে শুয়েই গালে হাত বোলাল। অযত্নে রাখা দাড়ির জঙ্গল তার মুখটাকে অচেনা রেখেছিল সেপাইদের কাছে।
আশেপাশে তাকিয়ে নিয়ে সে গড়িয়ে গরিয়েই রাস্তার এপাশে চলে এল। তারপর ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কবরখানার গেটে চলে এল। আজও সেখানে রোজকার মত ফুলের দোকানটা রয়েছে। ফুল কিনল ডেভিড। তারপর বিমর্ষ মুখে চুকে পড়ল কবরখানায়। লম্বা গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে শুয়ে আছে। এই শহরের কত মৃত ব্যক্তি। কোথাও আগাছ বেরিয়ে ঢেকে দিয়েছে স্মৃতিবেদি। ডেভিড চলে এল শেষ প্রান্ত সেই জায়গাটা অপেক্ষাকৃত বেশি জঙ্গলে ভরা। প্রথম স্মৃতিফলকে লেখা আছে সুরজলাল, ১৯০৮, মৃত্যু ১৯৬০। পাশেরটা সুরুজলালের স্ত্রীর। সুরুজলালের ছেলে চন্দ্রলাল শুয়ে আছে খানিকটা দূরে। তার স্ত্রীর মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে এখানে কবর দেওয়া যায়নি। এই কবরও অবস্থান একটার থেকে আর একটার দূরত্ব ডেভিডের মুখস্ত। সে পাশের খালি জমিটার দিকে তাকাল। চন্দ্রলালের বংশধর আকাশলালের জন্য ওই জমিটুকু বরাদ্দ। ডেভিড সেখানে গিয়ে দাঁড়াল। আশেপাশের ঘাস, জঙ্গল নিটোল রয়েছে। কোথাও বিকৃতির চিহ্নমাত্র নেই। জমিটার গায়েই কবরখানার পাঁচিল। শ্যাওলাধরা, অনেক পুরোনো। তারপরেই বড় রাস্তা। রাস্তার ওপাশে পুরনো দিনের কিছু অট্টালিকা।
ভাইসাব!
ডাক শুনে ডেভিড তাকাল। কবরখানার বুড়ো চৌকিদার তাঁর দিকে দাঁড়িয়ে। একে সে দেখে আসছে। বাল্যকাল থেকে। তার নিজের ঠাকুরদা, বাবা মা এবং বোনের মৃত্যুর সময় তাকে এখানে আসতে হয়েছে। না, ঠিক হল না কথাটা, বাবা মা এবং বোনের মৃতদেহ নিয়ে সে এখানে আসতে পারেন। ভার্গিসের কুকুরগুলো ওত পেতে ছিল তার জন্যে। তার ভেবেছিল সে নিশ্চয়ই আসবে। ভাবাবেগের জন্য একটা প্রতিজ্ঞ নষ্ট করতে চায়নি বলেই সে আসুন তারপর যে কয়েক বাঁ এখানে এসেছে তুর কোনও বারই সে ওদের কবরের দিকে পা বাড়ায়নি। গত কয়েকমাসে যখনই এসেছে সে তখন গভীর রাত। এ তল্লাটে মানুষ নেই। বুড়ো চৌকিদারটা বোধহয় চোখে কম দেখে, তাই সন্ধের পর নিজের ঘর ছেড়ে টহলে বের হয় না। এসব খবর আগাম পেয়েছিল সে।
জি। এগিয়ে এল ডেভিড চৌকিদারের সামনে।
আপনার হাতে ফুল কিন্তু এখনও আপনি কাউকে শ্রদ্ধা জানালেন না। বুড়ে চৌকিদার দেহাতি ভাষায় ধীরে ধীরে কথাগুলো বলল।
সজাগ হল ডেভিড, হ্যাঁ। কিন্তু কাকে দেব তা ভেবে পাচ্ছি না।
চৌকিদার অবাক হর। তার ভাজপড়া মুখে ঘোলা চোখ স্থির, আপনি ফুল নিয়ে এসেছেন। অথচ আপনার কোনও প্ৰিয়জন। এখানে শুয়ে নেই?
ঠিক তা নয়। এখানে যারা শুয়ে আছেন তাদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে দুঃখ পেয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন তাকেই ফুলটা দেব ভেবেছিলাম।
চৌকিদার হাসল, যারা চলে যায় তাদের তো দুঃখ থাকে না, যারা আও কিছুদিনের জন্যে থেকে যায় তারাই দুঃখে জ্বলে পুড়ে মরে। আপনি যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন সেখানে কারও কবর নেই। কিন্তু আমরা জানি খুব শিগগির ওখানে একটা কবর খোঁড়া হবে। রোজ সকালে উঠে আমি প্রার্থনা করি দেনটা যেন আজকের দিন না হয়।
কার কবর খোঁড়া হবে?
ওই যে দেখুন, সুরজলাল, ওখানে চন্দ্রলাল শুয়ে আছেন। চন্দ্রলালের ছেলে আকাশলালকে ধরতে পারলে পুলিশ যে পুরষ্কার ঘোষণা করেছে তা আজ একটা শিশুও জানে। এত টাকার লোভ মানুষ বেশীদিন সামলাতে পারবে না। আজ নয় কাল সে ধরা পড়বেই। ধরা পড়লে ওকে মেরে ফেলা ছাড়া পুলিশের কোনও উপায় নেই। তখন ওরা ওকে এখানে নিয়ে আসবে কবর দিতে।
ধরা পড়ার আগে আকাশলালরা যা করতে চাইছে তা যদি করে ফেলে! প্রশ্নটা করে ডেভিড বুড়োর মুখ খুঁটিয়ে দেখার। সামান্য কি আলো ফুটল সেখানে? নিজের মনেই মাথা নেড়ে বুড়ো হাঁটতে লাগর সরু পথ দিয়ে। হয়তো ও নিজেই বিশ্বাস করতে পারল না কথাটা।
বিশ্বাস তো ডেভিড নিজেও করতে পারছে না। সে আর একবার আকাশলালদের পারিবারিক জমি থেকে পাচিলের দূরত্বটা ভাল করে দেখে নিল। আকাশলালকে সে কথা দিয়েছে সব ঠিক আছে। হ্যাঁ, এখন পর্যন্ত সব ঠিকই আছে।
যদি পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় তাহলে সব শেষ হয়ে যাবে। আকাশলালকে হাতে পেলে তাদের কাজ করতে বেশিদিন দেরি হবে না। হায়দারকে বুঝতে পারে না ডেভিড। এত বেশি ঝুঁকি নিয়ে বাইরে যাওয়া তার মোটেই পছন্দ নয়। কিন্তু হায়দার তার পরামর্শ কানে তুলছে না। ডাক্তারটাকে তুলে নিয়ে এসেছে ভাল কথা, কিন্তু ডাক্তারের বউটাকে আনার কি দরকার ছিল। তাকে তো ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দিলেই হত। হটাৎ এক এক সময় তার মনের মধ্যে অন্য এক ইচ্ছের সাপ ছোবল মারে। যদি শেষ পর্যন্ত সবই ভেস্তে যায় তাহলে এত খেটে মরা কেন? দেশের স্বাধীনতা আনব বলে এই যে ঝাঁপিয়ে পড়া ও তো একটা ভাবাবেগ থেকেই। আকাশলালকে হাজার বোঝালেও সে বুঝবে না এখন। নইলে কোনও পাগলও অমন ঝুঁকি নেয় না। তাহলে?
এখন চেকপোস্টে যতই কড়া পাহারা থাক ইচ্ছে করলে সীমানা পেরিয়ে ডেভিড হয় ইন্ডিয়া নয়তো ভুটানে চলে যেতে পারে। এই দুই দেশের জনস্রোতের মধ্যে মিশে গেলে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া এমন কোনও অসুবিধের ব্যাপার নয়। কিন্তু যদি যেতে হয় তাহলে একেবারে খালি হাতে যাবে কেন? আজ যদি সে টেলিফোন তুলে খবরের কাগজকে জানিয়ে দেয় আকাশলাল কোথায় আছে, তাহলে ভার্গিস তাকে পুরস্কারের টাকা দিতে বাধ্য।
কথাটা ভাবতেই সমস্ত শরীরে কাটা ফুটল ডেভিডের। পৃথিবীটা দুলে উঠল। এ কী ভাবছে সে! চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ফেলল। জোরে। মনের ভেতর ফণা তুলতে যাওয়া সাপটা কুঁকড়ে গুটিয়ে গেল আচমকা। ভার্গিস তাকে টাকা দেবেই। কিন্তু সেই টাকা বাকি জীবন ধরে তাকে শুনে যেতে হবে জেলখানার অন্ধকারে বসে। ডেভিড জোরে জোরে পা চালাল। হঠাৎ খেয়াল হতে হাতের ফুলগুলো ছুঁড়ে দিল দুপাশে।
রাস্তায় না নেমে ফুটপাথ ধরে সাবধানে পাচিলের পেছনে চলে গেল ডেভিড। তারপর দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে মাথা নিচু করে হনহানিয়ে রাস্তাটা পার হল। সামনেই তিনচারটে ওষুধের দোকান। এই ব্যাপারটা নিয়ে সে অনেক ভেবেছ। কবরখানার পেছনে কেন ওষুধের দোকান খুলেছিল লোকগুলো। আশেপাশে তো হাসপাতালও নেই। সে ওষুধের দোকানগুলোর পাশের গুলিতে ঢুকে পড়ল। গলির মুখে যে সিগারেটের দোকানদার বসে আছে সে মাথা ঝাকাল। অর্থাৎ সব ঠিক আছে। দু-পা যেতেই ভবঘুরে মার্কা মানুষ ফুটপাথে বসে তাঁস খেলতে খেলতে তার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। এরা সবাই পাহরিায় আছে। বাড়িটা তিনতলা। বছর দশেক আগে এই বাড়িরওয়ালা কাউকে বাড়িটা বিক্রি করেছিল। সেই ক্রেতা এখানে এসে পাকা-পাকি না থেকে ভাড়া দিয়েছে- লোকে এমনটাই জানে। বেল বাজাল ডেভিড। দুবার অনেকক্ষণ ধরে। তারপর দরজা খুলল। মোটাসোটা একজন প্রৌঢ়া বিরক্ত মুখে দরজা খুলে বললেন, ও, তুমি!
ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ডেভিড জিজ্ঞাসা করল, কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো? অবশ্য হলেও আর মাত্র দুটো দিন।
হচ্ছে না। মানে? কোথাও পা রাখতে পারছি না। কোনও ঘরের দরজা বন্ধ করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে বাড়িটা যে-কোন মুহুর্তে ভেঙে পড়বে। প্রৌঢ়া গজগজ করতে করতে একটা চেয়ারে গিয়ে বসলেন।
আর দুটো দিন। তারপর যদি বাড়িটা ভেঙে পড়ে পড়ুক।
তা তো বলবেই। তোমরা তো কোথাও বাস করো না। বাস করলে জানতে সেখানে একটা মায়া আপন থেকে তৈরি হয়ে যায়। প্ৰথমে তিনতলায় যেতে পারতাম, জানলা খুললেই একটা পুকুর চোখে পড়ত। একসময় সেটা বন্ধ হল। তারপর দোতলায় যেতে পারতাম, রাস্তাটা চোখে পড়ত অন্তত। তা সেটাও বন্ধ হল। এখন এই একটা ঘর আর বাথরুম ভরসা।
আমি জানি আপনি অনেক কষ্ট করছেন। বললাম তো, আজ আর কাল। আপনাকে কাল বিকেলেই এই বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে।
আমার কিন্তু কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। পাড়ায় সবাই জানে আমার স্বামী প্রচুর টাকা রেখে গেছে বলে এত বড় বাড়ি ভাড়া নিয়েছি, কিন্তু তিনি যে কিছুই রেখে যাননি তা আমার চেয়ে বেশি কে জানে!
আমার জানি যে আপনার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কাল বিকেলে যখন উৎসবে যোগ দিতে আসা মানুষেরা ফিরে যাবে তখন আমাদের কেউ আপনাকে পৌঁছে দেবে একটা গ্রামে। সেখানে আপনি ভালই থাকবেন। ডেভিড বলল।
ভাল থাকব? আমি কিসে ভাল থাকব তা আমার থেকে তুমি বেশি জানো? আমি ছেলের সঙ্গে কথা বলব। তাকে বুঝিয়ে বললে সে ঠিক বুঝবে।
বেশ তো, আমাকেই বলুন না কিসে আপনার অসুবিধে?
কেন? ছেলের সঙ্গে আমাকে কথা বলতে দিচ্ছ না কেন?
আপনি জানেন আপনার ছেলেকে পুলিশ খুঁজছি। আপনি গেলে যদি আপনার পেছন পেছন পুলিশ হাজির হয় তাহলে তাকে আর বাঁচানো যাবে?
কি? আমি পুলিশ সঙ্গে নিয়ে যাব? চিৎকার করে উঠলেন প্রৌঢ়া।
আমি ওকথা এবারও বলিনি। কিন্তু পুলিশকে বিশ্বাস নেই। আপনি তো চান আকাশলাল সুস্থ থাকুন। চান না?
নিশ্চয়ই চাই। সে বলেছে বলেই এখানে পচে মরছি। তাকে পেটে ধরিনি বটে। কিন্তু আমাকে তো সে মা বলে ডেকেছে।
বেশ। তাহলে কাল দুপুরেই আপনি রেডি থাকবেন। ডেভিড উঠে পড়ল। এই প্রৌঢ়ার সঙ্গে কথা বলে গেলে দিন ফুরিয়ে যেতে সময় লাগবে না।
গলি দিয়ে সে আরও ভিতরে হাঁটতে লাগল। বড় রাস্তা এড়িয়ে এভাবে অনেকটা যেতে পারবে সে। দুই পকেটে হাত, মুখ মাটির দিকে। দেখলে মনে হবে সমস্যা পীড়িত সাধারণ মানুষ। এই বুড়িটার কাছে এলেই তার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। যখন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল এবং আকাশলাল ওকে আবিস্কার করে ওই বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে বসিয়েছিল তখনই ডেভিডের মনে হয়েছিল একথা। ওর বাবা ছিলেন স্কুলের হেডমাস্টার। বই আর ছাত্রদের পড়াশুনা ছাড়া কিছুই জানতেন না। স্কুলটা ছিল সরকারী এবং মাইনেপত্র ঠিক সময়ে পেতেন না। আর এই নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল না মানুষটার। সংসার চালাতেন মা। তিনি ছিলেন অমনি মোটাসোটা ভাল মানুষ। মাসের বেশ কয়েকটা দিন তাকে না খেয়ে থাকতে হত সবাইকে খাবার জুগিয়ে। তবু তিনি রোগা হয়নি। হয়তো মোটা থাকা একধরনের অসুখ ছিল তার। বাবা ছাত্রদের বোঝাতেন। পৃথিবীতে সততার কোনও বিকল্প নেই। অন্যায়ের প্রতিবাদ যে মানুষ করে না তার নিজেকে মানুষ বলে ভাবার কোনও কারণ নেই। কিন্তু ছাত্রের অভিভাবক এইসব কথাবার্তা পছন্দ করল না। সাহায্য করে যাচ্ছেন। অল্প বয়সী ছেলেদের তিনি সরকার-বিরোধী করে তুলছেন। ডেভিড তখন স্কুলের শেষ ধাপে। রবিবার গির্জায় যায়, খাবার টেবিলে বসে যে কোনও খাবার পেলেই যিশুকে উৎসর্গ করে তবে খায় বাবা মায়ের পাশে বসে। ওর বোন লিজা ছিল ভারী মিষ্টি। পনের বছর বয়সেই সুন্দরী হিসেবে পাড়ায় সে বেশ পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। বাবার কাছে পাওয়া শিক্ষা ওই বয়সে ডেভিডের চোখ খুলে দিয়েছিল। পুলিশি শাসন ব্যবস্থার তাণ্ডব যে কতখানি মারাত্মক তা সে একটু আলাদা করে বুঝতে আরম্ভ করেছিল। আর এই সময় সমভাবনায় কিছু মানুষের সঙ্গে তার আলাপ হয়। এইসব মানুষ প্রতিবাদ করতে চায়। তখন ভাবনাটা ছিল এইরকম যে, প্রতিবাদটা ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে পারলেই যেন শাসকশ্রেণী তাদের আচরণ পালটে ফেলবে। এক রাত্রে ডেভিড তার বাবার মুখোমুখি হয়। সে সোজাসুজি বলে, আপনি যে শিক্ষা দিচ্ছেন তা কি আমি জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারি?
বাবা বলেছিলেন, যা সত্য তা সবসময়ই সত্য। ক্ষেত্ৰ বদল হলেও তাঁর কোন পরিবর্তন হয় না। পরিবর্তন যে করে সে সুযোগসন্ধানী।
তারপর আর সে থেমে থাকেনি। আন্দোলনে যোগ দিয়েই তাকে বাড়ি থেকে পালাতে হয়েছিল। আর তখনই আকাশলালের সঙ্গে আলাপ। আকাশ তখন ছিল একজন সাধারণ সৈনিক। কিন্তু উপরতলার নেতৃত্বের সঙ্গে তার সংঘাত শুরু হয়ে গিয়েছিল। কোনও রকম আপিস সে মেনে নিতে পারত না। আর সেই মানসিকতাই তাকে ধীরে ধীরে নেতৃত্বের শীর্ষবিন্দুতে নিয়ে গেল। সেই সময় ঘটে গেল ব্যাপারটা।
এই শহরের অন্যতম ধনী বিধবা সুন্দরীকে সবাই ম্যাডাম বলে ডাকে। তিনি শাসনযন্ত্রের শরিক নন। অথচ তার অঙ্গুলিহেলনে এ রাজ্যে সবকিছু হয়ে যেতে পারে। ম্যাডামের ভাইয়ের ছেলে গৌতম ভার কাছেই মানুষ। কুড়ি বছরের একটা ছেলে যত রকমের উচ্ছঙ্খলতা সম্ভব সবই আয়ত্ত করেছিল। রোজ ওর নামে নালিশ আসত। থানায় অভিযোগ করলে অফিসারের ডায়েরি লিখতেন না। শহরের কোনও খবরের কাগজ এসব ছাপতে সাহস পেত না। যেহেতু দল তখন সরাসরি সরকার-বিরোধী কাজকর্মে ব্যস্ত ছিল তাই গৌতমকে নিয়ে চিন্তা করার সময় ছিল না। সেই সময়ে ডেভিড খবর পেল গৌতম তার বোনকে জিপে করে তুলে নিয়ে গিয়েছে উত্তরের পাহাড়ে। সেখানে সরকারী বাঙলো আছে ঝিলের ধারে। খবর পাওয়া মাত্র ডেভিড ছুটেছিল দুজন সঙ্গী নিয়ে। গৌতমের পক্ষে তখনও সম্ভব হয়নি বোনকে অধিকার করা। কিন্তু ডেভিড ওর পাহারাদারদের অতিক্রম করতে পারেনি। মাঝরাতে লোকগুলো বোনের মৃতদেহ নিয়ে এসে ফেলে গেল বাইরে। চিৎকার করে বলে গেল, এই হল বেয়াদবির শান্তি। ব্যাপারটা সবাই যেন মনে রাখে।
প্ৰতিজ্ঞা করেছিল। ডেভিড, গৌতমকে জ্যান্ত সেখান থেকে ফিরতে দেবে না। কথা রেখেছিল। সে পরদিন যখন গৌতম এবং তার তিন সঙ্গীর ফিরছিল তখন পাহাড়ে সোজাসুজি লড়াইয়ে নেমেছিল তারা।
গৌতমের মৃত্যুর খবর পৌঁছানো মাত্র অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। একজন অফিসারের নেতৃতে কয়েকজন সেপাই বাড়িতে হামলা চালাল। বাবা এবং মায়ের মৃতদেহ বাড়ির সামনে শুইয়ে দিয়ে তাঁরা চলে গিয়েছিল। মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল ডেভিডের। আকাশলাল না থাকলে সেই সময় সে হয়তো আত্মহত্যাই করত। আকাশলাল তার কাধ জড়িয়ে ধরে বলেছিল, তরবারির ফলায় হাত রাখলে কেটে যায় ডেভিড, ওকে কাজ করতে হলে তার হাতল ধরতে হয়। সেই সময় না। আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে হবে আমাদের। তার আগে মাথা গরম করা মানে শুধু আত্মহত্যা করা। নিজেকে সংবরণ করো।
অনেকে কষ্টে নিজেকে সামলেছিল সে। বাবা মা বোনের সমাধির সময় সে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। আর তখন থেকেই সে সরকারের ওয়ান্টেড লিস্টের তিন নম্বরে রয়ে গেছে।