এই দেখা যায় বাংলাদেশ

আবদুস সাত্তার হাঁটতে শুরু করলেন। কিছুটা পথ এগোনোর পর বুঝলেন রাত সত্যিই অনেক হয়েছে। আশপাশে মানুষজন, রিকশা বা অন্য কোনো যানবাহন কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
তার এই ভাবনা ফুরোনোর আগেই প্রায় নিঃশব্দে তার পাশে একটা পিকআপ ভ্যান এসে থামল। এমনভাবে থামল আবদুস সাত্তারের এগোনোর পথ বন্ধ হয়ে গেল। প্রথমটায় তিনি ভয় পেলেন, পরে ভ্যানের আরোহীদের দেখে তার ভয় কেটে গেল।
কী নাম? ভ্যান থেকে নেমে একজন জিজ্ঞেস করল।
জি, আবদুস সাত্তার।
এত রাতে এখানে কেন?
রাত! রাত কি বেশি হয়েছে? মাত্র দুটো দেখেছি। তাও ছোট ছোট।
দুটো মানে! দুটো কী?
আবদুস সাত্তার বুঝলেন তিনি একটা ভুল করে ফেলেছেন। এদের বায়োস্কোপ বিষয়ে কিছু বলতে যাওয়া উচিত হয়নি। এখন বোঝাতে গেলে বায়োস্কোপ ও বায়োস্কোপওয়ালা নিয়ে অনেককিছু বলতে হবে। তারপরও কি এরা বুঝবে?
কী হলো, মুখে কথা নেই যে — দুটো কী?
জি না, ওটা কিছু না?
মুখে দাঁড়ি কেন?
দাঁড়ি কই! থুতনিতে একটা ফোঁড়ার মতো হয়েছে, দাঁড়ি কামাতে পারছি না, তাই।
ওঠ। গাড়িতে ওঠ।
তাকে যে ‘তুই ‘করে বলা হচ্ছে, সেটা আবদুস সাত্তার খেয়াল করলেন না, তিনি বললেন, না না, এটুকু রাস্তা, কাছেই বাড়ি, হেঁটে যেতে পারব।
একজন লাফিয়ে নামল ভ্যান থেকে। আবদুস সাত্তারের কলার ধরে তাকে ভ্যানের কাছে টেনে নিয়ে গেল। আরেকজন তাকে টেনে তুলল। আবদুস সাত্তার এতটাই বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন, তার একবার মনে হলো বায়োস্কোপ বোধ হয় শেষ হয়নি, এখনো চলছে।

বায়োস্কোপওয়ালার কথা খুলে বলেছেন আবদুস সাত্তার। তাকে জিজ্ঞেস করছে তিনজন। তার কথা শুনে তারা হেসেছে, আচ্ছা, বায়োস্কোপওয়ালা!
জি?
কোথায় পাওয়া যাবে তাকে?
ওখানেই। আমি তো ওখানেই পেতাম তাকে।
এরপর যে তাকে ওখানে পাওয়া যাবে, তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। আছে?
জি, তা ঠিক বলতে পারব না। তবে যেখানেই তাকে দেখি, চিনতে পারব।
স্বাভাবিক। পরিচিত মানুষ …।
একদম আমার মতোই চেহারা। প্রথম যেদিন দেখলাম, তখন থেকেই চেনা চেনা লাগছিল, কিন্তূ চিনতে পারিনি। এরমধ্যেও পারিনি। কিন্তু আজ পেরেছি। এখন আমি পুরো নিশ্চিত, লোকটা আর আমার চেহারায় অদ্ভুত মিল।
গল্প লেখেন, না?
জি, এই আরকি…।
জঙ্গিদের সঙ্গে কতদিন হলো আছেন?
জঙ্গি?
আপনার ওপর কি দুটো বোমার দায়িত্ব ছিল?
আমার ওপর? আমি জঙ্গি! এসব …। আবদুস সাত্তার হাসার চেষ্টা করলেন, আমি কেন জঙ্গি হতে যাব!
তাও ঠিক। একটুপর হয়তো বলবেন, আপনি কেন জঙ্গি হতে যাবেন, কারণ দেশে তো একজনও জঙ্গি নেই।
আমি কেন এসব বলতে যাব! আমি এসবের কী জানি! আবশ্য…।
কী?
মানে, এসব তো আমার বলার কথা না, তবে প্রশাসনের সবাই এই তো সেদিনও খুব জোরগলায় বলত, দেশে একজনও জঙ্গি নেই। এখন আবার …।
এখন আবার– কী?
এখন তো দেখছি কাতারে কাতারে। রোজই এখান থেকে ওখান থেকে ধরা পড়ছে। তা, দেশে যদি কোনো জঙ্গিই না থাকবে, দুতিন মাসের মধ্যে এত জঙ্গি এলো কোত্থেকে?
সেটাই তো আপনার কাছ থেকে জানতে চাচ্ছি। বলেন, বলেন।
কী বলবে আবদুস সাত্তার! তার অবশ্য বহুদিন ধরে একটা কথা বলার ইচ্ছা। ঠিক বলার অবশ্য না, তার আসলে জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা। তিনি এর আগে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তারা সবাই হেসে উড়িয়ে দিয়েছে তার প্রশ্ন। কিন্তু তিনি আসলে সিরিয়াস! আচ্ছা, এই যে ওরা মাথায় কাপড়টা বাঁধে, সেটা কি বুলেটপ্রুফ? আবদুস সাত্তারের ধারণা কাপড়টা বুলেটপ্রুফ। কারণ তিনি জানেন, যারা গোলাগুলির মধ্যে থাকে, মাথা বাঁচানোর জন্য তাদের হেলমেট পরতে হয়। ওটা তো শক্ত প্লাস্টিকের … না না, স্টিলের বোধ হয়। তা, হেলমেট স্টিলের হলে, এই কাপড় বুলেটপ্রুফ হওয়ারই কথা। বুলেটপ্রুফ কাপড় — শুনতে অবশ্য অদ্ভুত শোনায়, তবে ক্লোনিংয়ের এই যুগে সবাই সম্ভব।
নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করার খুব ইচ্ছা হলো আবদুস সাত্তারের! তবে এখন বোধ হয় জিজ্ঞেস করা উচিত হবে না। এখন তাকে বলতে হবে, প্লিজ, বিশ্বাস করুন ভাই, আমি গল্প লিখি। গল্প ছাড়া আমি কিছুই বুঝি না।
এ কথাটাই বললেন তিনি।
ঠিক আছে, বুঝলাম গল্প লেখেন। একটা প্রমাণ পেয়েছিও যে গল্প লেখেন। এখন আরেকটা প্রমাণ দিন, এখনই, দেখি বিশ্বাস করা যায় কি না যে গল্প লেখেন।
আবদুস সাত্তার বিপদে পড়লেন। আর কী প্রমাণ দেবেন তিনি।
কী হলো, চুপ করে আছেন কেন! আপনি যে গল্প লেখেন, প্রমাণ দেন।
একটা কথা। আবদুস সাত্তার একটু মাথা চুলকে নিলেন। প্রমাণ যে কীভাবে দেব! তবে একটা কথা বলতে পারি!
কী?
আপনারা বারবার একই গল্প ব্যবহার করছেন, এটা উচিত হচ্ছে না।
মানে?
ঐ যে… ক্রসফায়ার। বারবার একই গল্প। একজন দাগি ধরা পড়ল। তাকে নিয়ে তার আস্তানায় গেলেন অস্ত্র খুঁজতে। আগে থেকে ওত পেতে থাকা তার সহযোগীরা গুলি চালাল আপনাদের ওপর। আপনারাও চালালেন, আর ক্রসফায়ারে সে মারা গেল। …এই গল্পটা বদলানো যায় না?
কী দরকার! চলছে তো।
না না, নতুন গল্প দিন। ব্যাপারটা পোক্ত করা দরকার না?
কথা দেখি বেশি বলতে আরম্ভ করেছেন!
আরে ভাই, আপনারাই না বললেন আমি গল্প লিখি কি না, তার প্রমাণ দিতে। …ধরেন, এক দাগিকে পাকড়াও করলেন আপনারা। পরদিন পত্রিকায় প্রেসরিলিজ গেল– সেই দাগি অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে আত্মহত্যা করেছে। তারপর ধরেন …।
এরকম গল্প কি অনেক আছে আপনার?
জি, অনেক।
আজ রাতে আপনাকে নিয়ে বের হবো।
আমাকে নিয়ে! আজ রাতে! কেন?
আপনার গল্পগুলো কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন, তার খোঁজ দেবেন আমাদের।
………………………………
জাহানারা জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি করে বলো, তোমার গল্প শেষ হয়েছে?
আবদুস সাত্তার মুচকি হাসলেন, হুঁ।
তাহলে হাসছ কেন?
কারণ শেষ হয়নি। …বুঝতে পারছি না।
কোথায় রেখেছ?
চেস্ট অব ড্রয়ারের ওপর।
জাহানারা সেদিকে এগিয়ে গেলেন।
আবদুস সাত্তার ডাকলেন, জাহানারা।
বলো।
হয়তো শেষই হয়েছে। তবু বলি, পড়ে দেখো তো। আমার মনে হচ্ছে, গল্পের শেষে ‘ক্রমশ ‘ বসাতে হবে।

( ‘ এই দেখা যায় বাংলাদেশ ‘ উপন্যাস থেকে। বই হিসাবে প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৬)