৭ই মার্চ স্বাধীনতার জন্মদিন, বিপুল, বিশাল বৈভবময়; ইতিহাসে তুলনারহিত, অনন্য, অদ্বিতীয়। এই দিনে জেগে উঠেছিল বাঙালি, বাংলার আকাশ, বাংলার প্রান্তর, বাংলার জনপদ, সে ছিল সহস বর্ষের সমুদ্রকল্লোল, সহস বর্ষের প্রথম সূর্যোদয়। বাঙালির জীবনে এমন দিন আর আসেনি, সে স্বপ্নে আবেগে সাহসে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে, তার মধ্যে প্রজ্জ্বলিত হয় সাহস ও বীরত্বের অগ্নিশিখা, ত্যাগ ও মহত্ত্বের ভাস্কর্য; ইতিহাসের সেই পুণ্যমুহূর্ত আমি দেখেছি। ২৫শে মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস, ৭ই মার্চ স্বাধীনতার জন্মদিন, এইদিনই জন্ম হয় স্বাধীনতার, এই ভূখণ্ড আলোকিত হয়ে ওঠে স্বাধীনতার আলোকরশ্মিতে। এ এক দুর্লভ দিন।
বাঙালির সহস্র বর্ষের আবেগ, সহস্র বর্ষের স্বপ্ন, সহস্র বর্ষের আকাঙ্ক্ষা রূপায়িত হয় এই দিনে, সেই অপরূপ অপরাহ্নে, রমনার তৃণাচ্ছাদিত সবুজ প্রান্তরে, লক্ষ কণ্ঠের জয়ধ্বনিতে, জনসমুদ্রের উত্তাল গর্জনে; সে ছিল বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত, দীপ্ত মুখরিত ভাস্বর। এই অভূতপূর্ব জাগরণের, এই অলিখিত ইতিহাসের, এই অনুচ্চারিত মহাকাব্যের প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এই অমর মহাকাব্যের তিনি কবি, এই অমর চিত্রকলার তিনি ভাস্কর, এই অনবদ্য সংগীতের তিনিই রচয়িতা, তাঁর কণ্ঠেই প্রথম ধ্বনিত হয়েছিল স্বাধীনতা, এই স্বপ্নময় সৌন্দর্যখচিত শব্দ। এইদিন, ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রমনার জনসমুদ্রে আকাশ বাতাস মথিত করে গেয়ে উঠেছিলেন এই গান, গেয়ে উঠেছিলেন বাঙালির এই বিজয়সংগীত, জেগে উঠেছিল বাংলা ভূখণ্ড, বাংলা আকাশ, বাংলা প্রকৃতি, বাংলা ইতিহাস, বাংলা কবিতা। বাংলার তেরোশত নদী, শত শত উদ্যান, হাজার হাজার শস্যক্ষেত্র সেদিন সহসা ফলে ফুলে সৌরভে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। রমনার আকাশ জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের মাথার ওপর সেদিন ঝলসে উঠেছিল একটি শব্দ স্বাধীনতা, চারটি অক্ষর স্বাধীনতা, একটি স্বপ্ন স্বাধীনতা। এই শব্দ এই ধ্বনিপুঞ্জ এই স্বপ্ন কত সহস্র বছর বুকের মধ্যে পুষে রেখেছিল বাঙালি, বাংলার মানুষ, বাংলার নর-নারী, আবালবৃদ্ধবণিতা। এইদিন জেগে উঠেছিল বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, ছাত্র, জনতা, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, গায়ক, কবি। এইদিন পাখির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল একটিই গান তার নাম স্বাধীনতা, পত্রপুষ্পে ফুটে উঠেছিল একটি চিত্র তার নাম স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার জন্য বাঙালির হাজার বছরের প্রতীক্ষা, বঙ্গবন্ধু সেই হাজার বছরের স্বপ্নের রূপকার, এই স্বাধীনতার স্থপতি, তাঁর কণ্ঠেই প্রথম বাঙালি শুনতে পেয়েছিল তার প্রিয় শব্দ স্বাধীনতা, সে যেন মহাকাব্যের এক জাগ্রত মুহূর্ত যখন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়—’এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
আন্দোলন থেকে গণআন্দোলন, গণআন্দোলন থেকে গণঅভ্যূত্থান, মিছিল থেকে মহামিছিল, মুক্তির সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতা, সে এক দীর্ঘপথ, দীর্ঘ ইতিহাস; ‘৫২, ‘৬২, ‘৬৯, ‘৭১ তিল তিল করে সঞ্চিত হয় এই স্বপ্নের উপাদান, এই সংগ্রামের উপকরণ, বর্ণে বৈদগ্ধে ত্যাগে মহিমায় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে এই ইতিহাস, যে ইতিহাসের পুরোভাগে সর্বদাই অটল অবিচল এক ইতিহাস-মানব যুগপুরুষ সাহসী কান্তিময় মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যাঁর জন্ম এই মার্চে, স্বাধীনতার এই জন্মমাসে, ১৭ই মার্চ, এ যেন ইতিহাসেরই এক পূর্বনির্ধারিত পরম্পরা, এই মাসেই জন্ম স্বাধীনতার, এই মাসেই জন্ম বঙ্গবন্ধুর, ৭ই মার্চ স্বাধীনতার জন্মদিন, ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন।
এমন কবিতা, এমন চিত্রকলা, এমন ভাস্কর্য, আর কোন জাতির জীবনে আছে, আমি ভেবে পাই না। স্বাধীনতার জন্মদিনের সেই সভামঞ্চে স্বাধীনতার মহানায়ক যখন এসে দাঁড়ালেন, যখন গগনবিদারী জয়বাংলা ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠল রমনা উদ্যান, যার তরঙ্গরাশি বিচ্ছুরিত হলো ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলব্যাপী এই বাংলায়, জেগে উঠল রবীন্দ্রনাথের হূদয়মথিত গান ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘নজরুলের নমঃ নমঃ নমঃ বাংলাদেশ মম’—এই অমর পঙিক্ত, জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’র চিত্রময় পঙিক্তমালা, তখন মুজিবকণ্ঠে ধ্বনিত কবিতা স্বাধীনতা, মুজিবকণ্ঠে ধ্বনিত স্বপ্ন স্বাধীনতা, মুজিবকণ্ঠে উচ্চারিত সংগীত স্বাধীনতা। স্বাধীনতার জন্মমুহূর্তের এই পুণ্যলগ্ন আমি দেখেছি, আমি দেখেছি বঙ্গবন্ধুর সেই উত্তোলিত বাহু, সেই উদ্ভাসিত তর্জনী, তাঁর মুখমণ্ডল থেকে বিচ্ছুরিত সেই জ্যোতিপুঞ্জ অপার্থিব অভূতপূর্ব অত্যাশ্চর্য। শত-সহস্র বর্ষের ইতিহাস, শত-সহস্র বর্ষের জলকল্লোল, সহস্র বর্ষের সংগ্রাম এসে মিলিত হয় এই রমনা প্রান্তরে, এই সবুজ উদ্যানে। আমি চোখ বুজে যখন দেখি তখন অভিভূত বিস্মিত, বিমোহিত হয়ে যাই। ইচ্ছা করে সেই সভামঞ্চ, সেই জলদগম্ভীর কণ্ঠ, সেই উদ্দাম দুর্জয় ঘোষণা, সেই মুহুর্মূহু জয়বাংলা ধ্বনির জয়োল্লাস, মানুষের সেই জেগে ওঠা, সেই সাহস, সেই জাগরণ, সেই অভ্যুদয়ের মুখোমুখি আবার দাঁড়াই; আবার তাঁকে দেখতে ইচ্ছা করে, স্বাধীনতার সেই কবিকে, স্বাধীনতার সেই চিত্রকরকে, স্বাধীনতার সেই ভাস্করকে প্রাণ ভরে চোখ ভরে আবার দেখি নির্নিমেষ অপলক দৃষ্টিতে।
আত্মবিস্মৃত বাঙালি জাতি তার পরিচয় ভুলে গিয়েছিল। বাঙালিকে জোর করে কৃত্রিম পরিচয়ে করে ফেলা হয়েছিল ‘পাকিস্তানি’, এমনিভাবে মিথ্যা পরিচয়েই বাংলাদেশকে করে ফেলা হয়েছিল ‘পূর্বপাকিস্তান’; প্রায় দু’শ বছরের ব্রিটিশ শাসনেও বাংলাদেশের নাম মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি, বাঙালি কবিদের কাছে সেতো সবসময়ই ছিল বাংলা, ‘সোনার বাংলা’, ‘বাংলাদেশ মম’, ‘হে মাতঃ বঙ্গ’, ‘বঙ্গ আমার জননী আমার ধাত্রী আমার, আমার দেশ’, তা সত্ত্বেও সেই বাংলা পাকিস্তানি শাসকদের হাতে কৃত্রিম নামে হয়ে গেল ‘পূর্বপাকিস্তান’, এই দুঃসহ পীড়ন, পেষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম, সেই সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের স্বাধীনতা দিবস ২৬শে মার্চ, তার আগে ৭ই মার্চ স্বাধীনতার জন্মদিন, প্রকৃতপক্ষে এইদিনই বাঙালির স্বাধীনতা। আমি মনে করি, স্বাধীনতা দিবসের মতোই স্বাধীনতার জন্মদিনও আমাদের পালন করা কর্তব্য; ৭ই মার্চকে স্বাধীনতার জন্মদিন ঘোষণা করে এই দিনটিকে সাড়ম্বরে আরও ব্যাপকভাবে দেশব্যাপী উদযাপনব করা উচিত, তাতে বাঙালির ইতিহাস, সেই ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার সেই জন্মক্ষণকে সুস্পষ্টরূপে মানুষের কাছে তুলে ধরা সম্ভব হবে, এই মুহূর্তটি আরও মহিমান্বিত হবে, বাঙালি চিনবে তার স্বাধীনতার জন্মদিনকে।