৪.আর বেশি দেরী নেই
ন হন্যতে ॥ চতুর্থ পর্ব
মহানগরীর রাজপথে আমি সদ্য পরিচিত ‘জন্’কে বললাম, “আমরা যখন উডল্যাণ্ডের রাস্তায় যাব তখন তুমি আমায় বোলো।” ওর ঠিকানাটা আমি সংগ্রহ করেছি, অনেক কষ্টে। দেশেই সংগ্রহ করেছি ওর ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর, এত কষ্ট করে সংগ্রহ করার দরকারই ছিল না। কিন্তু দেশে ওটা জোগাড় করাই একটা অনুষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঠিক ঠিকানা চাই আমার, এতদিন তো গরঠিকানায় ঘুরলাম কত।
গাড়ি চলেছে, নূতন দেশ, নূতন শহর, অচেনা মুখ পার হয়ে হয়ে আমার চিরপরিচিত কোনো লক্ষ্যের দিকে। আমার মন আচ্ছন্ন। আমি যেন ঘুমের ঘোরে আছি। আমার এই শরীর, আমার এত দিনের জীবন, তার সঙ্গে যে-আমি এই ঠিকানা হাতে করে বসে আছি তার দূরত্ব অনেক। এই দুইকে এক করে রাখা বড় শক্ত হচ্ছে। শক্ত হচ্ছে মনে রাখা—আমি কে।
জন্ বললে, “আমরা এইবার উডল্যাণ্ডে ঢুকলাম।”
দুপাশে কি বিস্তৃত বনশ্রেণী না শহরের বাড়ি? আমি জানি না। আমি দেখতে পাচ্ছি ছোট ছোট বাগানওয়ালা বড় বড় বাড়ি—আবার কখনো দেখছি বড় বড় গাছে ছাওয়া ছায়াচ্ছন্ন পথ উডল্যাণ্ড, কোনটা সত্য? কে জানে? একটা দৃশ্য ভিতরে, একটা বাইরে। ভিতরেরটাই সত্যতর, কারণ মনই দেখে, মনই দর্শক, আমি যে জগতে এখন বাস করছি সেটা মনোজগৎ। কতদিন কত বিনিদ্র রাত্রে এই রাস্তাটার কথা ভেবেছি যেন গাছের ছায়ায় ঢাকা বাকা পথ—যদি গাছ নাও থাকে তবু সে ভাবনাটা যাবে কোথায়? আমি চোখ অর্ধেক বুজে বসে আছি—আর উডল্যাণ্ড যেন কোন মহাশূন্য থেকে ভেসে ভেসে আসছে—টুকরো টুকরো রাস্তা, ছায়াময়।
গাড়ি থামল। মলি বললে, “অমৃতা, এই মেয়ে তোমায় নিয়ে যাবে যেখানে যেতে চাও।”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমরা কি অধ্যাপককে ফোন করেছিলে জানো তিনি কখন তার ঘরে থাকবেন?”
“করেছিলাম। কিন্তু তার সেক্রেটারী বললে তার সময়ের কোনো ঠিক নেই।”
শার্লি অল্প বয়সের মেয়ে—এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। আমরা একটা কাফেটেরিয়াতে খেতে বসলাম। শার্লি খাবার রাখল টেবিলে, আমি খাদ্যগুলো চিনতে পারছি না, ক্ষণে ক্ষণেই হাত থেকে কাটা পড়ে যাচ্ছে। শার্লি একটু বিস্মিত। রাস্তায় বেরিয়ে আমি বললাম— “থিয়োলজিক্যাল কলেজটা কোথায় জান?”
সে বললে, “এই তো একটা ব্লক পরে।”
“হেঁটে যেতে পারব তো?”
“সে কি, ঐ তো একটা ব্লক ওদিকে, পারবে না কেন?”
আমরা এগোচ্ছি, আমি গল্প করবার চেষ্টা করছি খুব সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে।
—“তুমি কারু সঙ্গে দেখা করবে ঐ কলেজে?”
“হ্যাঁ, আমার বন্ধু আছেন একজন।”
“তিনি জানেন তুমি আসছ?”
“না ”
“কতদিন পরে দেখা হবে?”
“মাত্র বেয়াল্লিশ বছর।”
“বেয়াল্লিশ বছর তোমাদের দেখাই হয় নি? তাহলে তো কেউ কাউকে চিনতেই পারবে না।”
“আমার তো তা মনে হয় না। বেয়াল্লিশ বছর এমন কি বেশি সময়? এই পৃথিবী কত দিনের পুরানো, সূর্যের জন্মের তারিখই বা কে জানে?” হঠাৎ আমার মনে হল এই স্বগতোক্তিগুলো জোরে জোরে করা উচিত হয় নি, ও কি ভাবল কি জানি। শার্লি কিন্তু বিস্মিত নয়, তার বিস্ময় অন্য কারণে। সে বলছে, “বেয়াল্লিশ বছর পর কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়াটা কি রকম আমি ভাবতেই পারি না।”
“পারবে, সময় হোক।”
“ড্রামাটিক।”
“সকলেই তো বলে জীবনটাই ড্রামা, দেখি কি রকম ড্রামা হয়।”
শার্লি বললে, “এই তো পৌঁছে গেছি।” হঠাৎ যেন মহাশূন্য থেকে জাদুকরের দণ্ড লেগে একটা সাইনবোর্ড বাগানের উপর জেগে উঠল। একটা সাইনবোের্ড মাত্র ঠিকানা লেখা, সেটা কি এত অর্থবহ হতে পারে। আমি কি হোলি গ্রেইল দেখেছি?
বাড়ির বড় দরজার কাছ পর্যন্ত আমি বাতাসে ভেসে চলেছি—শার্লি দরজাটা খুলল, পাশে প্রকাণ্ড বোর্ডে অনেকের নাম লেখা আছে। ও জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কার সঙ্গে দেখা করতে চাও?”
আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, কথা বলা অসম্ভব, আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম। “ও উনি-বিরাট মানুষ, বিখ্যাত ব্যক্তি…”
আমি এগিয়ে চলেছি, শার্লি আমার হাতের ভিতর হাত গলিয়ে ধরে নিয়ে চলেছে, কেন কে জানে? আমি কি অশীতিপর বৃদ্ধা? আমি বললাম, “ওঁর খ্যাতি কি জন্যে?”
“উনি যে মহাপণ্ডিত।”
পণ্ডিত! আমার মনটা আবার চুপসে গেল। কার সঙ্গে দেখা করতে এলাম! আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “শার্লি, উনি পণ্ডিত না জ্ঞানী?”
শার্লি হকচকিয়ে গেছে, সে বললে, “তা জানি না, আমি সামান্য ছাত্রী, ওঁকে তো চিনি না।
আমরা লিফটের কাছে এসেছি—একজন দাঁড়িয়েছিল সে বললে, “এটা প্রাইভেট লিটবাইরে থেকে যারা আসেন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়, মাত্র তো তিনতলা।”
শার্লি খুব শক্ত গলায় বললে, “লিফটের দরজা খুলুন, ইনি কাল রাতে বহু হাজার মাইল পার হয়ে এসেছেন—এক পাও সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারবেন না।”
আমি ভাবছি কেন একথা বলছে—আমি কি কাঁপছি? শার্লি আমাকে ধরে আছে লিফটের মধ্যেও। কি জানি কোথা থেকে এই ঘোর বিদেশে আমার একটা ছোট্ট মা এসেছে—আমাকে যেন কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে।
লিফ্ট তিনতলায় থামল। আমরা একটা লাইব্রেরীতে এসেছি। আমি যেন ঘুম থেকে চোখ মেলে দেখলাম—ওঃ একটা লাইব্রেরী, শুভারম্ভ, আমি লাইব্রেরী পার হয়ে একটা গলিতে পড়লাম—দুধারে ঘর—একটা ঘর পার হয়ে চলেছি, শার্লি একটু থেমে বললে, “ঐ তো অধ্যাপক আছেন ভিতরে।”
আমি ভিতরে ঢুকলাম।
ঢোকামাত্র, একেবারে সেই মুহূর্তে বৃদ্ধ ব্যক্তিটি একটা শব্দ করল, “ওহ্” তারপর উঠে দাঁড়াল, আবার বসে পড়ল, আবার দাঁড়িয়ে উঠল, তারপর আমার দিকে পিছন ফিরল। এ কি কাণ্ড! আমায় কি চিনতে পেরেছে? কি করে পারল? আমার দিকে তো তাকায় নি, এতদিন পরে কি পায়ের শব্দে চিনবে? অসম্ভব, যাই হোক এ তামাসাটা শার্লির সামনে হওয়া উচিত নয়। দরজার কাছে ফিরে এসে দেখি শার্লি চিত্রাপিতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার চক্ষু বিস্ফারিত। দুটি বৃদ্ধ বৃদ্ধার এই অভিনব সাক্ষাৎকারের একমাত্র দর্শক। আমি বললাম, “শার্লি তুমি চলে যাও একটু পরেই আমি তোমার কাছে আসছি।”
আমার মন এখন শান্ত, স্থির, কোনো উত্তেজনা নেই, যা করবার ছিল করা হয়েছে। “এই বিরাট শহরে আজ তোমার প্রথম দিন, পথ হারাবে না তো?”
“না না, পথ হারাব না।” মনে মনে বলছি এতদূর যখন পৌঁছতে পেরেছি সময়ের মহাসিন্ধু পার হয়ে তখন মহাজগতেও আর আমি পথ হারাব না।
দরজার কাছ থেকে ফিরে মির্চার কাছে আর পৌঁছতেই পারি না, ঘরময় বই ছড়ানো, বইয়ের পর্বত চারদিকে, ঘরের ছাদ পর্যন্ত। আমার কেমন যেন গা ছমছম করছে, আমার হাত পা কাঁপছে শীত নয় ভয়ে। শুনেছি পাথর চাপা পড়ে সুকুমার জীব জীবাশ্ম হয়ে যায়, ওর তেমন কিছু হয়নি তো?…আমি ওকে দেখছি—মাথায় একেবারে চুল নেই, ঘাড়ের কাছে পাকা চুল–তেমনি পাতলা চেহারা—আর তেমনি চঞ্চল— একবার টেবিলের উপর থেকে কাগজ তুলে নিচ্ছে—আবার রেখে দিচ্ছে। ওর পাতলা শরীর যেন বাতাসে কাঁপছে।
“মির্চা তুমি মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন?”
“তোমায় আমি দেখব না, আমি অন্য লোকের জন্য অপেক্ষা করছি।”
“কার জন্য অপেক্ষা করছ, কার জন্য?”
“একজন ইনকাম ট্যাকস অফিসারের জন্য।”
“ইনকাম ট্যাকস অফিসার?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ।”
“বোকামি কোরো না মির্চা, জান আমি কে?” ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে যাচ্ছি, “চিনতে পেরেছ আমায়? জানো কে আমি, কে আমি?”
“নিশ্চয়, নিশ্চয়, (সার্টেনলি, সার্টেনলি)” ও মাথা নাড়ছে, এ যে সে-ই মির্চা একেবারেই সেই তেইশ বছরের ছেলে, ওর তেষট্টি বছরের মধ্যে সে-ই বসে আছে, আমাকে ও বলত, “তুমি ‘ভীষণ’ কথাটা খুব ব্যবহার কর—সব কিছুই তোমার ‘ভীষণ’।” ওকথা আমায় আরো অনেকে বলেছে, আমি হয়ত আজও ওরকম বলি, ও যে রকম “সার্টেনলি, সার্টেনলি” বলে মাথা নাড়ছে। কি মহারহস্য,কি অপার বিস্ময়—আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে এই তো ওকে চিনতে পারলাম। সে এই—সে এই, অন্য কেহ নয়—আর আমি? আমি কে? আমিও সে, ‘অক্ষয় তার সপ্তদশী মন করতে পার আজো অন্বেষণ’—“বলো বলো আমি কে, বলো তবে।”
“তুমি অমৃতা। যে মুহূর্তে তুমি এদেশের মাটিতে পা দিয়েছ সেই মুহূর্তে জেনেছি আমি।…”
“কি করে জানলে?” নীরবতা।
“বল, বল, বল না।”
“হুঁ, এড্ বলেছে।”
“এড জানতই না আমি কবে আসব।”
“Well, I knew—আমি জানতে পেরেছি ব্যাস্।”
“ফের, ফের, প্রিয়তম মির্চা, আমি কতদূর থেকে এসেছি তোমাকে দেখব বলে, তুমি ফিরবে না, আমায় দেখবে না?”
“শোনো অমৃতা”, সে তার অস্থির হাতটা দিয়ে বইয়ের তাকটা ধরে আছে—যেন তা হলে পড়ে যাবে—“শোনো বলি সমস্ত ব্যাপারটাকে আমি অন্যভাবে দেখেছি–আমি তো বলছি না আমারটাই ঠিক। হয়ত তোমারটাই ঠিক, হয়ত কেন নিশ্চয়ই তোমারটাই ঠিক।”
“আমার চিঠির উত্তর দাও নি কেন? চিঠি পেয়েছিলে?”
“হ্যাঁ ছোট, দুচার লাইন।”
“তা হলই বা, উত্তর দিলে না কেন? ভদ্রতাও তো আছে।”
“ভদ্রতার কথা কে ভাবছিল?” তারপর একটু থেমে, “ঐ তো বলছি আমার সেই অতুলনীয় অভিজ্ঞতা এত সুন্দর যে আমি ভাবি নি আর তাকে স্পর্শ করা যায়—তাই তোমাকে আমি দেশকালের অতীত করে রেখে দিয়েছি।”
“আসল কথা তুমি ভেবেছিলে আমি আমার নূতন জীবনে তোমায় ভুলে গিয়েছি।”
“না না না অমৃতা, একবারের জন্য এক মুহূর্তের জন্য ভাবি নি তুমি আমায় ভুলতে পার।” ও একটা বই তাক থেকে নামিয়ে ফেলল, “শুধু আমি জানতাম না যে তুমি আমায় দেখতে চাও–”
“কেন?”
“আমরা তো জানি কত সুন্দর জিনিস আছে, সুমেরু শিখর আছে, তুষারমৌলি হিমালয় আছে, আমরা কি যেতে পারি? জানি তারা আমারই আছে তবু কি পেতে পারি? তাই বলে সেটা ভোলা নয়, সে আমার গোপন বিশ্বের গোপনতম সত্তায় লগ্ন সুন্দরতম স্বপ্ন।”
“এই তো পারলাম আমি, এই তো এলাম।”
“তুমি যে অমৃতা, indestructible অমৃতা তুমি যা পার আমি কি তা পারি? তোমার সংস্কৃতি কত হাজার বছরের পুরানো, তোমার ইতিহাস আর আমার এক তো নয়—অমর ভারতের—”
“তাই নাকি? আমি তো শুনলাম তুমিও ভারতীয়?”
“ওঃ হা, আমি তো সকলকেই বলি আমি ভারতীয়।”
“আমি এ সব কিছু শুনতে চাই না, তুমি ফের মির্চা আমি তোমায় দেখব আজ।”
ও দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু স্থির নয়—আমাদের মধ্যে অন্তত তিন গজ ব্যবধান, আমি জোরে জোরে কথা বলছি—আমাদের তো বয়স অনেক, কানের জোর নিশ্চয় কম।…ওকে উদভ্রান্ত মনে হচ্ছে।
“কি করে তোমাকে দেখব আমি? দান্তে কি কখনো ভেবেছিল তার বিয়াত্রিচেকে এই শরীরের চোখে আর দেখবে?”
আমিও কাঁপছি, ওর পাগলামি দেখে আমার রাগ হচ্ছে। এ লোকটি ঠিকই এক অবাস্তব জগৎ সৃষ্টি করে তার মধ্যে বাস করছে। কোথা থেকে দান্তে বিয়াত্রিচে নিয়ে এল—“স্থান কালের অতীত আবার কি? আমি কি ভূত হয়ে গেছি নাকি? কোন স্বপ্নজগতে কল্পনার ধোয়াটে স্বর্গে বাস কর তুমি মির্চা? আমি এই বাস্তব জগতের রক্তমাংসের অমৃতা, তোমার পড়ার ঘরে দাঁড়িয়ে আছি। এটা সত্য। এ সত্য তোমাকে স্বীকার করতে হবে। তোমার পলায়নী মনোবৃত্তি ছাড়ো তো।”
“কি করে কি করি আমি অমৃতা, তোমার যে স্বামী আছেন, আমারও স্ত্রী আছেন, এখন. কি বলি বল?”
আমি বিস্মিত, হতবাক। মির্চা বলে কি?
“–মির্চা, তুমি এত পড়লে তোমার প্রজ্ঞা হল না? প্রেম কি একটা বস্তু যে তুমি একজনের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে অন্যকে দেবে? একি বিষয় সম্পত্তি? সোনার গয়না? এ তো একটা আলো মির্চা, একটা আলো। যেমন বুদ্ধির আলো, জ্ঞানের আলো, তেমনি প্রেমের আলো। বুদ্ধির আলোরও সীমা আছে, তার একটাই ক্ষেত্র, কিন্তু প্রেমের আলো সবচেয়ে জ্যোতির্ময়, তা সব কিছুর সত্যরূপ দেখায়—এ আলো জ্বললে ত্রিভুবন প্রেমময় হবে—অপ্রিয় প্রিয় হবে—তুমি বিশ্বাস কর মির্চা তোমাকে মনে পড়বার পর আমার স্বামী আমায় কাছে প্রিয়তর হয়েছেন, এতো ভালো তাকে আগে কখনো বাসি নি। বিশ্বাস করবে তুমি?”
ও ঘাড় নাড়ছে “নিশ্চয় নিশ্চয়, সত্য সত্য-”
“কি সত্য?”
“তুমি যা বলছ তা ধ্রুব সত্য, তুমি সব সময়ই নির্ভুল সত্য বল।”
“হ্যাঁ, সত্যের পরে মন, আমি করেছি সমর্পণ। তাই তো আমি সত্যকে স্বীকৃতি দিতে এসেছি। কাজটা সোজা হয় নি মির্চা, সংসার, সমাজ, আত্মীয়স্বজন, পুত্রকন্যা সকলের সামনে সম্মানের উচ্চাসন থেকে মাটিতে নেমে আসা। কেউ কেউ হয়ত ভাবছে আমার ভীমরতি হয়েছে। আরো বেশি লোক যখন জানবে কি ভাববে তারা আমাদের দেশ তো জানো? আমার গায়ে ধুলো দেবে। বেয়াল্লিশ বছর পর তোমায় দেখতে আসা কি সোজা কথা!”
“একেবারেই নয়, আমি তো কিছুতে পারতাম না। কতবার আমার স্বপ্নের ভারতে যাবার সুযোগ এসেছে আমি যাই নি কি করে যাব ওখানে?”
“কেন আমি আছি বলে?” ও মাথা নাড়ছে—“তাই তো…”
“আর আমি তো তুমি আছ বলেই এলাম। আমি এত সাহস কোথা থেকে পেলাম বলত?”
“আমিও তো তাই ভাবছি, কোথা থেকে পেলে?”
“গান্ধীজীর কাছ থেকে। আমি ভাবলাম উনি যদি পারেন আমি কেন পারব না? আর তাই যদি না পারি তবে ওঁর মৃত্যুদিনে বক্তৃতা করে কি হবে! আমি খুব বক্তৃতা করি তো।”
“গান্ধী কি এত বড় হয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, উনিশ শ’ ত্রিশে তুমি ওকে যা জানতে তার চেয়ে অনেক বড় হয়েছিলেন। উনি যে মানুষের কাজে নেমেছিলেন, শুধু তো পুঁথি পড়ছিলেন না।…তাই তো তোমায় জিজ্ঞাসা করছি, তোমার বইতে ও কি চরিত্র এঁকেছ আমার, ওখানে তো আমাকে পেলাম না আমি।”
“ফ্যাণ্টাসী, ফ্যাণ্টাসী, তোমাকে আমি রহস্যময়ী এক দেবী করতে চেয়েছিলাম যার কাজের কোনো ব্যাখ্যা নেই। অঘটনঘটনপটিয়সী কালীর মতো।”
“খবরদার আমাকে কালীর সঙ্গে তুলনা করবে না…চিরকাল তোমার এই…আমি এত কি কালো?…”
“আচ্ছা, আচ্ছা, দুর্গার মতো, যে অসম্ভব কাজ করতে পারে; inscrutable, এক হাতে অস্ত্র, অন্য হাতে বরাভয়-an enigma, the enigma that you were.”
“আমি তোমায় বলছি ফ্যাণ্টাসীর সৌন্দর্য আছে, সত্যের সৌন্দর্য উজ্জ্বলতর, কিন্তু অর্ধসত্য ভয়ঙ্কর। তোমার বইটা তাই আমার কাছে বিভীষিকা। তাছাড়া আমি খুব সহজ সরল একটা ছোট মেয়ে ছিলাম মির্চা, মাঝে মাঝে দার্শনিকের ভান করতাম এই পর্যন্ত, রহস্যটা তোমার সৃষ্টি—তুমি রহস্য ভালোবাস। কিন্তু এবার আমি অসম্ভব কাজ করতেই এসেছি–”
ও পিছন ফিরে আছে, আমি ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছি—আমার অন্তর নিষ্কম্প, স্থির-ওর এই রহস্যের ঘোর আমি কাটাব—এই বাস্তব পৃথিবীর মাটিতে আমরা পরস্পরকে দেখব।
“প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।”
মির্চা ফিরল না, ওর মাথা নিচু কিছুতেই ফিরছে না।
“কি চাও তুমি অমৃতা?”
“শান্তি, তোমার কাছে শান্তি চাই আমি।”
“হাঃ হাঃ হাঃ” ও পাগলের মত হাসছে। “তোমাকে আমি কি করে শান্তি দেব যখন আমার নিজেরই শান্তি নেই? How can I give you peace when I have no peace in me…”
কি হবে, ভয়ে আমি উতলা—ওর মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল নাকি? এত সুন্দর এত গভীর এত পরম সত্যকে ও স্পর্শ করতে পারে না? হঠাৎ আমি বললাম—“মির্চা তুমি যে কী চমৎকার পিয়ানো বাজাতে, বাজাও তো এখনো?”
“না না, সে কবে ছেড়ে দিয়েছি।”
“কেন?”
“কী দরকার, সময় নষ্ট—“
আমি ভাবছি কি দিয়ে ও বাজাবে সঙ্গীত, ওর আঙ্গুলগুলোই যে বইয়ের মলাটের মতো শক্ত, সেখানে শিরা-উপশিরা শুকিয়ে গিয়েছে—হবে না আর হবে না, সেই মাধুরী ছাপিয়ে আকাশ আর ঝরবে না।
“মির্চা, এই যে আমি তোমার ঘরে এসে পঁড়িয়েছি রক্তমাংসের মানুষ, আমি কোনো সিম্বল নয়, মিথ নয়, আমি একজন সুখদুঃখকাতর অপার সম্ভাবনাময় মানুষ। বিয়াত্রিচে ভূত হয়ে স্বর্গে গিয়েছিল, সেখানে দান্তের সঙ্গে দেখা হল কিন্তু আমি যে এই জীবনে এলাম এটা কি কিছুই নয়!”
ও পিছন ফিরেই বলছে, একটু হাঁপাচ্ছে—“বিস্ময়! কি পরম বিস্ময়, সত্যই তো, আমি তো তাই পেসিমিস্টদের বলি, জীবনের কি অপার সম্ভাবনা কে জানে, কে জানে কি হতে পারে। কোনো দিন ভাবি নি তোমাকে দেখব?”
“তবে ফের।”
মির্চা ফিরল। কিন্তু মুখ তুলছে না, মুখ নিচু করে আছে—আমাকে দেখবার জন্য এখনও প্রস্তুত নয়। আমি মিনতি করছি, “কেন তুমি আমার দিকে দেখছ না? তুমি যে তোমার বইতে লিখেছ, যে দিন আমার সঙ্গে দেখা হবে আমার চোখের দিকে তাকাবে, সে কথা ভুলে গেলে?”
“সে তো অনেকদিন আগের কথা। চল্লিশ বছর, হায় চল্লিশ বছর।”
“জান লোকে আমায় জিজ্ঞাসা করে কতদিন তুমি আমাদের বাড়িতে ছিলে আমার মনে পড়ে না—কতদিন ছিলে বল তো?”
“হাজার বছর—”
“তবে? তবে তুমিও কি জান না তুমি কে, আমরা কি? আমি তো সেই তোমাকেই দেখতে এসেছি যাকে weapon cannot pierce, fire cannot burn-শস্ত্র ছেঁড়ে অগ্নি দহে না যারে–”।
ও সংস্কৃততে বললে, “ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে—”
“তবে? সে-ই তুমি, যার আদিও নেই অন্তও নেই–নান্তং ন মধ্যং ন পুনস্তবাদিম–সেই তোমাকেই আমি দেখতে চাইছি—আমার দিকে একবার তাকাও। বিশ্বাস করো, এক মুহূর্তে তোমায় চল্লিশ বছর পার করে দেব-দেখবে আমরা সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি যেখানে প্রথম দেখা হয়েছিল। আমার দিকে তাকালেই তুমি অমর হবে মির্চা, অমর হবে।”
মির্চা মুখ তুলল।…আমি দেখলাম ওর চোখের দৃষ্টি স্থির। কি সর্বনাশ! যা ভয় করেছিলাম তাই হয়েছে—ওর চোখ দুটো পাথর হয়ে গিয়েছে। ও আর কোনো দিনও আমায় দেখতে পাবে না। কি হবে! কি হবে! হা ঈশ্বর উপায় কি! ও চোখে আমি তো আর আলো জ্বালতে পারব না। আমার হাতে তো প্রদীপ নেই—এত পথ চলতে চলতে কখন যে তেল ফুরিয়ে সলতে পুড়ে নিবে গেছে। ভয় পেয়ে আমি আর অমৃতা নেই—একজন মরণশীল মানুষ হয়ে গেলাম। ওর মতো ভাবতে লাগলাম—হায় চল্লিশ বছর–বড় যে দেরী হয়ে গেল—একটা বুকভাঙ্গা কষ্ট দীর্ঘনিঃশ্বাস হয়ে ঘরের মধ্যে পাক দিয়ে ঘুরছে, এবার আমি পিছন ফিরলাম। ঐ দরজার কাছে পৌঁছতে হবে। ঐ পিতলের হ্যাণ্ডেলটা ঘুরাতে হবে—তারপর দরজা খুলবে। আমি ঐ একই পথে হেঁটে হেঁটে শার্লির কাছে যাব। বইয়ের পাথর ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে চলেছি হঠাৎ পিছন থেকে মির্চার গলা শুনতে পেলাম—যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসছে–
“একটু দাঁড়াও অমৃতা—why are you breaking down now when you were so brave for so many years—এতদিন এত সাহস দেখিয়ে এখন তুমি ভেঙে পড়লে কেন? আমি বলছি আমি যাব তোমার কাছে, এখানে নয়, সেখানে গঙ্গার তীরে আমার সত্যস্বরূপ তোমাকে দেখাব, I will show you my real self on the shores of the Ganges…”
আমি নৈরাশ্যবাদী নই তাই এতক্ষণ আমার ভাঙ্গা বুকের মধ্যে আশার একটা টুনটুনি পাখি ডানা ভেঙে পড়ে ধুকধুক করছিল। মির্চার কথাটা কানে আসা মাত্র একটা কাণ্ড হল। সেই ছোট্ট পাখিটা হঠাৎ ফিনিক্স হয়ে গেল—ফিনিক্স পাখি কেউ দেখেছ? ঠিক এ্যালবাট্রস-এর মতো দেখতে—সেই বিরাট খগেন্দ্র তার শুভ্র বিপুল পক্ষ দুটি বিধৃনিত করে আমাকে নিয়ে ঊর্ধ্বগামী হল, আর তখন ওর পড়ার ঘরের ছাদটা প্যাণ্ডোরার বাক্সর মতো খুলে গেল—দেওয়ালের বাধা চলে গেল, আর বইয়ের পাথরগুলো জলের ঢেউ হয়ে গেল, আমি জলকল্লোল শুনতে পেলাম।
আশার মায়ায় গড়া সেই ব্যাবৃতপক্ষ মহাপক্ষী লেক মিশিগান পার হয়ে অজ্ঞাত মহাদেশের দিকে যেতে যেতে আমায় বললে—“কোনো ভয় নেই অমৃতা, তুমিই ওর চোখে আলো জ্বালবে।”
আমি ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কবে? কবে?”
সে বললে,“যে দিন ছায়াপথে তোমাদের দেখা হবে, তার তো আর বেশি দেরী নেই–”