একজন মানুষের গল্প

অনেকদিন আগে শঙ্খনীল কারাগার নামের একটি বই লিখেছিলাম। সেখানে ভালোবাসাবাসি ছিল, চোখের জল ছিল, কাজেই মেয়ে মহলে ‘লেখক’ নাম হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, বারো বছরের এক মেয়ে একটি চিঠি লিখে ফেললো। চিঠি পেয়ে সরাসরি উপস্থিত হলাম ভক্তার বাড়িতে। ভাবখানা এরকম যেন মুখোমুখি বসে আধুনিক সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞান দিয়ে আসব। মেয়ের মা দরজা খুলে দিলেন। এক মধ্যবয়স্ক লোক এসেছে তাঁর মেয়ের সঙ্গে গল্প করতে এই শুনে তাঁর ছোটখাট একটা স্ট্রোকের মতো হলো। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে কড়া গলায় বললেন, “আমার মেয়ের সঙ্গে কী দরকার তা পরিষ্কার করে বলেন।” খুবই সঙ্গিন অবস্থান। আমি কুল কুল করে ঘামছি, এদিক ওদিকে তাকাচ্ছি। হঠাৎ দেখি মেয়েটি হাত ধরে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিয়ে আসছে। মেয়েটি হাসিমুখে বললো, “আমার দাদাকে আপনি কি চিনতে পারছেন?” প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। প্রথম পরিচয় অবশ্যি খুব সুখকর হয়নি। ইবরাহীম খাঁ সাহেব [খুব সম্ভব আমার চক্রকাটা লাল রঙের সার্টের জন্যেই] আমাকে খানিকটা সন্দেহের চোখে দেখলেন। আমাদের মধ্যে এই ধরনের কথাবার্তা হলো। “আমার কোন বইপত্র কি পড়েছ?” ‘জি্ব হ্যাঁ।’ “দুই একটার নাম বলতে পারবে [গলার স্বরে সন্দেহের আভাস?]” “আমি নছর পেয়াদা পড়েছি, আমাদের পাঠ্য ছিল।” “পাঠ্যের বাইরে কিছু পড় নাই?” “বাতায়ন পড়েছি।” “প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত?” “জি্ব”। খাঁ সাহেবের ভ্রূকুঞ্চিত হলো। বিশ্বাস করলেন বলে মনে হলো না। “কেমন লাগলো বাতায়ন?” “প্রথম অর্ধেক চমৎকার!” “বাকি অর্ধেক?” আমি চুপচাপ [খাঁ সাহেবের ঠোঁটের কোণে হাসির আভাস]। “আমার ধারণা ছিল আজকালকার ছেলেরা আমার মতো বড়দের লেখা পড়ে না।” “আপনার ধারণা ঠিক না। আমরা ঠিকই আমরাই পড়ি, আপনারাই পড়েন না। খাঁ সাহেব গম্ভীর হলেন। চশমা খুলে চশমার কাচ মুছতে লাগলেন। আমি সাহস করে বলে ফেললাম_ “আপনি নিশ্চয় হুমায়ূন আহমেদের কোন বই পড়েন নাই।” খাঁ সাহেব থমথমে গলায় বললেন, “হুমায়ূন আহমেদ কে?” “আমি। আমার নাম হুমায়ূন আহমেদ।” খানিকক্ষণ চুপচাপ কাটল। তিনি চশমা চোখে পরলেন। তীক্ষষ্ট দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। এক অসম বন্ধুত্বের সৃষ্টি হলো সেদিন [৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪ সন]। একদিকে নিবেদিতপ্রাণ ইবরাহীম খাঁ, সাহিত্য যার প্রাণপাখি, অন্যদিকে এক যশলিপ্সু তরুণ, সাহিত্য যার কাছে এক ধরনের জীবন বিলাস। আজকের এই লেখা নিবেদিতপ্রাণ ইবরাহীম খাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি। বাড়ির নাম দখিন হাওয়া। নাম শুনলেই মনে হয় সারাক্ষণ উথাল পাথাল বইছে। আসলে কিন্তু সে রকম নয়। পুরানা ধরনের দোতলা বাড়ি। একটু যেন গুমোট ভাব। সে বাড়ির সমস্ত হাওয়ার উৎস এক সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ চোখে ভারি পাথরের চশমা নিয়ে সারাদিন বাইরের ঘরে চুপচাপ পড়াশুনা করেন। বসার ঘরটি বড়ই সাদামাটা। মেঝেতে কার্পেট নেই। দেয়ালে কার্পেটের সঙ্গে রং মেশানো পেইনটিং নেই, ভারি-ভারি সোফা নেই। কাঠের একটি টেবিলের সামনে কয়েকটি চেয়ার, বাঁ পাশে একটি লম্বা বেঞ্চ। আসবাবের মধ্যে এই। সবচে যা দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হচ্ছে দেয়ালের একটি লেখা : অল্প কথায় কাজ সেরে বিদায় হন যিনি তাঁকে অনেক ধন্যবাদ, কাজের লোক তিনি। _ মাতু মিয়া
লেখায় কাজ হয় না কিছু। যে আসে সে আর উঠতে চায় না। আর উঠবেইবা কেন? বাড়ির দখিন দুয়ার সবার জন্যে খোলা। যেই আসে তাঁকেই হৃদয় খুলে অভ্যর্থনা : বাড়ি কোথায়? কোন গ্রাম? কোন থানা? ছেলেমেয়ে কটি? কী নাম, কোথায় পড়ে? সবশেষে অতি বিনীত ভঙ্গিতে বলবেন, “কী করতে পারি আপনার জনাব?” বিনা প্রয়োজনে কেউ তেমন আসে না। বেশির ভাগই সাহায্যপ্রার্থী; দরিদ্র ছাত্র, বেতন দিতে হবে, পরীক্ষার ফিস দিতে হবে। দরিদ্র লেখক; জীবনধারণ করতে পারছেন না। কেউ সাহায্য চেয়ে তাঁর কাছ থেকে খালি হাতে ফিরে গেছে_ এমন অপবাদ তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রুও তাকে কোনদিন দেবে না। তাঁর টেবিলের ড্রয়ারে গাদা করা থাকত মনিঅর্ডার ফরম। মাসের প্রথম তারিখে নিজের হাতে লিখতেন সেসব। অধিকাংশই দুঃস্থ কবি-সাহিত্যিকদের জন্যে। মনি অর্ডারে টাকা যারা পেতেন তাঁরা টাকার সঙ্গে বাড়তি পেতেন লিমেরিক জাতীয় রচনা। মনিঅর্ডার ফরমে সুন্দর করে লেখা। স্কুল-কলেজের ব্যাপারে সাহায্যপ্রার্থীর সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। অমুক স্কুল মঞ্জুরি পাচ্ছে না, অমুক কলেজের ফান্ডে টাকা নাই, অমুক জায়গায় নতুন কলেজ হবে, তিনি গিয়ে একটা বক্তৃতা দিলে বড় ভালো হয়। মেয়েদের একটা স্কুল দেয়া হবে, লোকজন খুব বিরোধিতা করছে। তিনি যদি একটু দেখেন। অসীম ধৈর্য নিয়ে শুনছেন সবকিছু। একটা জবদা খাতায় নোট লেখা হচ্ছে। এই অশক্ত শরীর নিয়ে গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এতটুকু বিরক্তি নেই মুখে। রসিকতা করছেন ক্রমাগত। উদাহরণ দেই। ভুয়াপুর কলেজের কাজে গিয়েছেন। ভাদ্র মাসের গরম। সমস্ত দিন সভা-সমিতি- মিটিং শেষে ক্লান্ত-বিরক্ত হয়ে দখিন হাওয়াতে ফিরে এসেছেন। এসে শুনলেন এক ভদ্রলোক দুপুর থেকে বসে আছেন। তক্ষুনি গেলেন দেখা করতে। ভদ্রলোকের ছেলেটি কলেজে ভর্তি হতে পারছেন না। তার একটা ব্যবস্থা করে দিতেই হবে। ইবরাহীম খাঁ সাহেব বললেন_ “আপনার ছেলেটিতো শুনেছিলাম গুণ্ডামী করে বেড়ায়। এখনো সেই রকম নাকি?” “নাহ্ প্রিন্সিপ্যাল সাহেব, সেই ছেলে আর নাই। এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। তাহাজ্জতের নামাজ পড়ে। দিনের মধ্যে ৭/৮ ঘণ্টা মসজিদেই থাকে।” ইবরাহীম খাঁ খানিকক্ষণ গম্ভীর থেকে বললেন, “হুঁ, জোয়ান ছেলে। বলছেন দিন রাত মসজিদেই থাকে। অবস্থা তো জনাব আগের চেয়েও খারাপ। কোন রকমে আগের মতো করা যায় না?” যে সময়ের কথা লিখছি সে সময় তাঁর বয়স আশির কোঠায়। বৃদ্ধ বয়সের ব্যাধি_ ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেসারে কাবু হয়েও জীবনকে বাঁধলেন ঘড়ির কাঁটায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা_ ভাগ ভাগ করা কখন কী করবেন। ভোর বেলা হাঁটতে বের হন। সে সময় পাড়া-প্রতিবেশীদের খোঁজ নেন। কে কোথায় আছে, কী করছে_ সব জানা চাই। হাঁটাহাঁটির পর মেয়ের বাড়ি যান ইনসুলিন নিতে। সেখানে নাস্তা শেষ। দখিন হাওয়ায় ফিরে পরের তিন ঘণ্টা হচ্ছে লেখার কাজ। সে সময় তাঁকে কিছুতেই বিরক্ত করা চলবে না। উদাহরণ দেই। আমি বসে আছি তাঁর ঘরে। জনৈক সরকারি কর্মচারী এসেছেন। খাঁ সাহেবের সঙ্গে উঁচুদরের কে যেন দেখা করতে চান। [খুব সম্ভব তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী; বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত কী একটা ব্যাপার।] খাঁ সাহেব বললেন, “যে সময় যেতে বলছেন সে সময়টা আমার লেখার সময়, যাওয়া সম্ভব নয়।” “খুবই জরুরি লেখা কি?” “[মুখে মৃদু হাসি] জনাব আমার সব লেখাই আমার কাছে জরুরি।” ১৯৭৬ সালের এপ্রিল মাসে আমি ইবরাহীম খাঁ সাহেবের মেজো নাতনিকে বিয়ে করি [বার বছরের সেই বালিকা পাঠিকা]। বাংলাদেশের অন্য সব নাত-জামাইদের মতো তখন আমি তাঁকে যেকোন সময় বিরক্ত করার পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করি। কত সময় যে কাটিয়েছি তাঁর ঘরে! কত বিচিত্র বিষয় নিয়ে কত বিচিত্র আলোচনা! তাঁর প্রিয় বিষয় হচ্ছে ইতিহাস। তিনি শুরু করতেন ইতিহাস। আমি তাঁকে টেনেটুনে নিয়ে আসতাম ভূত-প্রেতের গল্পে। ভূত-প্রেত আমার সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে পুরোপুরি নাস্তিক ছিলেন। আমি কিছু কিছু অলৌকিক গল্প বলে তাঁকে ব্যাখ্যা করতে বলতাম। তিনি দেখতাম কিভাবে কি

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
Alternative Textহুমায়ূন আহমেদ- র আরো পোষ্ট দেখুন