বার
খুব বৃষ্টি হচ্ছে কয়েকদিন ধরে। শীত এসে গিয়েছে।এখন বৃষ্টির মৌসুম না, তবু বৃষ্টি হচ্ছে। শহরের রাস্তা-ঘাট ডুবে গিয়েছে, মানুষ বেশ নাজেহাল হচ্ছে যানবাহন না পেয়ে। টিভিতে এসব দেখানো হলো।পরদিন কাগজেও ছাপা হলো খবর ছবিসহ।
এনায়েতুল্লা দেখে আর পড়ে নিজে নিজেই বললেন,
ক্লাইমেট চেঞ্জ!
বৃষ্টির মধ্যে আমেনার স্বামী সুরুজ এসে হাজির।
এনায়েতুল্লা তখন খেতে বসেছেন। সে বাইরে বারান্দায় বসে গা থেকে ভিজা কাপড় খুলছে, মাথার চুল ঝাড়ছে। তাকে দেখে তার বাচ্চা ছেলেটা দৌড়ে গিয়েছে। তার পেছনে পেছনে গিয়েছে রাজু।
দারোয়ান বরকতের সঙ্গে কথা হচ্ছে সুরুজের। একটু পর রাজু ভেতরে এসে বলল, আমেনার স্বামী আইছে।
এনায়েতুল্লা রাজুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে বললেন,
আমেনা তোর চেয়ে বয়সে অনেক বড়। তাকে আমেনা বুবু বলবি। এরপর তিনি রান্না ঘরের দিকে তাকিয়ে আমেনার মায়ের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমার জামাই এসেছে। আমরা তাদের গ্রাম থেকে আসার ৩ মাস পর। এর মধ্যে যোগাযোগ করেনি। এখন এসেছে কেন দেখতে হবে। মতলবটা কি তার?
আমেনাকে তার কাছে যেতে দিয়ো না, তুমিও যেয়ো না। আমি দেখছি।
খাওয়া শেষ করে এনায়েতুল্লা বারান্দায় এলেন।
সুরুজকে দেখে গম্ভীর হয়ে বললেন, এই বৃষ্টির মধ্যে এতদূর থেকে? জরুরি কথা আছে নাকি?
সুরুজ তার পা ছুয়ে সালাম করে লাজুক মুখে বলল,
জ্বি।
কি কথা? তিনি এবার তার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন।
সুরুজ হাত কচলে বলল, আমেনারে আর পোলারে লইয়া যাইতে আইছি।
এনায়েতুল্লা মুখ আরো গম্ভীর করে বললেন, কেন?আবার তোমার আব্বা-আম্মার হাতে মারধর খাওয়াবার জন্য?
সুরুজ মাথা নেড়ে বলে, না। এবারে আমরা আলগা থাকমু।
আলগা থাকবা মানে? তিনি সন্দিগ্ধ চোখে তাকান।
সুরুজ বলে, বাপ-মার লগে থাকুম না। জুদা হইয়া গেছি। তাদের লগে ঝগড়া হইছে আমার আমেনারে লইয়া। আমি আলাদা বাড়ি বানাইছি। হেইখানে থাকুম আমেনারে লইয়া। পোলারে লইয়া।
এনায়েতুল্লা এবার মুখের পেশী কিছুটা আলগা করে বলেন, কীভাবে চলবে তোমাদের? মানে সংসার চালাবে কি করে?
বাজারের দোকান। হেইডা আমার। দোকানের আয় ইনকাম দিয়া সংসার চালামু।
হু। বলে তিনি সুরুজকে ভালো করে দেখেন।
কোনো বদমতলব আছে কিনা জানতে চান, ফন্দি করছে কিনা বুঝতে চান। না, সুরুজকে সরলই মনে হচ্ছে এখন। বেশ আন্তরিক। তিনি বলেন, বসো আমেনাকে ডেকে দিই। তার মাকেও ডাকি। তাদের সঙ্গে কথা বলো তুমি। বলে তিনি ভেতরে চলে যান। একটু পর আমেনার মা আর আমেনা গিয়ে
বারান্দায় সুরুজের সঙ্গে দেখা করে। তিনি ভেতর থেকেই আমেনার কানড়বার শব্দ শুনতে পান। রাজু তার কাছে এসে বলে, আমেনা বুবু কাঁনতেছে।
এনায়েতুল্লা বলেন, হ্যাঁ। শুনতে পাচ্ছি।
রাজু বলে, আমেনা বুবু কাঁন্দে ক্যান?
এনায়েতুল্লা তার দিকে গম্ভীর হয়ে তাকান, কী বলবেন ভাবেন। এরপর বলেন, এমনিতেই কাঁদছে।
রাজু যেতে যেতে নিজে নিজেই বলে, এমনিতেই কেমনে কাঁন্দে একজন? বুঝলাম না।
দূর থেকে তার কথা শুনে হাসেন এনায়েতুল্লা। দাউদকে ডাক দেন তিনি; সে আসার পর তাকে সুরুজের কথা বলেন।
শুনে দাউদ বলে, কী মনে হয় আপনার? সুরুজ কী সত্যি সত্যিই আলাদা থাকবে আমেনাকে নিয়ে? নাকি এটা তার ভাওতাবাজি?
এনায়েতুল্লা বললেন, সে তাই তো বলল। বেশ আন্তরিক মনে হলো তাকে। এখন নিয়ে যাক, তার বউ সে নেবে আর তার বউ যদি যেতে চায় তাহলে আমরা তো আইনত বাধা দিতে পারি না। এটাই ভালো ওদের দুইজনের জন্য। এখন যাক, আমরা পরে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে আসবো। যদি দেখি,আগের মতো আমেনাকে মারধর করছে, তাহলে তাকে নিয়ে আসবো আমরা। আর যেতে দেবো না।দরকার হলে ওদের তালাক নিয়ে আরেকটা বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করবো। শুনলাম বরকত দারোয়ান
তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছে। আমেনার মাই আমাকে বলেছে।
দাউদ বলল, এটা আমাদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার ফন্দি না তো?
এনায়েতুল্লা বললেন, দেখা যাক। সে এখনো টাকার কথা কিছু বলেনি।
পরদিন সকালে সুরুজ আমেনা আর তার ছেলেকে নিয়ে রওনা হলো তার গ্রামে। রাজু তাদের জন্য একটা রিকশা ডেকে আনলো; রিকশা দিয়ে তারা
যাবে বাসডিপো পর্যন্ত। এরপর বাসে মানিকগঞ্জে তাদের গ্রামে। যাওয়ার আগে খুব আবেগপ্রবণ হয়ে সুরুজ আর আমেনা পা ধরে সালাম করে এনায়েতুল্লা,
দাউদ আর জয়নাবকে। টাকা-পয়সা কিছু চাইলো না সে। বাড়ির গেট পর্যন্ত যাওয়ার পর এনায়েতুল্লা
তাকে ডাকলেন। পকেট থেকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে বললেন, নাও।
ক্যান? কিসের টাকা এইডা? সুরুজ অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে।
নতুন সংসার পাততে যাচ্ছো। টাকা লাগবে। নাও।এরপর বলেন, আমরা কিছুদিন পর গিয়ে দেখবো তোমরা কেমন আছো।
সুরুজরা চলে গেলে দাউদ বলল, টাকা দিলেন। সে চায়নি। তাও দিলেন।
এনায়েতুল্লা বললেন, সে জন্যই দিলাম। চাইলে সন্দেহ হতো। এখন মনে হচ্ছে সে সত্যি আন্তরিক।
তার পাশে দাঁড়ানো রাজু বলল, আমেনা বুবুর পোলাডার লাগি মনডা পুড়তাছে। সে আমারে খুব পছন্দ করতো, আমিও তারে পছন্দ করছি। সে আমার পিছে পিছে ঘুরতো। তারে যা কইতাম, তাই হুনতো।
এনায়েতুল্লা তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। এরপর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তার মনটা খারাপ হয়ে এসেছে; চোখে পানি আসছে। বুড়ো বয়সের এই এক দোষ। যখন তখন মন খারাপ হয়, কান্না আছে।