ঈদ আমাদের সবচেয়ে বড় উৎসবের দিন। এই ঈদ কেউ রাজধানী ঢাকায়, আবার কেউ বা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে উদ্যাপন করেন। তবে বেশির ভাগ মানুষ অনেক বাধাবিপত্তি ঠেলে, যদি একটি টিকিট মেলে, মনে খুশির আলো জ্বেলে, বাসে-লঞ্চে কিংবা রেলে, গ্রামে গিয়ে আপনজনের সঙ্গে মেলে। তবে এই যাত্রাপথের ঝক্কিও কম নয়। খাদ্যে-বাদ্যে ভেজালের মতো ভেজাল এখন রাস্তাতেও যে কারণে হয় পস্তাতেও। রাস্তা মেরামত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু টিকছে না। তাড়াতাড়ি সারাসারি করলে যা হয় আরকি। আর কোনো কিছু সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে না পারলে একটি হাত এসে সামনে দাঁড়ায় আর তা হচ্ছে অজুহাত। আমাদের এখানে এই অজুহাতের ব্যবহার আসল হাতের চেয়েও বেশি।
আমার ছোটবেলার ঈদ আর এখনকার ঈদ নিয়েও কিছু লিখতে বলা হয়েছে। এবারে সে প্রসঙ্গে আসি। ছোটবেলার ঈদের স্মৃতি মনে পড়লে মনটা বিষণ্ন্ন হয়ে ওঠে। তখন সবকিছুতেই অন্য রকম আনন্দ ছিল। রোজা আসা মানেই যেন ঈদ চলে আসা। বাবার হাত ধরে দোকানে যেতাম। তখন তো আর এত বাহারি মল ছিল না। বাবার চাকরির সুবাদে ছোটবেলায় দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা হয়েছে। তবে বেশির ভাগ থাকা হয়েছে চট্টগ্রামে। যে কারণে ঈদ শপিংটা চট্টগ্রাম নিউমার্কেটেই করা হতো। বাবার হাত ধরে ভাইবোন সবাই মিলে দোকানে দোকানে ঘুরছি, এটা-ওটা কিনছি, সে এক অন্য রকম আনন্দ। অন্য রকম অনুভূতি। কিন্তু এই সময়ে এসে যখন নিজের দিকে তাকাই, তখন মনে হয় বাবা হিসেবে আমি হয়তো সন্তানদের সঙ্গে ‘আমার বাবার’ মতো দায়িত্ব পালন করতে পারছি না। কারণ, একটাই—সময় এবং টেলিভিশন। আমি বাবা হওয়ার আগে থেকেই মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত। আর ২৬ বছর ধরে শুধু এই ‘ইত্যাদি’ই করে চলেছি এবং এই ২৬ বছরে ২৬টি ঈদের ‘ইত্যাদি’ করতে হয়েছে। আর ঈদের ‘ইত্যাদি’ মানেই রোজার এক মাস আগে থেকে প্রস্তুতি এবং রোজার মাসে সম্পাদনা। যে কারণে পুরো মাসই ব্যস্ত থাকতে হয় সম্পাদনার কাজে। প্রতিটি অনুষ্ঠানেই নিত্যনতুন বিষয়ের চিন্তা করতে হয়। দর্শকেরা যেমন সময় বের করে ‘ইত্যাদি’ দেখতে বসেন, আমিও আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁদের সেই সময়ের মূল্য দিতে চেষ্টা করি। ঈদের দু-এক দিন আগে যখন ফ্রি হই, তখন আমার মেয়েকে নিয়ে (ওর বয়স এখন আট) কিছু পরিচিত দোকানে যাই। চেনাজানা বলে আমাকে দেখেই বিক্রেতারা বলে ওঠেন, ‘প্রতিবারই আপনি আসেন যখন আমাদের বেস্ট কালেকশনগুলো শেষ হয়ে যায়।’ শুনে আমার মনটা খারাপ হলেও আমার মেয়ে বর্ণনার মনটা কিন্তু খারাপ হয় না। এর কারণ তার মা। আমি আমার স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ, কারণ আমার ব্যস্ততা বুঝে সে আগে থেকেই ছেলেমেয়েদের জন্য কেনাকাটা করে রাখে। দোকানে দোকানে ঘুরে ওরা যখন কেনাকাটা করছে, আমি তখন বদ্ধ ঘরে ‘ইত্যাদি’ সম্পাদনা করছি। তবে পছন্দের কাপড় কিনতে না পারলেও বাবার সঙ্গে কেনাকাটা করতে যাওয়ার যে আনন্দ, সেটুকু আমি ওদের দিতে চেষ্টা করি। আর তাতেই ওরা আনন্দিত। গত দুই বছর ধরে আমার একমাত্র ছেলে ফাগুন বিদেশে আছে পড়াশোনার জন্য। তবে এবার ঈদের ছুটিতে সে দেশে এসেছে। ঈদ করবে আমাদের সঙ্গে। সুতরাং ভাইকে পেয়ে বর্ণনা আনন্দে আত্মহারা। ওদের আনন্দই আমার আনন্দ। আর তার সঙ্গে যদি এত পরিশ্রম করে নির্মাণ করা ঈদের ‘ইত্যাদি’ দর্শকদের ভালোবাসা পায়, আনন্দ আরও বেড়ে যায়। আর দর্শকদের এই ভালোবাসাই আমার কাছে ঈদের সবচেয়ে বড় উপহার। আর একটি কথা বলে লেখার ইতি টানতে চাই। এই যে আনন্দময় ঈদ, এ রকম প্রতি ঈদেই আমরা দেখি ঘরমুখী মানুষে বোঝাই ট্রেন-বাস-লঞ্চ-স্টিমার। উদ্দেশ্য একটাই, পরিবারের সবার সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেওয়া। কিন্তু এমন অনেকেই আছেন—ঘর থেকেও যাঁদের ঘর নেই। যাঁরা সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় বাধ্য হয়েছেন ঘরকে পর করতে। আপনজনের মুখ যাঁদের চোখের পানির বিন্দুতেই ভেসে ওঠে, বিন্দু ঝরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায়। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া সেই সব মানুষের চোখ থেকে ঝরে পড়ুক অশ্রু নয়, স্নেহের আশিস। ঈদ হোক স্নেহ-ভালোবাসা-শ্রদ্ধায় ভরা আনন্দময় দিন।