আমার সুনীলদা, প্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। গতকাল এই সংবাদ পেয়ে আমি কিছু সময়ের জন্য নির্বাক হয়ে পড়েছিলাম। আমি ভাবতেই পারছিলাম না সুনীলদাকে আর দেখতে পাবো না। আড্ডাবাজ, রসিক এবং প্রাণখোলা এই মানুষটা আর বেঁচে নেই। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে আছি। তার সৎকারে অংশগ্রহণ করতে আমি গতকালই কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিয়েছি। বাষ্পরুদ্ধ চোখে লিখতে গিয়ে আমার মনে পড়ে যাচ্ছে আমাদের উন্মাদ, উন্মাতাল সেই দিনগুলোর কথা।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বেঁচে থাকাকালে কিংবদন্তি কথাটাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন বহুদূর। সাহিত্যের যে মাধ্যমেই তিনি হাত দিয়েছেন সেখানেই বিরাট এক ঐশ্বর্য ফুটে উঠেছে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস তো বটেই; এমনকি গান, চিত্রনাট্যেও তিনি অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তবে কবিতাই তার প্রথম প্রেম। বিস্ময়কর তার রচনার পরিমাণ। অনেকেই জানেন না, গানেও তিনি কতটা পারদর্শী।
সুনীলদা জন্মগতভাবে একজন বাঙালি। তার জন্ম আমাদের এই দেশে। পরিবারের সঙ্গে দেশভাগের সময় তাকে অনেকের সঙ্গে কলকাতায় চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু তিনি মনে-প্রাণে একজন বাঙালি ছিলেন। আর এ কারণেই দুই বাংলার সুহৃদ ছিলেন তিনি। তিনি বলতেন ‘বাংলা সাহিত্যের প্রধান রাজধানী হবে ঢাকা।’ আত্মিক সম্পর্কের কারণেই তিনি সময়-সুযোগ পেলে ছুটে আসতেন বাংলাদেশে। দুই বাংলার সাহিত্যিকদের মেলবন্ধন ঘটানোর জন্য তিনি কৃত্তিবাস সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করেছেন। এবং তিনি আমাদের এখানকার তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের পুরস্কৃত করেছেন। শুধু এই নয়। তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ককে আরও নিবিড় করবার জন্য তার একমাত্র পুত্রকে বাংলাদেশের রংপুরে বিয়ে দিয়েছেন।
সুনীলদার সঙ্গে আমার পরিচয় বা আমাদের দীর্ঘ সময়ের বন্ধুত্বের সূত্রপাত আমার কলকাতায় গমনের পর। সেটা শুরু হয়েছিল কৃত্তিবাসের মাধ্যমে। সে অনেক কথা। আজ এমন দিনে সুনীলদার সঙ্গে আমার কাজের স্মৃতির কিছু কথা বলবো।
আমি যখন কলকাতায় সুনীলদা তখন আমেরিকায়। সে সময় কফি হাউস, শুধু কফি হাউস কেন গোটা বাংলাকাব্য জগতেই প্রবল দাপটে বিচরণ করে বেড়াচ্ছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় একাই। এর মধ্যে এসে গেছেন সুনীল। মার্কাস স্কয়ারে বঙ্গ সংস্কৃতির মাঠে কবিতা পাঠ, তুমুল হৈ-হুল্লোড়, কবিতা সিংহ-বিমল রায় চৌধুরীদের সঙ্গে মিলে পনেরো দিন ধরে দৈনিক কবিতা বের করে যাওয়া। এমন করে কখন যে কৃত্তিবাসের একজন হয়ে গেছি আমি নিজেও টের পাইনি। সুনীলদা আনন্দবাজারে প্রতি শনিবার দেশ-বিদেশ বলে একটি ফিচারের পাতা দেখতেন। আমি তার নিয়মিত লেখক হয়ে গেলাম। এছাড়া প্রতি সোমবারে কলকাতার কড়চা দেখতে শুরু করলেন সুনীলদা। তার প্রশ্রয়ে সেই কড়চায় কত কিছুই না লিখেছি।
একটা সময় খুব সম্ভবত ২৫ নম্বর সংখ্যা থেকে সুনীলদা ঘোষণা দিয়ে কৃত্তিবাস বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব রাখেন। হঠাৎ কী খেয়াল হলো আমি আর আমার তখনকার প্রায় সার্বক্ষণিক সঙ্গী কবি নিমাই চট্টোপাধ্যায় ঠিক করলাম আমরা একবার চেষ্টা করে দেখি না কেন। আমাদের আরেক বন্ধু অমল লাহিড়ী পিছন থেকে করতালি দিতেই সুনীলদা বললেন, তথাস্তু। আসলে সুনীলদা মানুষটার শব্দ ভাণ্ডারে ‘না’ শব্দটির ব্যবহার ছিল না বললেই চলে। যে কথা সেই কাজ। আমরা লেগে গেলাম কৃত্তিবাসের জন্য লেখা আর বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কাজে। কবিদের লেখা পেতে কোনো অসুবিধেই হলো না। একটা প্রেসও পেয়ে গেলাম। পূর্ণেন্দু পত্রী করে দিলেন একটি মানানসই প্রচ্ছদ।
সুনীলদা দিয়েছিলেন ‘উত্তরাধিকার’ নামে অসাধারণ সেই কবিতা, যা একমাত্র আত্মজনকেই দান করা যায় অনায়াসে। কবিতাটি সুনীলদার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বন্দী, জেগে আছো’র ৬৪ পৃষ্ঠায় ৪৬ সংখ্যক কবিতা। শক্তিদা দিয়েছিলেন ‘যেভাবে শব্দকে জানি’। অলোকরঞ্জন, শঙ্খ ঘোষ, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসুর লেখাও পেয়ে গেলাম।
সুনীলদা কথা বলতেন স্পষ্ট; মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন জলের মতো টলটলে। যেখানে কোনো ময়লা ছিল না। হাসতেন প্রাণ খুলে। জীবনকে দেখতেন তরুণের চোখে। আমার কাছে বরাবর মনে হয়েছে, আর সবার বয়স বাড়ে, সুনীলদার বাড়ে না। বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত তিনি উদযাপন করতে চাইতেন, হোক তা জীবনযাপনে কিংবা জীবনকে ভালোবেসে লেখার মধ্যদিয়ে। এই যে তার বয়স হচ্ছিল, তাকে দেখে বা তার আচরণ দেখে কখনও তা মনে হওয়ার উপায় ছিল না। জীবনের কাছে তার কোনো নালিশ ছিল না। যে কোনো পরিস্থিতিতে তিনি ইতিবাচক ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা করতে জানতেন। তার ছাপ পড়েছে তার প্রতিটি লেখায়।
সুনীলদা আমাদের মাঝে আর ফিরে আসবেন না। তার আকস্মিক প্রস্থানে একটি কথাই মনে আসছে বার বার ‘সে যে চলে গেল বলে গেল না।’