আমার এক কাপ চা দরকার। জাস্ট এক কাপ চা। রাত তিনটায় ঘুম ভেঙে গেল। মাথা ধরেছে। স্পন্ডিলসিস আছে। শিরদাঁড়ায় সমস্যা। ভালো মানুষটা ঘুমুতে যাই। ব্যথা নিয়ে জেগে উঠি। ব্যথাটা মাথায় যায়। আধকপালি বিষ।
একটা ফ্লাটবাড়িতে আমি একলা থাকি। সকালবেলা বুয়া আসবেন। নাশতা দেবেন টেবিলে। ঘরদোর পরিষ্কার করবেন।
কিন্তু রাতের বেলা চায়ের নেশা উঠলে কী করব? রান্নাঘরে গিয়ে ছোট্ট পাতিলটায় পানি নিয়ে চুলার ওপরে রাখব। কাপের মধ্যে গরম পানি ঢেলে ভাসিয়ে দেবো একটা টি-ব্যাগ। সো ইজি।
কিন্তু তিনটার সময় রান্নাঘরের ক্যাবিনেটের পাল্লা খুলে দেখি, চা-পাতা নাই।
এখন উপায়?
যার কেউ নাই তার আছে ফেইসবুক।
যার কোনো কাজ নাই, তার কাজ হবে ফেইসবুকে বসা।
হাতে স্মার্ট ফোনটা তুলে নিই।
স্ট্যাটাস লিখি—আমার এক কাপ চা দরকার। জাস্ট এক কাপ চা।
একটু পরেই স্ট্যাটাসের নিচে কমেন্টস আসে। আমার নিউজিল্যান্ডের বন্ধু শান্তি পাঠিয়েছে—একটা চায়ের কাপের ছবি।
নিউজিল্যান্ডে সকাল হয়ে গেছে। কাজেই এই ছবি খুব স্বাভাবিক।
এর পরের কমেন্টটা এল আমেরিকা থেকে… চা খেতে হলে স্ট্যাটাস দিয়ে লাভ কী! বানিয়ে খেয়ে নিলেই তো হয়! আমেরিকায় এখন বিকাল। যিনি কমেন্ট পাঠিয়েছেন, ধ্রুবতারা, তাঁকে আমি চিনি। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। ইঞ্জিনিয়াররা বাস্তববাদী মানুষ। তাঁরা যেকোনো সমস্যার টেকনিক্যাল সমাধান খোঁজেন। তিনি আমার সমস্যার একটা বাস্তব সমাধান দিতে চাইছেন।
আমি তার কমেন্টসের নিচেই রিপ্লাই দিলাম—বাসায় চা-পাতা নাই। টিব্যাগ নাই। কী করব?
একজন লিখলেন, রিদ ওয়ান (ওয়ানটা আবার ইংরেজি অংকে লেখা) নাম—এক কাপ চা এঁকে চাটতে থাকেন, মালয় দ্বীপে এক যে বোকা শেয়ালে, লাগলে খিদে মুরগি এঁকে দেয়ালে, মনের সুখে চাটতে থাকে খেয়ালে।
এই লোককে আমি চিনি না। আমি কমেন্টস ডিলিট করে দিলাম। এরপরেও যদি সে কমেন্টস দেয়, তাকে সোজা ব্লক করে দেবো।
এই সময়ে একজন লিখলেন, তার নাম মত্স্যকন্যা, আমার বাসায় চলে আসেন। চা বানিয়ে খাওয়াব। পুদিনা চা। বাসায় টিব্যাগও আছে, পুদিনা পাতাও আছে।
আমি মত্স্যকন্যার প্রোফাইলে চাপ দিলাম।
বোঝার চেষ্টা করছি, এটা ফেইক আইডি না অরিজিনাল।
এই আইডি বলছে, এর নাটোর গার্লস স্কুল, রাজশাহী উমেন’স কলেজ আর ঢাকা ইউনিভার্সিটি আইআর থেকে পড়েছেন।
কতগুলো ছবি দেখলাম, প্রোফাইলে, ফেইক ছবি বলে মনে হলো না।
আমার ধারণা হলো :
তিনি একজন নারী।
তার বয়স ৩৪/৩৫ হতে পারে।
তিনি সুদর্শন।
আমি তার ইনবক্সে লিখলাম, আপনার বাসা কোথায়?
ধানমণ্ডি। উত্তর আসতে সময় নিল ত্রিশ সেকেন্ড।
ধানমণ্ডি? আমি লালমাটিয়া।
তাহলে তো কাছেই। চলে আসুন।
কোথায় আসব?
আমার বাসায়।
বাসার ঠিকানা?
তিনি ঠিকানা দিলেন।
আসব? আর ইউ শিয়োর?
যদি সত্যি আপনার চায়ের তেষ্টা পেয়ে থাকে।
বাসায় ঢুকতে দেবে এত রাতে?
আমি গেটের গার্ডকে বলে রাখছি। দেবে।
আপনি আমাকে ডাকছেন? আমি ভূত না প্রেত আপনি জানেন?
ভাইরে আপনার যদি চা খেতে ইচ্ছা করে আপনি আসেন। আর যদি না করে তাহলে ঘুম দেন।
আমি আবার তার প্রোফাইলে যাই। জেনুইন কেইস? নাকি ক্রিমিনাল টাইপের কেউ? বাড়িতে নিয়ে আটকে রাখবে? কোনো মেয়ের সঙ্গে ছবি তুলে বলবে, টাকা দাও না হলে পোস্ট করে দেবো? অন্তত বাড়ির গেটে ধরে পকেটের মোবাইল ফোন কেড়ে নেবে?
নিচের পার্কিংয়ে গাড়ি আছে। চাবি ঝুলছে দেয়ালে। ড্রাইভিং পারি। যাই না কেন। এক কাপ চা-ই তো খাব। আর তো কিছু না।
আচ্ছা আসছি। আমি লিখি।
চায়ের সঙ্গে আর কী খাবেন?
না না। আর কিছু খাব না।
আমি পোশাক পাল্টাই। পারফিউম মাখি। দাঁতও ব্রাশ করে নিই দ্রুত।
তারপর গাড়ির চাবিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। লালমাটিয়া থেকে রাতের বেলা বের হওয়া খুব মুশকিল। বেশির ভাগ রাস্তায় বাঁশ দেওয়া। রাস্তা বন্ধ।
ঢাকা শহরে রাত পৌনে চারটায় এত লোক চলাচল করে। আমার কোনো ধারণাই ছিল না।
ধানমণ্ডির ভেতরটা নির্জন। অন্ধকারে রাস্তার আলো জ্বলছে।
ধানমণ্ডির ওই অ্যাড্রেসটা একটা ফ্ল্যাট।
বাড়ির নাম রজনীগন্ধা। খুঁজে পাই। গাড়ি বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই গেট খুলে যায়। সত্যি দারোয়ানকে বলে রেখেছিল বোঝা যাচ্ছে।
আমি বলি, গাড়িটা কোথায় রাখব?
গার্ড বলে, ওই পার্কিংটা ফাঁকা আছে, ওইখানে রাখেন। লিফট বন্ধ। ছাড়তে হইব?
আমি বলি, লিফট লাগবে না। কয়তলা?
৫ তলা।
আচ্ছা পারব।
কোমরে একটু ব্যথা আছে। তবুও সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলায় ওঠার মতো ক্ষমতা এখনও আছে।
৫ তলায় মুখোমুখি দুটো ফ্ল্যাট।
নম্বর মিলিয়ে নিই। বেল টিপি।
দরজা খুলে যায়।
সালোয়ার কামিজ। চুল খোলা। মিষ্টি গন্ধ। মুখে বোধ হয় কোনো একটা পাউডার মেখেছেন। মুখটা ধবধবে ফরসা দেখা যাচ্ছে।
আসুন।
আমি ভেতরে যাই। রাত বাজে চারটা। সমস্ত চরাচর ঘুমুচ্ছে। আমি বসবার ঘরে বসি।
তিনি আমার মুখোমুখি সোফায় বসেন।
বলেন, এতদিন কোথায় ছিলেন?
আমি বিস্মিত হই না। আমার ঘোর ঘোরও লাগে না। ব্যাপারটা যেন খুব স্বাভাবিক, আমি তেমনি ভঙ্গিতে বলি, এই তো, কিছুদিন বিদেশে ছিলাম, এখন আবার দেশেই। চায়ের কী খবর?
চায়ের পানি ফুটছে। নিয়ে আসি।
তিনি একটা ছোট্ট ট্রেতে দুটো কাপে চা নিয়ে আসেন। সঙ্গে বিস্কিট।
আমি বলি, বিস্কিট খাব না।
চা খাই।
পুদিনা পাতাটা গরম ছিল, চায়ের তরলের চেয়ে, মুখে দিতে জিভ পুড়ে যায়।
চা কেমন হয়েছে? তিনি জানতে চান।
ভালো।
শুধু ভালো।
বেশ ভালো।
চা শেষ হলে আমি বলি, এখন আসি।
তিনি বলেন, সে কী! চায়ের দাম দিয়ে যাবেন না?
আমি চমকে উঠি।
কী দাম দিতে হবে। এখনই বোধ হয় অস্ত্র হাতে গুণ্ডারা আসবে। বলবে, যাচ্ছ কোথায় বাবাজি।
আমি বলি, দাওয়াত দিয়ে চা খাইয়ে বাঙালি মেয়ে কবে থেকে দাম নিতে শুরু করল?
তিনি বলেন, আপনি একটা কবিতা লিখেছিলেন মনে আছে। আপনি যখন থার্ড ইয়ারে পড়েন। একটা একুশে স্মরণিকা বেরিয়েছিল ডিপার্টমেন্ট থেকে। ওই কবিতাটা একটু আবৃত্তি করে শোনান না!
কোন কবিতা?
ভুলে গেছেন।
হ্যাঁ।
তাহলে আর দরকার নাই।
আপনি কে বলেন তো?
ফেইসবুকে তো আমার নাম দেখেছেন। বাস্তবে আমাকে দেখছেন। আমার বাসায় আপনি বসে আছেন।
ওটা তো আপনার ফেইক নাম। মত্স্যকন্যা কারও নাম হয় না।
নামটাই কি তাহলে আসল! আজকে আপনার নামটা পাল্টে পল্টু বল্টু করে দিলেই আপনি পল্টু বল্টু হয়ে যাবেন।
তা না। তবে আপনার আসল নামটা জানলে আমি ধরে ফেলতে পারতাম আপনি কে? আমাদের ডিপার্টমেন্টেই পড়তেন…
তা তো বলব না…
আপনাদের সময়ে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল মনে আছে। টিএসসির সামনে রিকশায় আপনাদের একজন জুনিয়র ছাত্রী মারা গিয়েছিল…
আপনি কি লিসা?
হা হা হা…
হাসছেন কেন?
লিসা তো মারা গেছে।
সেই জন্যই তো ভয় পাচ্ছি।
আপনাকে একটা ক্লু দিই। আমি লিসা হলে আমার বয়স থাকত কুড়ি বছর। মারা যাওয়ার পরে কারো বয়স বাড়ে না। আমার দিকে ভালো করে তাকান। আমার বয়স ৩২।
তাহলে আপনি কে?
বলব না।
বাসায় কে কে থাকে?
আমি আর আমার কাজের বুয়া। কাজের বুয়া ছুটিতে বাড়ি গেছে। আজকে বাসায় আমি একা…
আমি আসি।
বাসা ফাঁকা শুনে পালাচ্ছেন?
না। চা খাওয়ার কথা ছিল। চা খেয়েছি। এখন যাই।
মাথাব্যথা সেরেছে।
হুঁ।
ক্রিকেট খেলতে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলেন। সেই ব্যথাটাই কি রয়ে গেল?
তুমি জেরিন?
আপনি এইভাবে একটার পর একটা নাম বলে গেলে আপনার সবগুলো ক্রাশ বেরিয়ে যাবে। আমি তাতে দুঃখ পাব।
আপনি কে তাহলে?
এইটা বলব না। তবে আজকের পরে একটু সাবধানে থাকবেন। আমাদের বাড়িতে সিসিটিভি লাগানো আছে। কে কে এই ফ্ল্যাটে ঢুকল এটা মনিটর করা হয়। আপনাকে যদি চিনে ফেলে তাহলে আপনার বিপদ হতে পারে…
কী বলছেন আপনি এসব…
আজকে যান। এক কাজ করেন। মুখে মাথায় এই স্কার্ফটা বেঁধে যান। বের হওয়ার সময়ের ছবিটা তাহলে আর বোঝা যাবে না।
এটা কার ফ্ল্যাট।
আমি যখন থাকি, আমার।
তাহলে কে মনিটর করে?
এত কথা বলেন কেন? যান।
আচ্ছা আসি।
আসেন। শোনেন কবিতাটা মনে পড়লে আমাকে ফেইসবুকে লিখবেন। কবিতাটা আমিও ভুলে গেছি। কিন্তু ওই কবিতাটা আমার দরকার। ওই কবিতাটার আবছা স্মৃতিই আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। তা নাহলে কবেই তো সুইসাইড করতাম।
কেন?
আপনি কিন্তু কবিতাটা উদ্ধার করে আমাকে ইনবক্স করবেন। করবেন প্লিজ…
তিনি এসে আমার হাত ধরেন। তার পারফিউমটা মাদকতাপূর্ণ… আমার শরীর কেঁপে ওঠে…
আই ডোন্ট ওয়ান্টু টু ডাই… আই ওয়ান্ট টু লিভ…
আই উইল নট লেট ইউ ডাই বেবি… কাম… কাম… মেয়েটি আমার বুকের ওপরে হামলে পড়ে উথালপাথাল করে কাঁদে…
আমার কী হয়। আমি বলি, কবিতাটা আমার মনে আছে রাহিনা… আমার পুরোটাই মনে আছে…
আমি তোমার নাম লিখিনি, কিন্তু সবাই জানত ওই কবিতা আমি তোমাকে নিয়েই লিখেছিলাম…
আর কিছু চাহি না
যদি তার ছোঁয়া পাই, নাম যার…
সারাদিন তার গান আমি কি গো গাহি না
যদি তার দেখা পাই, নাম যার…
আমি যদি মরে যাই সেই কি গো দায়ী না
কোথাকার বনলতা,
নাটোর রাজশাহী না
নাম যার…
দুদণ্ড কষ্ট দিল তবু তাকে পাহি না
বিম্বিসার অশোকের ফার্স্ট ইয়ারের…
তিনি কাঁদেন আর বলেন, ক্লাসের সব মেয়ে বলল, তোকে নিয়ে কবিতা লিখেছে, আমি পড়লাম, বুঝলাম, ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে, রাজশাহী থেকে এসেছে, চাহি না, গাহি নার সঙ্গে একটা নামই মেলে, রাহিনা… আমি সব বুঝলাম… দূর থেকে দেখলাম কবিকে, লম্বা, হাল্কা, বাবড়ি চুল, গলার কাছে জন্মদাগ…
রাহিনা আমার গলার দাগটায় হাত বোলাচ্ছে… কিন্তু আপনি কোনোদিনও আমার খোঁজ নিলেন না, আমার সঙ্গে কথা বললেন না, আমি সেকেন্ড ইয়ারে নাটকের দলে ভিড়ে গেলাম, থার্ড ইয়ারে সিনেমার পোকা মাথায় ঢুকল, এখন এই তো, প্রডুসারের ফ্ল্যাটে আছি, কিন্তু নায়িকা হওয়াটা আর হয়ে ওঠেনি…
মাঝে মধ্যে মনে হয়, ছাদে উঠি। নয়তলা বিল্ডিং। ঝাঁপ দিলে কানের কাছে সোঁ সোঁ করে বাতাস বইবে। তখন আপনার ওই কবিতাটা মনে পড়ে, কী জানি, খুব বাঁচতে ইচ্ছা হয়, আপনি কেমন আছেন? বউ কই? বাচ্চা…
আমি নড়ে চড়ে সরে বসি…