একটা গল্প কোথায় পাই বলুন তো?
লোকটা আমাকে বলে। তার উচ্চতা অস্বাভাবিক রকমের বেশি, সে কারণেই বোধ হয় তাকে শুকনো রোগাপটকা দেখাচ্ছে, তার বয়স—আজকাল সবাইকে আমার চেয়ে কম বয়সী বলে মনে হয়, কিন্তু কোন সালে জন্মেছেন সেটা জানলে দেখি, সবাই আমার চেয়ে বড়, কাজেই এই লোকটার বয়স কত তা আর আন্দাজ করতে যাচ্ছি না, তবে ধরা যাক, তার বয়স পঞ্চাশ।
আমি তার সঙ্গে লিফটে উঠেছি, আমাদের পত্রিকা অফিসের লিফট, আমি যাব পাঁচে, তাঁকে বললাম, কোথায় নামবেন, তিনি বললেন, পাঁচেই, তারপর আমার সঙ্গে পাঁচে নেমে গেলেন। আমি বিনয়বশত শুধালাম, কার কাছে এসেছেন? তিনি বললেন, কারো কাছে নয়, একটা গল্পের খোঁজে এসেছি।
আমি প্রমাদ গুনলাম। এই বুঝি তিনি আমাকে বলবেন, একটা গল্প লিখে দেবেন? সামনে আমাদের ঈদ সংখ্যা কিনা।
আমি বললাম, গল্প, আপনার গল্প চাই তো, আমাদের অফিসে মশিউল আলম আছেন, সাংঘাতিক গল্পকার। তিনি আপনাকে গল্প লিখে দিতে পারবেন। আসলে আমি জানি, মশিউল আলমের তিনটা অপ্রকাশিত গল্প এই মুহূর্তে রেডি আছে, আপনি ভালোভাবে ধরুন, তিনি না করতে পারবেন না। দরকার হলে লেখক সম্মানী অগ্রিম দেবেন।
তিনি বললেন, না না, আমি অন্যের লেখা গল্প চাই না। আমি নিজে একটা গল্প লিখব। সেই গল্পটা কোথায় পাওয়া যায়, তা-ই জানতে চাইছি।
আমাদের অফিসে বিচিত্র ধরনের লোক আসে। এদের মধ্যে সাহায্যপ্রার্থী আসেন, ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য তহবিল সংগ্রাহক আসেন, চল্লিশ বছরের ভদ্রমহিলা, যাঁর সন্তানের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আর যাঁর স্বামী আরেকটা বিয়ে করে ফেলেছেন, তিনি আসেন, কোনো রকমের জ্বালানি ছাড়াই যে ইঞ্জিন চলে, তার আবিষ্কারক আসেন, অ্যাটম বোমার সুইচ আছে যে বৃদ্ধের কাছে, তিনি আসেন, আর মাত্র সাত দিনে দেশের মুদ্রাস্ফীতি দূর করে দেবেন যিনি, তিনিও আসেন।
আরেকজন এসেছেন। এই ভদ্রলোক গল্প চান। না, লিখিত গল্প না, গল্পের প্লট।
কত লোকে রাজউকের প্লটের জন্য দরখাস্ত করে, আর তিনি ধন নয়, মান নয়, এতটুকু বাসা নয়, একটা গল্প চান।
আমি বলি, মশিউলকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। উনি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ গল্পকারদের একজন। আপনি তাঁকে প্রথমেই বলবেন, আপনার গল্প আমার খুব ভালো লাগে, আপনার ‘মাংসের কারবার’ বইটা আমি পড়েছি, আমার ভালো লেগেছে, এর পরে আলাপ শুরু করবেন। দেখবেন মশিউল আপনাকে সময় দেবেন।
তাড়াতাড়ি করে অফিসের ভেতরে ঢুকে যাই।
গল্পপ্রার্থীর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করি।
মশিউল আলম আমার সহকর্মী। তিনি আমাদের পত্রিকার সহকারী সম্পাদক এবং ভুবনবিখ্যাত গল্পকার। তাঁর গল্প শবনম নাদিয়া নামের একজন বাংলাদেশি আমেরিকান লেখক অনুবাদ করে প্রকাশ করেছেন। এর বাইরে তিনি উপন্যাস লিখে নিউ ইয়র্ক প্রবাসী খ্যাতিমান সাহিত্যবোদ্ধা হাসান ফেরদৌসের প্রশংসা অর্জন করেছেন।
মশিউল আলম বয়সে আমার চেয়ে এক বছরের ছোট। এই একটা বছরের কনিষ্ঠতা তাঁকে আমার সমস্ত অন্যায়-অত্যাচারের টার্গেটে পরিণত করেছে। এর আগে এক মহিলা এসেছিলেন, তিনি বলতেন, রাতের বেলা তিনি ঘুমান না, ঘুমালেই কেউ না কেউ তাঁকে বালিশচাপা দিয়ে মারবে। পত্রিকায় তিনি তাঁর বিরুদ্ধে পৃথিবীব্যাপী বিছানো ষড়যন্ত্রের জালের কথা ছাপাতে চান। আমি মশিউল আলমের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিই। ভালো গল্পের ভালো একটা প্লট পাওয়া যাবে ভেবে মশিউল আলম ভদ্রমহিলাকে অনেক সময় দিয়েছিলেন।
আমি মশিউলের ডেস্কে যাই। মশিউল, একজন গল্পকার এসেছেন, খুব সাহিত্যবোদ্ধা মনে হলো, তোমার লেখার বিশেষ রকমের ভক্ত, তোমাকে খুঁজছিলেন, যাও, রিসেপশনে যাও। আমি হাসি গোপন করে বলি।
একটু পরে রিসেপশন থেকে ইন্টারকমে ফোন আসে মশিউলের কাছে। আপনার কাছে গেস্ট এসেছে।
মশিউল একটা কাচের গেলাসে গরম পানি নিয়ে তার মধ্যে একটা গ্রিন টির ব্যাগ ভাসিয়ে কেবল এক চুমুক মুখে দিয়েছেন, এ অবস্থায় গেলাস হাতেই তিনি রিসেপশনে যান।
খানিক পরে কৌতূহল গোপন রাখতে না পেরে আমিও ভিজিটরস রুমে হাজির হই।
মশিউল দেখি তাঁর সঙ্গে সিরিয়াসলি গল্প করছেন।
আপনি গল্প চান না?
জি, গল্প চাই। মানে আমি একটা গল্প লিখব। তার কাহিনি চাই।
কার কাছ থেকে চান।
আপনার কাছ থেকে।
আমার কাছ থেকে কেন?
কারণ আপনি আমার প্রিয় গল্প লেখক।
তাহলে আমি আপনাকে আমার লেখা একটা গল্প দিই। আপনার ই-মেইল অ্যাড্রেস দিন।
না, আমি আপনার লেখা গল্প চাই না। আমি আমার লেখা গল্প চাই।
মশিউল অসহায়ভাবে হাসেন। বলেন, ভাই, আপনার গল্প আমি কিভাবে দেব।
আপনি আমাকে একটা গল্পের আইডিয়া দেন। আমি সেটা শুনে নিজে লিখব।
আমার আইডিয়া নিয়ে আপনি লিখবেন কেন? আমার আইডিয়া নিয়ে আমি লিখব। আপনার আইডিয়া নিয়ে আপনি লিখবেন।
না, আমার কোনো আইডিয়া নাই। আমার মধ্যে কোনো গল্প আসে না।
তাহলে আপনি লিখবেন না। সবাইকে কেন লিখতে হবে। যার মধ্যে গল্প আসে, সে লিখবে। আপনার মধ্যে গল্প আসে না, আপনি লিখবেন না।
না, আমাকে গল্প লেখক হতে হবে।
কেন?
কারণ আমার স্ত্রী গল্প লেখককে পছন্দ করে।
আপনার স্ত্রী গল্প লেখককে পছন্দ করে? মশিউল কৌতূহলী হন।
আমি তখন দরজার পাশ থেকে উঁকি মারি। বলি, হ্যাঁ হ্যাঁ, ভাবির প্রিয় লেখক মশিউল আলম। তাই ভাই এসেছেন, মশিউলের কাছ থেকে গল্প লেখার টিপস নিতে।
না, ব্যাপার তা না। ভদ্রলোক বলেন।
ব্যাপারটা তাহলে কী? আমি বলি।
ব্যাপার হলো, ভদ্রলোক এদিক-ওদিক তাকান। তারপর বলেন, আপনি ক্রসফায়ারের কথা শুনেছেন।
হ্যাঁ, শুনেছি।
আমার স্ত্রী ক্রসফায়ারের গল্প বিশ্বাস করে না।
মশিউল বলেন, আমরা কেউই বিশ্বাস করি না।
আমার স্ত্রী বলেন, ভালো গল্পকাররা এমন গল্প বানায় যে সবাই বিশ্বাস করে। তিনি একটু কেশে গলা ঠিক করে বলেন।
আমি বলি, হ্যাঁ, ভালো গল্প বানানো হলেও লোকে বিশ্বাস করে।
মশিউল বলেন, আর খারাপ গল্প সত্য হলেও কেউ বিশ্বাস করে না।
আমার স্ত্রী বলেছেন, তুমি গল্পকারদের কাছে যাও—ভদ্রলোক বলেন। তাঁর চশমার ফ্রেম সোনালি রঙের। তাঁর দুটো কানের মধ্যে সিমেট্রি নাই। আমি তাঁর দিকে ভালোভাবে তাকাই।
তিনি বলেন, ক্রসফায়ারের গল্প আমার স্ত্রী বিশ্বাস করে না। আমাকে একটা ভালো গল্প দেন। ক্রসফায়ারের গল্প, যেটা বিশ্বাসযোগ্য হবে।
তাহলে কী হবে?
তাহলে আমার স্ত্রী মেনে নেবে যে সে বিধবা হয়েছে। তাহলে সে সাকসেশন সার্টিফিকেট বের করবে। আমার ব্যাংকের টাকাগুলো পাবে। আমার জমিটা বিক্রি করতে পারবে।
আমি মশিউলের দিকে তাকাই। মশিউল আমার দিকে তাকান।
মশিউল বলেন, দাঁড়ান দাঁড়ান। আপনার স্ত্রী বিধবা হয়েছে, আপনি বলছেন।
জি। তিনি চশমাটা হাতে নেন। তার চোখের কোণে জল।
মশিউল বলেন, তার মানে আপনি মারা গেছেন।
ভদ্রলোক উদাসভাবে বলেন, ঘটনা তো সেই রকমই।
তাহলে আপনার স্ত্রী বিশ্বাস করছেন না কেন? মশিউল সিরিয়াস মুখে বলেন। মশিউল কি রসিকতা করছেন?
আমি বুঝতে পারছি, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা এক ভদ্রলোক আমাদের কাছে এসেছেন।
মশিউল আলম তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন, কারণ তিনি নিজে একটা গল্পের প্লট পেয়ে গেছেন। চরিত্র তাঁর সামনে আছে। যে নিজেকে ক্রসফায়ারে নিহত বলে কল্পনা করে। এমন একটা চরিত্র নিয়ে গল্প লিখতে পারলে সেটা নিশ্চয়ই হিট করবে।
আমি বলি, মশিউল, তুমি গল্পের প্লট পেয়েছ, তাইতো। গল্প লিখবে। লেখো।
মশিউল বলেন, আনিস ভাই, আসেন, আপনি আর আমি দুজনেই একই চরিত্র নিয়ে গবেষণা করি। একই প্লট নিয়ে নাড়াচাড়া করি। তারপর আপনি একটা গল্প লেখেন, আমি একটা গল্প লিখি। দুজনেরটা দুরকম হবে। দেখা যাক, কারটা কেমন হয়। আসেন, বসেন।
আমি বলি, না মশিউল, আমি এই গল্প শুনব না।
কেন শুনবেন না? মশিউল তাঁর গ্রিন টিতে চুমুক দিয়ে বলেন।
আমি বলি, তুমি জানো, আমি নিজেও গল্পের সংকটে ভুগছি। এই গল্প পেলেই আমি লিখে ফেলব। পরে আর সেটা সামলাতে পারব না।
কেন পারবেন না।
আমি বলি, এটা ডেঞ্জারাস একটা সাবজেক্ট।
মশিউল হাসেন। মোটেও না। আমরা তো কারো কোনো সমালোচনা করব না। আমরা বরং জাতিকে গল্প-সংকট থেকে রক্ষা করব। এই জাতি গল্পের সংকটে ভুগছে। তাদের ক্রসফায়ারের গল্পগুলো সব এক রকম। একটু ভিন্নতা দরকার। আপনি লিখলে নতুন গল্প পাওয়া যাবে। আমি লিখলেও নতুন গল্প হবে। হুমায়ূন আহমেদ থাকলেও লিখতে পারতেন।
আমি বলি, মশিউল, তুমি তাঁকে বিদায় দাও।
এর মধ্যে আমাদের সম্পাদক আসেন। আমাদের দুজনেরই ডাক পড়ে। মশিউল আগন্তুককে বিদায় জানান।
আমরা মিটিংয়ে বসি।
গল্পপ্রার্থী লোকটির কথা আমরা ভুলে যাই।
পরের দিন সকালে আমার ঘুম ভাঙে মশিউল আলমের ফোনে। আনিস ভাই, কাগজ দেখেছেন।
কোন কাগজ?
আরে আমাদের কাগজ।
কেন, কী হয়েছে?
ক্রসফায়ারের নিউজ ছাপা হয়েছে। নিহত ভদ্রলোকের ছবিও ছাপা হয়েছে। দেখেন।
আমি তাতাতাড়ি চোখ কচলে দরজার কাছে যাই। দরজার নিচে কাগজ পড়ে আছে। লাইট জ্বালিয়ে চশমা চোখে দিয়ে পত্রিকার পাতা ওল্টাই।
আবার ফোন। মশিউল আলমের। আনিস ভাই, দেখেছেন?
কত পৃষ্ঠায়?
পেজ সাত।
আমি পেজ সাতে যাই। সত্যিই সেই ভদ্রলোক। লম্বা, শুকনো, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, কান দুটো অসমান।
তিনি পরশু রাতে ক্রসফায়ারে মারা গেছেন।
মশিউল ফোনে বলেন, বুঝলেন। লোকটা মারা গেছে পরশু।
হুঁ।
আর আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছিল কাল।
হুঁ।
আমরা অফিসের সিসিটিভির ফুটেজ দেখি। সিসিটিভির ফুটেজে কোনো দলিল নাই, কোনো রেকর্ড নাই যে এই রকমের কোনো লোক আমাদের অফিসে এসেছিল।
এইবার আমি ভয় পাই।
আমি ভেবেছিলাম কাগজে ভুল লোকের ছবি ছাপা হয়েছে। তা হতেই পারে। কিন্তু আস্ত একটা লোক সিসিটিভি থেকে উধাও হয়ে গেল। ঘটনা কী?
pপরীক্ষামুলক