আমার মা ও আমার মেজোফুপুর পেটের ওপর যাদের নজর পড়েছে এবং যারা বছরের পর বছর কাছে থেকে কিংবা দূরে থেকে এ দুজনকে দেখেছে, তারা নির্ঘাত্ মনে করেছে—এই দুই নারী গর্ভবতী হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
এটা সত্য, স্বামীর অনুপস্থিতি এবং স্ত্রীর মাসিকচক্র—এ দুটি কারণে প্রতিযোগিতা ঠিক একই সময়ে শুরু হতে পারেনি, দু-এক সপ্তাহ এদিক ওদিক হয়ে গেছে। দুজনেরই হিসাব অনুযায়ী আমার ভূমিষ্ট হওয়ার কথা উম্মুল ওয়ারার অন্তত দু’সপ্তাহ পরে, কিন্তু নির্ধারিত সময়েরও অন্তত দেড় মাস আগে হঠাত্ ব্যথা ওঠায় আমার মাকে হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং কিছুটা প্রি-ম্যাচিউর বেবি হিসেবে আমি বেরিয়ে আসি। আমি তখনই চোখ খুলতে পারিনি, আমাকে সপ্তাহ তিনেক ইনকিউবেটরে লালন করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সক্রিয় হওয়ার পর বাড়ি আনা হয়। তখনো চোখ পুরো ফোটেনি।
বয়সের হিসাবটা যেহেতু জন্মের পর থেকেই শুরু হয়, সেটা মেনে নিলে আমিই বড়। আর ভ্রূণ সৃষ্টির ইতিহাস অনুসরণ করতে পারলে দেখা যাবে আমিই ছোট। কিন্তু সবাই জানে, আমিও জানি, উম্মুল ওয়ারা আমার চেয়ে তেত্রিশ দিনের ছোট। সুন্দর, গোলগাল, কোঁকড়া চুলের এই মেয়েটির ওপর আমার চোখ পড়ার কথা। চোখ পড়েছিল ঠিকই, কিন্তু তার গায়ে হঠাত্ কোন জাদুকরী বাতাস লাগল এবং মেয়েটি চোখের পলকে দেখতে আরো বড় এবং আরো সুন্দর হয়ে আমার হাতের বেষ্টনির বাইরে চলে গেল।
মেয়েদের বেলায় এমনটাই হয়—একই বয়সী ছেলেটা দীর্ঘদিন নাবালকই রয়ে যায়। কিন্তু মেয়েটা তখন নারী।
উম্মুল ওয়ারা তখন এতটাই বড় আমি চোখ তুলে তার চোখের দিকে তাকাতে পারি না, তাকিয়ে থাকি তার পায়ের পাতায়, বড়জোর সালোয়ার ভেদ করে আসা তার হাঁটুর আভাসের দিকে।
উম্মুল ওয়ারার এই বিকশিত হয়ে ওঠা আমার ছোটভাই সৈয়দ আব্দুল মোক্তাদিরকে কিছুটা ঝামেলায় ফেলে থাকতে পারে। দু-তিন বছর আগেও এই মেয়েটিকে ক্যাডবারি মিল্ক চকলেট বার কিংবা প্রাণের আমস্বত্ব আর তেঁতুলের আচার কিনে দিয়েছে, কিন্তু বড় হওয়ার অপরাধে মোক্তাদির তার ওপর চোখ পড়লেই মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে, দ্রুত তার কাছ থেকে সরে যেতে থাকে।
উম্মুল ওয়ারা একদিন তাকে ধরে বসে, ‘দাঁড়াও, এক পা-ও নড়বে না। আগে আমার কথার জবাব দাও।’
আব্দুল মোক্তাদির ঘাবড়ে যায়। বলে, ‘আমার কাজ আছে।’
উম্মুল বলে, ‘আমি তোমার কাজের গুষ্টি কিলাই। আমাকে দেখলে তুমি বিড়বিড় করে কী বলো আমি শুনতে চাই।’
‘কিছু না, এমনি আমার ঠোঁট নড়ে।’
‘অন্য কাউকে দেখলে নড়ে না ক্যান?’
কোনো জবাব নেই।
মোক্তাদির দ্রুত অন্যদিকে চলে যেতে চায়।
উম্মুল ওয়ারা দু’হাত বাড়িয়ে তার পথ আগলে ধরে। বলে, ‘তুমি একটা মিথ্যুক। জানো তো, মিথ্যুকরা জাহান্নামের আগুনে জ্বলে। তুমি জ্বলতে না চাইলে সত্যি করে বলো, যখন বিড়বিড় করো আমাকে নিয়ে কী বলো? আমাকে কি গালি দাও?’
‘না, আমি অস্তাগফিরুল্লাহ পড়ি।’
‘মানে তুমি আমাকে নিয়ে কিছু বলো না?’
‘আমি মনে মনে একশবার অস্তাগফিরুল্লাহ পড়ি। আমি একশ’বার বলি, আল্লাহ তুমি আমাকে সাহায্য করো। অস্তাগফিরুল্লাহর মানে আল্লাহ তুমি আমাকে সাহায্য করো।’
‘আব্দুল মোক্তাদির তুমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলো। তুমি সত্যি করে বলো, আমাকে দেখলে তোমার আল্লাহর সাহায্যের দরকার হয় কেন? আমার মন্টু ভাই তো খুব রাগী মানুষ, তুমি কি তাকে দেখলে একশ’বার অস্তাগফিরুল্লাহ বলো?’
‘না।’
‘পঞ্চাশ বার?’
‘না।’
‘একবার?’
‘না।’
‘আমার বড় বোন উম্মুল হুসনাকে দেখলে পড়ো?’
‘না।’
‘আমার ছোটবোন উম্মুল ফাতিমাকে দেখলে পড়ো?’
‘আমার কাজ আছে। আমি যাই।’
‘যাও, আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চলে গেলেই পারো। আমি তো গায়ের জোরে তোমার সাথে পারব না। যাও, ধাক্কা দাও।’
আব্দুল মোক্তাদির স্বরে কৃত্রিম গাম্ভীর্য এনে বলল, ‘বালেগ নারীর অঙ্গ স্পর্শ করতে নেই।’
‘বালেগ নারী আবার কী জিনিস?’
মোক্তাদির চুপ করে থাকে। উম্মুল ওয়ারা আবার জিজ্ঞেস করে, ‘আমাকে দেখলে তোমার অস্তাগফিরুল্লাহ কেন পড়তে হয়? বালেগ নারী মানে কী?’
‘আল্লাহ সুবহানাল্লাহুতায়ালার সাহায্যের জন্য অস্তাগফিরুল্লাহ পড়ি।’
‘সেটা তো আগেই একবার বলেছ। আমি কারণটা জানতে চাচ্ছি। এটা কি শুধু আমাকে দেখলেই পড়তে হয় নাকি আমার মতো এমন আরো দু-একজন আছে?’
‘না, আর কেউ নেই।’
‘এবার কারণটা বলো?’
‘তোমাকে দেখলে আমার ওপর খান্নাস ভর করে। আমার মনে মন্দ ভাব জাগে। আমি সে-জন্যই অস্তাগফিরুল্লাহ পড়ি।’
এভাবেই উম্মুল ওয়ারার জন্য সৈয়দ আবদুল মোক্তাদিরের দুর্বলতা একটু একটু করে প্রকাশ হয়ে পড়ে। খান্নাস আরো শক্ত করে তাকে চেপে ধরে। সে ধর্মীয় বিধিবিধান মেনেই তার সাথে প্রেম করতে চায়।
এবার উম্মুল ওয়ারা বলে, ‘তোমার মতো নাবালকের সাথে কে প্রেম করে?’
‘আমি নাবালক নই।’
‘বিশ্বাস করি না।’
‘বালেগ তরুণের সকল বৈশিষ্ট্যই আমার আছে।’
‘যেমন?’
কী উত্তর দেবে আবদুল মোক্তাদির, কিছুক্ষণ ভাবল কিন্তু জুতসই জবাব খুঁজে পেল না। হঠাত্ আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে উম্মুল ওয়ারাকে জাপটে ধরল। চুমু খেতেও চেষ্টা করল।
উম্মুল শুরুতে নিজেকে তার ওপর ছেড়ে দিলেও পরে দরকষাকষি করার কথা ভেবে ধীরে ধীরে তাকে প্রতিহত করতে থাকল। হঠাত্ ছিটকে তার হাতের বেষ্টন থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ‘আমি রাজি তবে মাত্র দুটি শর্ত আছে।’
‘মাত্র দুটি?’
‘হ্যাঁ, মাত্র দুটি। মানবে কি না বলো?’
‘অবশ্যই, কিন্তু দুটির বেশি নয়।’
‘হ্যাঁ, এক নম্বর হচ্ছে, স্মার্ট পোশাক পরতে হবে, আর দু’ নম্বর গোঁফ রাখতে হবে। নিজে থেকে তুমি এ দুটো শর্ত মানলেই হবে, বাকিগুলোর জন্য তোমার কিছু করতে হবে না, আমিই ঠিক করতে পারব। যেমন ধরো, চুলে তেল দেওয়া। মানুষের সামনে দাঁত খিলাল করা—এসব অভ্যাস ঠিক করতে আমার বড়জোর দু’সপ্তাহ লাগবে।’
সেদিনের পুঁচকে মেয়েটির কথা শুনে আবদুল মোক্তাদির দীর্ঘক্ষণ উম্মুল ওয়ারার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
‘তুমি কি আমার সহজ বাংলা কথা বুঝতে পারনি?’
‘পেরেছি এবং শুকুর আলহামদুলিল্লাহ, আমি সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছি। যেটুকু সময়ের জন্য আমার ওপর খান্নাসের আছর হয়েছিল তার জন্য আল্লাহতায়ালার কাছে ক্ষমা চেয়েছি। এমন আর কখনো করব না।’
উম্মুল ওয়ারা বলল, ‘তার মানে তুমি মনে মনে বিয়ের তারিখও ঠিক করে ফেলেছ? বিয়ে না করে আমাকে আর এভাবে ধরবে না, তা-ই তো? থ্যাঙ্ক উ ভেরি মাচ, আমিও তা-ই চাই।’
‘তোমার জন্য রহমানিয়া ইয়াতিমখানায় রেহেলসহ একখানা কোরআন বকশিস করব, দোয়া নিজে করব এবং আল্লাহকে ডাকব, তিনি যেন তোমাকে ও আমাকে হেদায়েত করেন।’
‘তার মানে কী?’
‘মানে খুব সহজ। দুনিয়াজাহানের এক তিল সুখের জন্য আমি আমার আখেরাতের অনন্ত জীবন মাটি করে দিতে পারি না। অস্তাগফিরুল্লাহ, অস্তাগফিরুল্লাহ, অস্তাগফিরুল্লাহ। খান্নাসের ওয়াসওয়াসা থেকে আল্লাহতায়ালা আমাকে রক্ষা করবেন। আমি আমার লেবাস বদল করব না, আমি বরাবরই বালেগ নারীর কাছ থেকে নিজেকে দূরে রাখব—আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।’
ক্রোধে বিস্ফোরিত উম্মুল ওয়ারা নিজেও তার দিকে এক মিনিট ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে হঠাত্ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘তোর মতো পাগলের সাথে কে প্রেম করে? তোর মতো পাগলকে কে বিয়ে করে? তুই নিজের জন্য তোর মতো উজবুক কোনো মেয়ে না পেলে নিশ্চয়ই বিয়ে করবি না।’
মোক্তাদির জিজ্ঞেস করে, ‘মানে?’
‘মানে খুব সহজ। তুই একটা উন্মাদ। তুই একটা বদ্ধ উন্মাদ। তুই ভবিষ্যতে আর আমার সামনে পড়িস না। আমার সামনে পড়লে আমি দড়িতে বেঁধে তোকে পাবনার হেমায়েতপুর পাগলা গারদে দিয়ে আসব, মনে রাখিস। তুই তো বিয়ে না করে আমার গায়ে হাত দিয়েছিস—এজন্য আমিও আল্লাহ তায়ালার কাছে নালিশ জানাব।’
‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া রহমাতুল্লাহ।’ বলে উম্মুল ওয়ারাকে সালাম জানিয়ে আবদুল মোক্তাদির তখনই তার ঝোলাটি নিয়ে দীনের দাওয়াত দিতে বেরিয়ে যায়।
একবার ঝোলা নিয়ে বেরোলে কমপক্ষে একুশ দিন পর ফেরে। তার জন্য আগে সবারই দুশ্চিন্তা হতো—কোথায় থাকবে, কী খাবে। আব্দুল মোক্তাদির নিজেই আশ্বস্ত করেছে, খোদার দুনিয়ায় থাকার জায়গার কোনো অভাব নেই। মরুভূমিতে মানুষ বাস করে, বরফের দেশেও মানুষ বাস করে, আল্লাহর রহমত, এদেশের আবহাওয়া অতিশয় উত্তম— না শীত না উষ্ণ, যেখানে খুশি ঘুমিয়ে পড়া যায় আর খাবারের চিন্তা করে কেবল ইতর প্রাণী।
মেয়েটি চিত্কার করে সে বলে, ‘তোর যেখানে ইচ্ছে শুয়ে থাকিস, আমাকে কখনো তোর সাথে পাবি না।’
আর আমি সম্ভবত ইতর প্রাণীকূলের একটি। কেবল খাবার গ্যারান্টি নেই বলে ইচ্ছে থাকার পরও বাড়ির বাইরে দিন কাটানোর সাহস পাইনি। আর এখন তো প্রশ্নই আসে না।
সেই সন্ধ্যায় উম্মুল ওয়ারা আমাকে বলে গেল, ‘তোর ওই গাধা ভাইটাকে আমি জনমের শিক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দেখিস, বাকি জীবন সে শুধু চোখের পানি মুছবে।’
কিন্তু কিভাবে? চোখে এমন কোনো জখম করবে যে সারাজীবনই চোখ গড়িয়ে পানি নামবে?
পরদিন সকালে জানলাম, আত্মহত্যা করার জন্য উম্মুল ওয়ারা নতুন কেনা পুরো এক বোতল স্যাভলন খেয়েছে, কিন্তু মৃত্যু না হওয়ায়, কেবল চিত্কার করেছে, ‘আমি মরি না কেন! আমি মরি না কেন!’
মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের বাইরের একটি ভ্যাপসা কক্ষে বেডের সাথে হাত-পা বেঁধে মুখের ভেতর পানি ঢুকিয়ে তাকে ওয়াশ করা হলো। বেঁচে গেল উম্মুল ওয়ারা। আর ঘরে সযত্নে লেখা একটি চিরকুট পাওয়া গেছে। তাতে লেখা, ‘আমার মৃত্যুর জন্য সৈয়দ আবদুল মোক্তাদিরকে দায়ী করিতে চাহি না। কারণ সে এখনো সাবালক হয় নাই। ইতি উম্মুল ওয়ারা।’
দুই
আমার নিজের তেমন কথা নেই। আমার তেমন কিছু করারও নেই। তাই লিখি। কী লিখি? যা দেখি তাই লিখি। যাদের দেখি তাদের কথা লিখি। যাদের দেখি তাদের সবাই আত্মীয়স্বজন। কদাচিত্ দু-একজন বন্ধুবান্ধব। আবার এটাও সত্য সেই যে চোখ ফোটার আগেই জন্মেছি, রেশটা রয়েই গেছে, এখনো সব দেখি না, কিছু কিছু কেবল দেখি। আমার চশমা বাইরে থেকে দেখলে ম্যাগনিফাইয়িং গ্লাসই মনে হবে। মাঝে মাঝে ভালোও লাগে, ভাগ্যিস সবটা দেখি না।
আমার আব্বুর কথা লিখতে চাই।
আব্বুর নাম আল আমিন।
আল আমিন মানে সত্যবাদী। আব্বুর নাম আসলে মুন্সি আল আমিন। বিদেশ ফেরত আমাদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় তার নামটা এডিট করেন। বলেন, ‘মুন্সি-মোল্লা এসব আইয়ুব খানের রাজত্বে অচল। নামটা একটু পাকিস্তানি ধাঁচের হতে হবে।’ তিনিই ঠিক করে দিলেন সৈয়দ আবদুল্লাহ আল আমিন। কিন্তু সবার স্মৃতিতে মুন্সিটাই রয়ে গেল। নতুন নামটা কেউ গ্রহণ করল না। সে রাতেই আল আমিন এই আত্মীয়ের পকেট থেকে টাকা সরায় এবং ধরাও পড়ে। ক্ষুব্ধ আত্মীয় অন্যদের শুনিয়ে বলেন, ‘এই বয়সেই বাইরের মানুষের পকেট হাত দিতে শিখেছে, বড় হলে তো বাপ-মায়ের কলজে টেনে বের করবে!’ আব্বুদের ছোটবেলার কাহিনি তো আমার জানার কথা নয়। সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে আব্বুদের ছোটবেলার গল্প করে থাকে তাদের আব্বু ও আম্মু। আমার দাদি খুব অহংকার করে বলেছেন, ‘আমার সেই ছেলে বড় হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে চোরদের জেলে ঢুকিয়েছে।’
আমার আব্বুর নামের শুরুতে মুন্সি থাকলেও, আমাদের নামের আগে সৈয়দ বসানো হয়েছে, এবার সৈয়দটা এসেছে তার সংশোধিত নাম থেকে।
আমার আব্বু প্রমোশন পেতে পেতে অনেক উপরে উঠেছিল, আর একটু হলেই শিখরে পৌঁছাতে পারত।
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সচিবদের স্যুট-টাই পরা রঙিন ছবি দেশের গুরুত্বপূর্ণ সবক’টি দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হয়েছে—বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পাতায়, কয়েকটির শেষের পাতায়। একই কোম্পানির একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি পত্রিকা হাতে নিয়ে আব্বু ছবিগুলো খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, শুরুতে কপাল কুঁচকানো ছিল, ছবি দেখা শেষ হলে আব্বুর চেহারাতে আলো ঝলসে উঠল। আব্বু আনন্দে সদ্য ছোলা খাওয়া ঘোড়ার মতো চিঁহিচিঁহি শব্দ করে উঠল। আমার আব্বুর আনন্দ প্রকাশের ধরনটা অন্যদের চেয়ে ভিন্ন।
বহু সংখ্যক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার মাত্র ক’জনের ছবি ছাপা হয়েছে, কারণ পদমর্যাদায় তারা অন্যদের উপরে।
আমার আব্বুর শুরুতে কপাল কুঁচকানোর কারণটা কী?
আবার ছবি দেখা শেষ হলে হাসির ঝিলিক কেন?
আব্বু কপাল কুঁচকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে যাদের ছবি ছাপা হয়েছে, তাদের মধ্যে সৈয়দ মুকাররম আলী নেই তো? কিংবা ইমাম হোসেন?
সৈয়দ মুকাররম সচিব হয়েছেন। কিন্তু যথেষ্ট ধরাধরি করার পরও ইমাম হোসেন ততদূর এগোতে পারেননি। তার শ্বশুর বিরোধী দলের দু নম্বর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্টের বেয়াই। এই আত্মীয়তার সূত্র পদোন্নতির সময় তার বিপক্ষে গেছে। দুজনের কারো ছবিই নেই। দুজনেরই মুক্তিযোদ্ধা পরিচিতি রয়েছে কিন্তু কেউই মুক্তিযোদ্ধা নন।
আব্বু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, এ দুজনকে আর কেউ জিজ্ঞাসাবাদ করবে না। এটা এমন কোনো অপরাধ নয় যে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করবে— কোন সেক্টরে, কোন সাব সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন? কে ছিল প্লাটুন কমান্ডার? সে সময় কি আপনি আর্জেস গ্রেনেড ব্যবহার করতেন, তাই না? আচ্ছা বলুন তো থ্রি নট থ্রি মানে আসলে কী? আপনি কি কখনো একে ফর্টি সেভেন হাতে নিয়েছেন?
সৈয়দ মুকাররমের সাথে আব্বুর বন্ধুত্বে চিড় ধরেছিল আম্মুকে বিয়ে করা নিয়ে। অধিকতর যোগ্য হলেও তার নামের শুরুর সৈয়দ নিয়ে আমার নানা যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন। সৈয়দ মুকাররমের বাবা সৈয়দ বংশজাত নন, তার বাবার নাম ছিল সৈয়দুদ্দিন। সেখান থেকেই সৈয়দ।
আমার নানার এই প্রত্যাখ্যান এবং অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত (বিএ, সেকেন্ড ক্লাস) পাত্রের কাছে কন্যা সমর্পণ তাকে ক্ষুব্ধ করারই কথা। নারী ঘটিত কারণে দু বন্ধুর সম্পর্ক আলগা হয়ে যায়। দুজন সদ্য বিসিএস তখন একই স্টেশনে। দুজনেরই পেশকার আমার নানা হাতেম আলী পেশকার। পেশকারের মেয়েদের ম্যাজিস্ট্রেটের সাথেই বিয়ে হয়। পেশকার জানেন এই অফিসারটা অনেকদূর যাবেন। পেশকার জীবনের শুরুতে যাদের পেয়েছেন তাদের একজন কেবিনেট সেক্রেটারি এবং মন্ত্রীও হয়েছেন।
সৈয়দ মোকাররম আমার আব্বুর বিয়েতে হাজিরা না দিয়ে তার ক্রোধ আরো প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
হাতেম পেশকার মেয়েদের গান ধরিয়ে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। জেলা শহরে নতুন নিয়োগ পাওয়া অবিবাহিত ম্যাজিস্ট্রেটদের বাড়িতে দাওয়াত করে খাওয়াতেন। মেয়েদের ডাকতেন হারমোনিয়ম বাজিয়ে গান শোনাতে। প্রত্যেকেরই সবশুদ্ধ দুটো কি তিনটা গান বাজাতে কোন রিডের পর কোনটাতে চাপ দিতে হবে তা মুখস্থ থাকত। আমার বড়খালা অদ্ভুত উচ্চারণে নাকি সুরে গাইতেন : একটা গান ‘লিক’ আমার জন্য/ না হয় আমি তোমার কাছে ‘চিলেম’ অতি নগণ্য।
আমার মেজোখালার গানটি নজরুলের, ‘আমায় নহে গো, ভালোবাস শুধু, ভালোবাসো মোর গান/ বনের পাখিরে কে চিনে রাখে গান হলে অবসান’।
এই গান শুনে আমার মেজো খালু আগা সাদেক খান বলেছিলেন, ‘আপনি একটুও চিন্তা করবেন না, এই আগা সাদেক বনের পাখিটাকে ভুলে যাওয়ার মানুষ নয়।’
আমার বড়খালু গান শুনে কী বলেছেন আমার জানা নেই, তবে বিয়ের পর তিনি বড়খালাকে গান গাইতে দেননি। বড় খালা শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে একবারই গান গেয়েছেন, তার গান শুনে মুখটেপা হাসাহাসি শুরু হয়ে যায়। বড়খালু বলেছেন, ‘আগে গানের কথাগুলো ভালো করে উচ্চারণ করতে শেখো। তাছাড়া গলায় তো সুরও থাকতে হবে, তবেই তো গান।’
বড়খালা বেঁচে গেছেন। হারমোনিয়ামের কোন রিডের পর কোনটাতে আঙুল টিপবেন—দুটি গানেই তিনি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন, তার স্বামী তাকে বাঁচিয়েছেন।
আমার আম্মু গেয়েছে পাকিস্তান আমলের বাংলা সিনেমার গান :যার ছায়া পড়েছে, মনের আয়নাতে/ সেকি তুমি নও, ওগো সেকি তুমি নও।
তার উচ্চারণে ত্রুটি ছিল না। লেগে থাকলে আরো দু-চারটা গান গাইতে পারত, লেগে থাকেনি।
তিন
আমার ছোটখালা হাতেম আলী পেশকারের মরণোত্তর চেহলামের রাতে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। বড়খালু সকলকে আশ্বস্ত করেন, ‘আমি পাপড়িকে খুঁজে বের করবই। যাবে কোথায়? আমার চোখ ফাঁকি দেওয়া এত সোজা নয়।’
চেহলামের পরদিনই বড় খালু নয় মাসের একটি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্স করতে আমস্টারডাম চলে যান।
পাপড়ি খালার গায়েব হওয়া নিয়ে থানা-পুলিশ করলে নিজেদের মানসম্মান নিয়ে কথা উঠবে এই আশঙ্কায় সতের কি সাড়ে সতের বছর বয়সী একটি মেয়ের প্রসঙ্গ পরিবারের আলোচনা থেকে বাদ পড়তে থাকে। মাঝে মাঝে বড়খালাই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন, ‘আমার আদরের বোনটা, আমার অবুঝ বোনটা!’
কোর্স শেষ হওয়ার পর ইউরোপের আরো কয়েকটি দেশ ঘুরে বড়খালু আব্দুল সোবহান যখন ঢাকায় অবতরণ করলেন, তার সাথে তিনটি বড় আকারের স্যুটকেস এবং সাড়ে ছয় কি সাত মাসের গ্রেগন্যান্ট এক তরুণী—আমার পাপড়ি খালা।
বড়খালা গর্ভবতী পাপড়িকে দেখে বার দুয়েক অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। বড়খালু বারবার বলেছেন, ‘রেহানা টেইক ইট ইজি, টেইক ইট ইজি!’ কিন্তু রেহানা এটা সহজভাবে নেননি, উল্টো বলেছেন নুন খাইয়ে পাপড়ির বাচ্চাকে মেরে ফেলবেন।
পাপড়ির সন্তানের নিরাপত্তার জন্য আবদুস সোবহান সেগুনবাগিচায় দুই রুমের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করেন। ইস্কাটনের সরকারি বাড়িতে রেহানা রয়ে যান। দুই স্ত্রী সামলাতে দক্ষ হয়ে ওঠা আবদুস সোবহান যুগ্ম-সচিব হয়েই তার পিএ লুলু বিলকিসকে বিয়ে করে ফেলেন।
আমার আব্বু বলেছে, ‘কপাল নিয়ে জন্মেছে সোবহান। দুই বউ যে সামলাতে পারে, তার কাছে তিন বউ সামলানো কোনো ব্যাপারই না।’
আব্বু জোর দিয়ে আমার আম্মুকে বলেছে, ‘আমার অবস্থাটা ভেবে দেখো—এখনো তোমাকে নিয়েই আছি।’
সৈয়দ মুকাররম পেশকারের মেয়ে হারালেও মর্যাদার লড়াইয়ে জিতেছেন, তার শ্বশুর সরকারি দলের এমপি। এই জেলারই একজন হেভিওয়েট এমপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ায় তিনি বড় কিছু পাননি। কিন্তু পেতে কতক্ষণ। তারপরও পেশকারের মেয়েকে বিয়ে করতে না পারার ক্ষতটা রয়েই গেছে।
আর ইমাম হোসেনের সাথে দ্বন্দ্বের পেছনে কোনো নারী নেই। তিনি যখন রিলিফ দফতরের ডিজি, তাকে সরিয়ে আমার আব্বুকে সেখানে দেওয়া হয়। তিনি ধরে নেন আব্বুই ষড়যন্ত্র করে কাজটা করিয়েছে, সুতরাং পরিণত বয়সে তাদের সম্পর্কে চিড় ধরে।
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের যে ক’জনের ছবি ছাপা হয়েছে তাতে সৈয়দ মুকাররম কিংবা ইমাম হোসেনের নাম না থাকায় আব্বুর শ্যামবর্ণ মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হতে শুরু করে।
আব্বুর মতো সার্টিফিকেটধারী কিন্তু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আরো কেউ কেউ আছেন, তাদের নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। কিন্তু এই দুজন ধরা পড়ে জেরার মুখে যদি বলে দেয়, আপনারা মুন্সি আল আমিনকে ধরছেন না কেন তাহলে সর্বনাশ হবে। বেশ কসরত্ করে আব্বু তার নামটা বীর মুক্তিযোদ্ধা মুন্সি আল আমিন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার একটি সংবর্ধনা এবং গণমাধ্যমে তা প্রচারের পুরো খরচ নিজেই জুগিয়েছে। খরচ যাই হোক—বীর মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার দুর্লভ ভাগ্য তো সবার হয় না, সব প্রজন্মেরও হয় না।
যারা ধরা পড়েছেন, খবরের কাগজ যাদের ছবি ছেপেছে; তারা যে তাদের সন্তানদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছেন, এটা আমার আব্বুকে স্যাডিস্টিক প্লেজার দিয়েছে এমন নয়। আব্বু খুশি কারণ তার ছবি ছাপা হয়নি, যাদের ছবি ছাপা হলে আব্বুর ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল তারাও ছবিতে নেই।
ক’জন মাত্র ধরা পড়েছেন। অধিকাংশই ধরা পড়েননি।
ধরা পড়েনি আমার আব্বু মুন্সি আল আমিন। ধরা না পড়ার যে আর্ট তা অনেক বড় শিল্প।
ধরা না পড়ার আনন্দে আল্লাহতায়ালার কাছে শুকরিয়া আদায় করার জন্য তখনই কোনো একটি আরব দেশ থেকে কিনে আনা জায়নামাজ বিছিয়ে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে নেয়।
আল্লাহতায়ালা চাইলে তার এই দুনিয়াজাহানের যেকোনো পাপী বান্দাকে জনসম্মুখে অসম্মানিত যেমন করতে পারেন, তেমনি অসম্মান থেকে রক্ষাও করতে পারেন। আমার আব্বুর ধারণা তাকেও অসম্মান থেকে বাঁচানো হয়েছে। এজন্যই শুকিরয়া। কৃতজ্ঞতা জানাতে কয়েকটি মাজার জিয়ারতের সিদ্ধান্ত নেয়, একটি দিল্লিতে।
আমার আব্বু যে এই অসম্মান থেকে বেঁচে গেল, এটা তার কাছে অনেক বড় কিছু হলেও আমার কাছে তেমন কিছু নয়।
সিঁধেল চোর নাকি সারা গায়ে সর্ষের তেল মেখে চুরি করতে যায়, গৃহস্থ টের পেয়ে যখন তাকে প্রায় ধরে ফেলে পরনের লুঙ্গি ছেড়ে দিয়ে ছুট দেয়, তৈলাক্ততার কারণে গৃহস্থের হাত পিছলে পালিয়ে যায়। এই সাফল্যের জন্য মাজারে শিন্নি মানত করে।
মানুষ যে কত কিছু করতে জানে! ব্যাঙ্ক থেকে হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়ে ধরা না পড়লে খিলখিল করে হাসে আর ধরা পড়লে দু’আঙুল উঁচিয়ে ভি ফর ভিক্টরি দেখায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়, মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা দেয়—তখন শিন্নি মানে, ওমরাহ করে। শুকরিয়ার কোনো শেষ নেই!
সার্টিফিকেট থাকলে দু-একবছর বাড়তি চাকরি করার সুযোগ পাওয়া যায়, এটা আমার আব্বু ভোগ করেছে, কিন্তু এর বাইরেও তো কত সুযোগ ছিল। আরো দু-এক বছরের এক্সটেনশন পেতে পারত, সচিব কিংবা সিনিয়র সচিব বাদই থাকুক ভারপ্রাপ্ত সচিব করতে তো বাধা ছিল না। আব্বুর ভাষায়, ‘সরকারের জন্য এত করলাম, এই কি তার প্রতিদান!’
আমি জানি সমস্যাটা এখানেই—আব্বু ও তার অনেক বন্ধু সরকারের জন্য করে, দেশের জন্য নয়।
সার্টিফিকেট সমর্থিত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাড়তি সময়ের চাকরি শেষে আব্বু যেদিন অফিস ছেড়ে এল, প্রকাশ্যে সরকারের মা-বাপ তুলে গাল দিল। বিরোধী দলের সাথে যোগাযোগ আছে এমন কারো সাথে দেখা হলে তার গালাগালের তোড় আরো বেড়ে যায়। গালাগাল দিয়ে বলে, ‘ভুল করেছে, জাতি বড্ড ভুল করেছে। বিরোধী দল ক্ষমতায় থাকলেই ভালো ছিল, আমাদের মূল্যায়ন হতো। এরা মূল্যায়নটা করল না। পস্তাবে, এর জন্য পস্তাবে। আমি মুন্সি আল আমিন বলে দিলাম পস্তাবে।’ তারপর ফিসফিস করে বলে, ‘তোমাদের নেতাকে আমার কথা বলো, আমি ভেতরের খবর জানি। আমাকে মূল্যায়ন করলে আমিও জীবন দিয়ে দেব। একাত্তরে সবটা যুদ্ধ করতে পারিনি। এবার বাকিটা।’
এসব বলার পর একটু দম নেয়, তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের একটি পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পায়ে গুলি খেয়ে দেশটা স্বাধীন করে কার লাভ হলো?’
আব্বু তারপর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
কয়েকজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাকে ধরার সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই আমার আব্বুর অবসর প্রস্তুতি ছুটি শুরু হয়ে যাওয়ায় তাকে নিয়ে কেউ ঘাটায়নি, কিংবা ঘাটানোর প্রয়োজনও মনে করেনি। বয়সে অন্যদের তুলনায় কিছুটা বড় হওয়ায় চাকরি থেকে বিদায়টাও আগে নিতে হবে এটাই বিধান। সুতরাং মানসম্মানসহ আব্বু বেঁচে গেল। এজন্যই তো শুকরিয়া।
এমনিতে মর্নিং ওয়াকে হাঁটাহাঁটির বাইরে যদি দৌড়াতেও হয়, আব্বু তার সমবয়সী এমনকি দু’চার বছরের কমবয়সীদের চেয়ে দ্রুতগতিতে তা সারতে পারে। কিন্তু সে সময় কোনোভাবে স্বাধীনতা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এসে গেলে আব্বু কখনো ডান পায়ের কখনো বাম পায়ের গোড়ালির দিকে, কখনো ডান পায়ে হাঁটুর পেছন দিকটাতে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আহ্ করে ওঠে। কখনো একটু লেংচায়ও। ডান পা আর বাম পা করার কারণ কোন পায়ে গুলি লাগার গল্পটা প্রথম বলেছে আব্বুর তা মনে নেই। কখনো মনে হয় গোঁড়ালি, কখনো হাঁটুর পেছন দিকটা, কখনো ডান, কখনো বাম পা।
নতুন প্রজন্মের কাউকে কাউকে এটাও বলেছে, ‘গুলিটা ভেতরে রয়ে গেছে, থাকুক। একাত্তরের একটা স্মৃতি না নিয়ে কেমন করে ওপারে যাই।’
কেউ একজন আব্বুকে বলেছেন, ‘লোহালক্কড়সহ কাফন-দাফন জায়েজ কি-না এটা আগে একটু জেনে নিলে পারতেন না?’
আব্বু উষ্মা প্রকাশ করে, ‘আপনি কোনটাকে লোহালক্কড় বলছেন? ওটা তো বুলেট। মেটাল কাভারিং, ভেতরে এখনো এক্সপ্লোসিভ থাকতে পারে।’
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কেউই ভুয়া আব্বু নন। আমার বেলায় মুন্সি আল আমিন প্রকৃত আব্বু। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা না সহি রাজাকার—এটাকে এখন আর আব্বুর সাথে মেলাতে চাচ্ছি না।
আমার কাছে আব্বুটাই মুখ্য, আর সবই গৌণ।
চার
এবার আমার কথা একটু বলে নিই।
আমার বয়স সতের চলছে। সাত-আট বছর বয়সেই ইঁচড়ে পাকা হিসেবে আমার ব্র্যান্ডিং হয়। আমি আমার জ্ঞানের যথার্থতা পরীক্ষা করার জন্য আমার আম্মুকে বললাম, ‘আমি তো তোমার পেটে ছিলাম, তাই না?’
আম্মু আমাকে আঁকড়ে ধরে বলল, ‘হ্যাঁ সোনা, তুই আমার পেটে ছিলি।’
এবার আমি বিব্রতকর প্রশ্নটি করলাম।
‘কিন্তু আম্মু, আমি তোমার পেটে ঢুকলাম কেমন করে?’
আম্মুর একটা গত্বাঁধা জবাব, ‘আল্লাহর ইচ্ছায়।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঠিক বলেছ?’
‘হ্যাঁ অবশ্যই।’
‘তাহলে আব্বু কি বসে বসে আঙুল চুষেছে?’
সে বয়সেই আমার পেট ফোলা মেজোখালাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তোমার পেটের এ অবস্থা কেন?’
মেজোখালা বলল, ‘পেটে পানি জমেছে।’
আমি বললাম, ‘তাড়াতাড়ি ডাক্তার দেখাও নতুবা পানিতে ডুবে তোমার বাবুটা মারা যাবে।’
ছোটবেলা থেকে আমাকে শুনতে হয়েছে—ছেলেটা সব বুঝে! কেউ বলেছে, ‘বড্ড বেশি বুঝে! এই বয়সে এত পেকে যাওয়া ঠিক নয়। পরে এই ছেলেকে সামলাবে কে?’ কেউ বলেছে, ‘এটা একটা বিচ্ছু, আস্ত বদমাশ!’
আমি কী বলতে কী বলে ফেলি এ নিয়ে আমার আম্মু ও আব্বু সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকত, বিশেষ করে যখন বাড়িতে অতিথিরা আসতেন।
স্বীকার করতেই হবে অতিথিদের সাথে আমি যেসব কথা বলতাম, কিংবা যেসব প্রশ্নের জবাব জানতে চাইতাম এর কোনোটাই আবশ্যকীয় ছিল না।
পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা একজন অতিথি যখন আমার চোখের সামনে আব্বুকে পাঁচশত টাকার দুটি বান্ডিল দিলেন, আমি হিসাব করে ফেললাম প্রতি বান্ডিলে পঞ্চাশ হাজার, মোট এক লাখ। আমি আব্বুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঘুষ নাকি?’
আব্বু চিত্কার করে বলল, ‘গেট আউট!’
আমি জানি এই গর্জন অর্থহীন। অন্যদিকে তাকিয়ে একটুখানি হেসে আমি বেরিয়ে আসি।
সতের বছর বয়সে আমার বড়ভাই সৈয়দ জালালউদ্দিন রুমী পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি ছাড়িয়ে গেছে আর আমার মেজোভাই মাহমুদ দারবিশ পুরো ছ’ফুট। আমার বোনদের কেউই এ বয়সে পাঁচ ফুটের কম ছিল না। গিঁট লাগল আমার বেলায়।
বয়স যখন আমার পুরো চৌদ্দ বছর, তখন আমি লম্বায় ঠিক সাড়ে তিন ফুট। এটাই আমার সর্বোচ্চ উচ্চতা। আর আমার সতেরতম জন্মদিনে, মানে তিনবছর পর মেপে দেখি আমি যা ছিলাম, তা থেকে আধ ইঞ্চি খাটো হয়ে গেছি। আমার উচ্চতা তিন ফুট সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি।
ডাক্তার পরীক্ষা করেছেন। বলেছেন, ‘এখানেই স্ট্যাবল হয়ে যাবে আর কমবে না। বাড়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই।’
গিট্টুু লেগেছে আমার শরীরের জোড়ায় জোড়ায়। এতে আমার কি ব্যথা-যন্ত্রণা কিছু হয়— এ প্রশ্ন অনেকেরই। আমার এতটুকুও সমস্যা হয় না।
আমার মতো দু’চার জন বামন চোখে না পড়ার কথা নয়, বিশেষ করে কোনো না কোনো চাইনিজ রেস্তোরাঁর দরজায় চমত্কার পোশাকের হাসিমুখ একজন বামনের দেখা মিলবেই।
আমি বাং চিন রেস্তোরাঁর সেই খাটো মানুষটির সাথে কথা বলেছি। তিনি হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘লম্বু শালাদের মধ্যে অনেক বেকার আছে। বামনদের মধ্যে একজন বেকারও নেই।’
সেই মানুষটির নাম আবদুর রাজ্জাক। তিনি মানিব্যাগ থেকে একটি সুন্দর মহিলার ছবি বের করে আমাকে দেখিয়ে বলেছেন, ‘এই যে দেখুন আমার পরিবার। পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি লম্বা। হাসিটা দেখেছেন, কী মিষ্টি!’
‘বুঝতে পেরেছি তিনি আপনার ওয়াইফ, কিন্তু আপনি বলেছেন পরিবার। পরিবার তো ফ্যামিলি। ফ্যামিলিতে বাচ্চারাও থাকে।’
‘ঠিকই বলেছেন, আপনি ছোট মানুষ, বুঝবেন না, নুরুনের পেটে একটা বাচ্চাও আছে। ভবিষ্যতে আরো হবে। সেজন্যই স্ত্রী-ই পরিবার।’
‘তার ব্যাখ্যা আমার তেমন মনপুত হলো না।’
তিনি সম্ভবত ধরে নিয়েছেন বামন হওয়ার কারণে আমি মনোকষ্টে আছি। কাজেই আমাকে আশ্বস্ত করার জন্য বললেন, ‘ছোটভাই একটুও চিন্তা করবেন না, বামন হওয়ার মধ্যে আল্লাহর রহমত আছে। একটা বামনও বেকার নেই। আমার হাতেই এখন তিনটা চাকরি, কিন্তু বামন খুঁজে পাচ্ছি না। চাংপাই রেস্তোরাঁ চাচ্ছে একজন, ইয়ানতুন খাইযান রেস্তোরাঁ চাচ্ছে একজন, এমারেল্ড জুয়েলার্স চাচ্ছে টুইন বামন, আট ঘণ্টা করে দু’বেলা ডিউটি করবে—ডিউটি মানে সুন্দরী কাস্টমার এলে সালাম দিয়ে দরজা খোলা, আরো একটা পার্ট টাইম কাজ আছে এফডিসিতে। দিলদার মুভিজের একটি সিনেমায় নায়িকা শ্রাবস্তীর একজন বামন প্রেমিক থাকবে, তাকে ভালো ইংরেজি বলতে পারা চাই। ডেইলি পাঁচশ শুটিংয়ের দিন আড়াই হাজার। যদি রাজি থাকেন বলেন, শুক্রবার বাদ জুম্মা দিলদার সাহেবের কাছে নিয়ে যাব। শ্রাবস্তী কিন্তু হেভি জিনিস, এক নম্বর নায়িকা। আপনি বলবেন, কেন আপনার জন্য কষ্ট করব, তাই না? আমারও এতে লাভ আছে, আমি যে আপনাকে খুঁজে বের করে দিলাম এজন্য দু-একটা পাঁচশ টাকার নোট আমিও পাব। তাছাড়া শুটিংয়ের সময় কাছে থেকে শ্রাবস্তীকে দেখলাম এটাও বা কম কী! আমিই যেতাম, কিন্তু বয়সটা বেশি আর ইংরেজির জন্য মারটা খেয়ে গেছি।’
‘কিন্তু আমার তো পুরো চশমা। অসুবিধে হবে না।’
‘কিছুই তো আপনি বুঝেন না, আপনাকে দেখার পরই তো সিনেমার স্টোরিটা লেখা হবে। সেখানে বামন প্রেমিকের চোখে চশমা বসিয়ে দেবে।’
পাঁচ
আমার বয়স তখন পনের। জিজ্ঞেস করি, ‘শ্রাবস্তীর সাথে আমি অভিনয় করব, মানে পারব? শ্রাবস্তী সাড়ে পাঁচ ফুটের কম হবে না।’
‘অফকোর্স পারবেন। অভিনয়ের চেয়ে সহজ কাজ পৃথিবীতে কিছু নেই। এই যে আমি আপনি আমরা তো সারাটা দিনই অভিনয় করি। অনেক সময় ঘুমটাও অভিনয়। তাছাড়া শ্রাবস্তী পাকা অভিনেত্রী, কলকাতায় অভিনয় করে একেবারে ফাটিয়ে ফেলেছে। পাকা মেয়েগুলো ভালো, কাঁচাগুলো ন্যাকামি করে। আমি ন্যাকামি একদম সহ্য করতে পারি না।
আপনি যে আমাকে এমন একটা ব্রেক দেবেন এর জন্য আপনাকে কি আমার কিছু দিতে হবে? মানে টাকাপয়সা কিংবা অন্য কিছু?’
‘আরে টাকাপয়সা তো হাতের ময়লা। আমিই আপনাকে দেব, টাকার চেয়েও বেশি। আমার শ্বশুর বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটাকে শুধু একবার দেখেন। মাথা ঘুরে যাবে।’
‘মানে?’
‘নুরুনের একটা ছোট বোন আছে, শিরণ নাম—এক্কেবারে অপু বিশ্বাসের মতো, চৌদ্দতে পড়েছে। শালিটাকে আমার ভাই আবদুল মান্নাফের জন্য ঠিক করে রেখেছিলাম। কিন্তু ভাইটা আমার সাথে বেইমানি করেছে। আমার স্ত্রীর সাথে ফাতরামি করেছে। আমি ফাতরামি একদম পছন্দ করি না। এজন্য মত বদল করেছি। চলেন ছোটভাই একদিন আমার বাসায়, শিরণকে দেখে আপনি আর একা বাড়িতে ফিরতে চাইবেন না। মন চাইবে শিরণকেও সাথে নিয়ে যাই।’
আবদুর রাজ্জাকের কথায় আমি যথেষ্ট উত্সাহিত হই। আমি তাহলে দিলদার মুভিজের হয়ে শ্রাবস্তী, শুভশ্রী, পপি, অপু, মাহি, জয়া এবং এমন আরো অনেক নায়িকার বিপরীতে অভিনয় করে যাব। আবদুর রজ্জাক বামন ঠিকই বলেছেন, ডোয়ার্ফ হওয়াটা তাহলে ব্লেসিং।
আমি এরমধ্যে একটি সিনেমা দেখলাম। দ্য টিন ড্রাম। অস্কার নামের এক বামন টিন পেটাচ্ছে আর তার চোখ দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখছে। ছবিটা এমন করে কাছে টানে যে অস্কারের চোখই হয়ে উঠে সবার চোখ। দারুণ ব্যাপার।
দিলদার মুভিজের নতুন আবিষ্কার বামন অভিনেতা, বামন নায়ক। কিন্তু আমার চাই ভিন্ন নায়িকা। সম্পূর্ণ নতুন নায়িকা। তার নাম শিরণ। বামন আবদুর রাজ্জাক সাহেবের শ্যালিকা।
চাইনিজ রেস্তোরাঁর দরজায় অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকা বামনদের শরীর সুগঠিত এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সমানুপাতিক। আমারও তাই ছিল। কিন্তু গত এক বছরে কোমরের নিচের অংশ ক্রমেই শুকোতে ও সংকুচিত হতে থাকে। আমি আর দু’পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। কেন আমার এ অবস্থা হচ্ছে কারণ জানতে নিজেই একটার পর একটা ই-বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি। অদ্ভুত সব কারণ:
স্পনডিলোএপিফিজাল ডিসপ্লাসিয়া কনজেনিটা
ডায়ামট্রোফিক ডিসপ্লাসিয়া
সুডোএকোনড্র্যোপ্ল্যাসিয়া
হাইপোকোনড্রোপ্লাসিয়া
অস্টিওজেনেসিস ইমপার্ফেক্টা
ধ্যাত্! এসবের মানে কি আমি কেমন করে বলব! এটা ঠিক সচ্ছল পরিবারের সন্তান না হলে এ অবস্থায় আমি বড্ড বিপদে পড়তাম। একজন বিদেশি ডাক্তার (দেশের ব্যয়বহুল হাসপাতালগুলোতে বিদেশি দু-চারজন ডাক্তার তো থাকছেনই) বললেন, কোনোভাবেই দাঁড়ানো যাবে না, তাহলে শরীরের ভারে পায়ের হাড় ভেঙে যাবে। আমাকে আঠার ঘণ্টা বসে থাকতে হবে হুইল চেয়ারে, ছ’ঘণ্টা বিছানায়। বিছানায় চিত্ হওয়া যাবে, কাত্ কিংবা উপুড় নয়। হুইল চেয়ারে থাকার সময় বুক বরাবর ভারী বেল্টের বেস্টনি থাকবে যেন সামনে ঝুঁকে হুমড়ি খেয়ে ফ্লোরে পড়ে না যাই।
আমার জন্য বিদেশি হুইল চেয়ার আনা হয়েছে। চেয়ারে স্টিয়ারিং আছে, হ্যান্ডব্রেক আছে। বামপাশের হাতলের কালো বাটনে ওপরের দিকে চাপ দিলে চেয়ারের ব্যাকরেস্ট ৯০ ডিগ্রি থেকে ১৩৫ ডিগ্রি পর্যন্ত চলে আসে। ওদিকে সমানুপাতিক হারে পা উপরের দিকে উঠতে থাকে। তখন গা এলিয়ে বেশ একটা ঘুম দেওয়া যায়। আব্বু বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারও এত আরামদায়ক নয়।
সময়মতো শরীরের গিট্টু আলগা হয়ে যাবে, আমি দেখতে দেখতে পাঁচ ফুট ছ’ইঞ্চি ছাড়িয়ে যাব এটাই ছিল প্রত্যাশা। আমার আব্বু কিংবা আম্মুর দিকের চেনাজানা কোনো পুরুষ আত্মীয়ই সাড়ে পাঁচ ফুটের কম নয়। আমার চাচারা এত লম্বা যে তাদের শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘লম্বা যত আহাম্মক তত!’
বয়স যখন নয় কি দশ বছর, তখন থেকেই আমাকে বন্ধুদের সম্বোধন—এই লিলিপুট। আব্বে লিলিপুট।
আমি গালিভারের সফরনামা পড়েছি। লিলিপুটের দেশে ডাক্তার লেমুয়েল গালিভার। আমি আরো একটি লেখা পড়েছি, সেখানে গালিভারের সফরনামার কিছু দুর্বল দিক তুলে ধরা হয়েছে। যেমন লেখক একথাটা বলতে লেখা ভুলে গেছেন যে, একজন লিলিপুটিয়ান একজন প্রমিতমান ইংরেজের ১/১২ ভাগ, তার শক্তি ইংরেজের ১/১৪৪ ভাগ এবং তার ওজন ১/১৭২৮ ভাগ। তাদের বাড়িতে কোনো সিঁড়ি থাকে না, কারণ এক লাফে একতলা থেকে দু’তলা, দু’তলা থেকে তিনতলা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে পারে, নামতেও পারে।
এদিক দিয়ে আমার অবস্থান ভালো না মন্দ বুঝতে পারছি না। আমি তিন ফুট সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি, ছয় ফুট দশ ইঞ্চি কোনো বাঙালির দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। লাফিয়ে একতলা থেকে দু’তলা বাদ যাক, আমি সিঁড়ির দুটো ধাপই পেরোতে পারব না।
গালিভারের সফরনামায় একটা মজার দৃশ্য আছে। লিলিপুটিয়ানদের রাজপ্রাসাদে যখন আগুন লাগল, গালিভারকে আগুন নেভানোর দায়িত্ব দেওয়া হলো। গালিভার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন এবং ট্রাউজারের বোতাম খুলে যখন রাজপ্রাসাদের উপর প্রস্রাব বর্ষণ করতে শুরু করলেন, তার একান্ত ব্যক্তিগত হোসপাইপটির আকার এবং পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা দেখে রাজপরিবারের নারীদের চক্ষু কপালে উঠল। সবাই বলল, ‘ওহ্ মাই গড!’
আর একটা অসুখ আছে, নাম জাইগান্টিজম। পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে হরমোন নিঃসরণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেলে শরীরটা বিশাল আকারের হয়ে ওঠে। আমি এটাও ভেবেছি হঠাত্ করে আমাদের শরীরের প্রক্রিয়াটা যদি পাল্টে যায়, আমি যদি অতিকায় হয়ে উঠি, গালিভারের মতো আমিও আগুন নেভাবার চ্যালেঞ্জ নেব। আমি মনে মনে কয়েকটি ভবনের তালিকা করি এবং আমার আবার অগ্নি-নির্বাপক যন্ত্র দেখে বুদ্ধিজীবী টাইপের নারীদের কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা আঁচ করতে চেষ্টা করি।
আমি কিছুদিন স্কুলে গিয়েছি। কিন্তু যখন গায়ের ওপর শরীরের ভারটাকে বেশি মনে হতে শুরু করল, ডাক্তার বললেন, ‘ফ্র্যাকচার এড়াতে হবে। হাঁটা যাবে না।’ তখন থেকেই আমার জন্য চাকাওয়ালা চেয়ার।
ছয়
আমার এসএসসি পাস করা হয়নি, রবীন্দ্রনাথেরও অধরা রয়ে যায় ম্যাট্রিকুলেশন। ম্যাট্রিক পাস করেননি বলে রবীন্দ্রনাথকে অশিক্ষিত মনে করাটা যেমন ভুল, আমি শিক্ষিত নই মনে করাটাও বোকামি। আমি কার্টুন দেখতে দেখতে ইংরেজি শিখেছি, অ্যানিমেল প্ল্যানেট দেখে জেনেছি কেমন করে গন্ডারের বাচ্চা হয়, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে দেখেছি আফ্রিকায় কেমন করে মেয়েদেরও খত্না করানো হয়। আমি হিন্দি চ্যানেল দেখি না, অন্তত তিনটি চ্যানেলে ইংরেজি সিনেমা দেখি, স্নুকার, গলফ—এসব খেলাও বুঝি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতা মুখ দেখাদেখি না করলেও ক্যান্টনমেন্টে দাওয়াত পেলে কেন যায় আমি সেটাও জানি। রসুন ও কালিজিরার উপকারিতা কি জানি, ভায়াগ্রা নামের ওষুধটি কেমন করে কাজ করে তার ওপরও একটি প্রতিবেদন দেখেছি।
আমার রুমের দেয়ালে একটি ফ্ল্যাটস্ক্রিন এলইডি টিভি আছে, আইবিএম কম্পিউটার আছে। আমার বিছানা বরাবর টেবিলে কাজুবাদাম, চানাচুর, পটেটো চিপস আছে—ইচ্ছে হলে খাই।
আমি সুশিক্ষিত না হতে পারি, অশিক্ষিত মোটেও নই। আমার আইকিউ আমার বয়সী স্বাভাবিক ছেলেদের চেয়ে বেশি না হলেও কম কিছুতেই না। আমি গম্ভীর স্বরে কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক কথাবার্তাও বলতে পারি। যেমন একবার বললাম, ‘একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যে বোঝাবুঝিটা যখন বেশ ভালো, তখন তারা বিয়ে করে এই ধারণাটা মোটেও ঠিক নয়। আসলে দুজনের ভুল বোঝাবুঝিটা যখন তুঙ্গে, তখন তারা বিয়ে করে আর যখন দুজন দুজনকে ভালো করে বুঝে তখন নির্ঘাত্ তালাক হয়ে যায়।’
ইন্ডিয়ান ডাক্তার নীলকান্ত আগারওয়ালের পরামর্শে দেয়ালের সাথে একটু নিচু করে ব্ল্যাকবোর্ড বসানো হয়, পাশেই চক-ডাস্টার। যখন ইচ্ছে হবে আমি বোর্ডের দিকে এগিয়ে যাব, মন যা চায় তা-ই আঁকব, কিংবা লিখব।
প্রথম দিকে উত্সাহের কমতি ছিল না, যা ইচ্ছে তাই আঁকছি। একেক দিন মনে হয়েছে আমি পাবলো পিকাসোকে ছাড়িয়ে গেছি। একবার এঁকেছি, ডাস্টার চালিয়ে মুছেছি, আবার এঁকেছি। কিন্তু আমার উত্সাহে ভাটা পড়তে তেমন সময় লাগে না। ছবি আঁকা বন্ধ করে দিই, ইচ্ছে হলে কখনো একটি কি দুটো লাইন লিখি।
একদিন আব্বু তার মতো যোদ্ধাদের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য সমমনা সহকর্মী ক’জনকে ডিনারে ডাকল।
সেদিন আমি ব্ল্যাকবোর্ডে লিখলাম, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে সহি-রাজাকার ভালো।
আব্বুর বন্ধুরা আমার সম্পর্কে জানে। আমার বেড়ে উঠতে না পারার ব্যাপারটাতে তারা উদ্বিগ্ন। এমনটা হবার তো কথা নয়। অতিথিরা আসার পর একবার আমাকে দেখতে আসেন। আব্বুর বন্ধুদের স্ত্রীরা প্রায়ই আমার চিবুক ধরে বলেন, ‘বাবুটা কি সুইট!’ একজন একবার আমার জন্য খেলনা গাড়ি ও চিল্ডরেন’স হ্যাপি মিল নিয়ে এসেছেন। বাচ্চাদের খাবার! মানে আমি বাচ্চা! ইচ্ছে হয় বলি, আন্টি কেমন করে বাচ্চার জন্ম হয়, আমি কিন্তু তাও জানি, নেক্সট টাইম আমার জন্য এডাল্ট ফুড আনবেন। তাছাড়া চিবুকে ধরে আদর করাটা আমি পছন্দ করি না, এটাও মনে রাখবেন।
আমি চাচ্ছিলাম আব্বুর বন্ধুরা বোর্ডে আমার লেখাটা দেখুন। আমাকে কথাটার মানে জিজ্ঞেস করুন। ব্ল্যাকবোর্ড এমন এক জায়গায় যে এর ওপর চোখ না রেখে উপায় নেই। আব্বুর সাতজন বন্ধুর ৪ জন স্ত্রীসহ এবং ৩ জন সিঙ্গল আমাকে দেখতে এসে লেখাটা পড়েছেন, বড় ঢোঁক গিলেছেন এবং আমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেননি।
তবে সবাই চলে যাওয়ার পর আব্বু রুমে ঢুকে বলল, ‘দারুণ একটা কথা লিখেছিস। এই লেখাসহ বোর্ডটা প্রিজার্ভ করতে হবে।’ বলে ব্ল্যাকবোর্ডটা তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু আব্বু বোর্ডটা কোথায় রেখেছে বের করতে পারিনি। বোর্ড না থাকায় একদিনেই আমার লেখার আগ্রহ মিলিয়ে গেল। তিন-চারদিন পর বেশ দামি নতুন একটা বোর্ড আগের জায়গায় বসানো হয়। আমি বোর্ডের ওপর নািসদের স্বস্তিকার ছবি আঁকি। তিনদিন পর আমি নিজেই যখন ডাস্টার হাতে নিয়ে ছবিটা মুছতে যাই, দেখি আমি আর ডান হাত তুলতে পারছি না। পরদিন ডান হাতে চায়ের কাপ ধরে রাখতে পারলাম না, গ্লাসও ভাঙল। আব্বু বলল, ‘ও কিছু না, ছেলেটা সবার অ্যাটেনশন ড্র করার চেষ্টা করছে।’
আমি আঠারো হওয়ার প্রতীক্ষায় ছিলাম। আঠারো নিয়ে সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটা কবিতা পড়েছি—আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ/ স্পর্ধায় নেয় মাথা তুলবার ঝুঁকি/ আঠারো বছর বয়সেই অহরহ/ বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।
আঠারোর আগেই শুকিয়ে যাওয়ার রোগটা আমার হাতকে স্পর্শ করল। ‘দ্য টিন ড্রাম’ ছবিটা ইউটিউবে দেখলাম। তৃতীয় জন্মদিনে ঢোলটা উপহার পাওয়ার পর নিজে নিজেই আর বড় না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সুতরাং সেখানেই সে আটকে থাকে। কিন্তু আমি নিজেকে আটকে রাখতে চাইনি। আমি বামন আবদুর রাজ্জাকের শ্যালিকা শিরণকে নিয়ে সিনেমা করতে চেয়েছি।
এ বাড়িতে একটি ইংরেজি ও দুটি বাংলা খবরের কাগজ রাখা হয়। অধিকাংশ সময়ই ভাঁজ না ভেঙে এগুলো পুরোনো কাগজের স্তূপের ওপর ফেলা হয়। আমি কখনো প্রথম আর শেষ পাতায় চোখ বুলাই। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বিষয়টি সামনে আসায় আব্বু ইদানীং খবরের কাগজের সব পাতাই উল্টায়। মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ে কোনো খবর দেখলেই আঁতকে ওঠে— তাকে নিয়ে নয়তো!
প্রথম পাতার খবর :এমপিরা সংসদে থাকেন না, প্রধানমন্ত্রী অসন্তুষ্ট। ভেতরে লিখেছে, প্রধানমন্ত্রী নিজদলের অনুপস্থিত এমপিদের বকাবকি করেছেন। বলেছেন, আগামী নির্বাচনে নমিনেশন দেওয়ার আগে সংসদের হাজিরা খাতা চেক করে সিদ্ধান্ত নেবেন। যাদের এইট্টি পার্সেন্ট হাজিরা নেই তারা দলের টিকেট পাবেন না।
বিরোধী দলের সংসদে থাকার প্রয়োজন হয় না। প্রথম দিনই ওয়াক আউট করে তারপর পাঁচ বছর কেটে যায়। এটাই বাংলাদেশের পলিটিক্যাল কালচার।
জেল থেকে কয়েদি পালালে পাগলা ঘণ্টি বাজানো হয়। সংসদ থেকে এমপি পালালে?
সংসদের ঘণ্টি বাজে অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই।
আরো একটা উপসর্গ আমার খাটোত্বের সাথে যোগ হয়েছে। আমার চুল পড়ে যাচ্ছে। যে হারে পড়ছে বয়স আঠারোতে পৌঁছতে পুরো মাথা খালি হয়ে যাওয়ার কথা। পুরো মাথা খালি হওয়ার একটা বাড়তি সুবিধা আছে, কেউ টেকো বলবে না, বলবে ন্যাড়া মাথা। এমনিতে পাত্র টেকো শুনলে মনে হতে পাত্রের কপালের বিস্তার মাথার অর্ধেক জুড়ে কিংবা মাথার মাঝখানে স্টেডিয়াম। আমার জন্য ন্যাড়া মাথাটাই ভালো।
আমার আব্বুর বিসিএস সহকর্মী জয়নুল হক স্ত্রীসহ বেড়াতে এসেছিলেন। যাওয়ার সময় কৌতূহলী হয়ে আমাকে দেখতে এলেন। স্বল্পকেশ এই মানুষটি মুখটা কারো আঁকা কার্টুনের মতো। তিনি বললেন, ‘সরি বাবু খালি হাতে এসেছি, তোমার জন্য চকলেট আনা উচিত ছিল।’
আমি বলতে চেয়েছিলাম, তাতে কী! কালপরশু চকলেটের বদলে একটা প্লেবয় ম্যাগাজিন দিয়ে যাবেন। কিন্তু কথাটা বলিনি, বরং তার মাথার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আঙ্কেল আপনাকে একটা জোক শোনাই?’ আন্টি বললেন, ‘অবশ্যই, হাসির জোক হওয়া চাই।’
আমি বললাম, ‘তাহলে শুনুন, একজন স্বল্পকেশ পুরুষমানুষের মাথায় মাত্র চারটি চুল ছিল। তিনি ঠিক করলেন তখন থেকে চুল ডান দিকে আঁচড়াবেন। প্রথম দিন চুল আঁচড়াবার সময় একটি চুল পড়ে গেল। তিনি মনে করলেন ডানদিকে আঁচড়ালে এমনই হয়, সুতরাং বামদিকে আঁচড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। দ্বিতীয় দিন আর একটি চুল পড়ে গেল। বাকি রইল দুটি চুল। তিনি মনে করলেন, বামদিকে চুল আঁচড়ানোটা বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি, তিনি ব্যাকব্রাশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ব্যাকব্রাশ শুরু করলেন, তৃতীয় দিন একটি চুল পড়ে গেল, বাকি রইল মাত্র একটি। তিনি মনে করলেন ব্যাকব্রাশ করাটা বড় ভুল হয়ে গেছে। পরপর তিনটি ভুল করার পর তিনি গম্ভীর দার্শনিকের মতো বললেন, আসলে চুল এলোমেলো থাকাই ভালো।’
আন্টি মিসেস জয়নুল হক হাসতে শুরু করলেন, তার পেট ফেটে যাওয়ার অবস্থা। কিন্তু জয়নুল হক আরো গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘ননসেন্স!’ তার কথা শুনে আমি হেসে উঠি। তিনি নিশ্চয়ই জোকটা বুঝতে পারেননি। তবুও ভালো তিনি বলেননি, ‘এতে হাসির কী হলো?’
মিসেস জয়নুল হক বারবার বললেন, ‘দারুণ! দারুণ!’
তারপর মাথা নুইয়ে আমার কপালে একটা চুমো দিয়ে আমার দুর্বল ডান হাতটা তুলে নিয়ে শেইকহ্যান্ড করলেন। কিন্তু তার স্বামী একবারও পেছনে তাকালেন না। তার একটি হাত মাথায়। সম্ভবত তার কটা চুল অবশিষ্ট আছে তা-ই গুনছেন।
জোক শুনে যারা বলেন ননসেন্স তাদের কী করা? কী তাদের প্রতিকার? সুকুমার রায় লিখে গেছেন,
‘প্রতিকার আছে জানা, তাদের মাথায় সুপারি রাখিয়া কাষ্ঠপাদুকা হানা।’
আমি জানি কাষ্ঠপাদুকা মানে কাঠের খড়ম।
সাত
এবার আমার আরো কজন আত্মীয়স্বজনদের কথা একটু বলি।
আমাদের বাড়িটার নাম আল আমিন’স ফ্রিডম আর্কেড। সাড়ে সাত কাঠার এই প্লটটি একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ও ক্যাডারভুক্ত বিসিএস কর্মকর্তা হিসেবে আমার আব্বু পেয়েছে। পাঁচ কাঠার বেশি হাতে গোনা কয়েকটা প্লট ছিল। যার বড় প্লটের মালিক হয়েছেন, আব্বু পদের দিক তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ক্ষমতার দিক দিয়ে অনেককে ছাড়িয়ে।
আমাদেরটা ছ’তলা বাড়ি। তখন রাজউকের নিষেধাজ্ঞা ছিল ছ’তলার উপরে ওঠা যাবে না। এখন তা উঠে গেছে।
বাড়িতে প্লাস্টার লাগার সাথে সাথেই আব্বু ইস্কাটনের সুপিরিয়র কোয়ার্টার ছেড়ে নিজের বাড়িতে ওঠে। নিজের বাড়িতে থাকার মজাই আলাদা। জায়গা বেশি বলে গ্যারেজের জন্য নিচতলা ছেড়ে দিতে হয়নি, আমাদের নিচতলাতেও দুটো অ্যাপার্টমেন্ট।
আমার বড় তিন ভাইয়ের তিন দু’গুণে ছ’টা অ্যাপার্টমেন্ট, তিন বোনের তিন একে তিন। বাকি তিনটা বাবা, মা আর আমার। মেয়েদের ব্যাপারে ফারায়েজ মেনেই বণ্টন করা হয়েছে।
মোট সাত সন্তানের সবাই এক আম্মুর পেটের। আমার পর আর সন্তান না থাকার কারণ এই নয় যে আমার আব্বু সক্ষমতা হারিয়েছে, কিংবা বাচ্চা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে বলেছে, ‘আর কত!’ বা স্ত্রীকে বলেছে, ‘চলো এবার ক্ষ্যামা দিই।’ আমার জন্মের পর বিপজ্জনক ক্যান্সার হওয়ার কারণে আমার আম্মুর জরায়ু কেটে ফেলতে হয়।
তবে একটি আলোচনা আমার কানে এসেছে, ‘আরে লিলিপুট তো আর বেশিদিন নেই। বড়জোর তিনবছর। এই ঝামেলাটা বিদায় হলে তার অ্যাপার্টমেটটা কে পাবে?’ অথচ শুরুতে আলোচনার সুরটা ছিল ভিন্ন—যেহেতু লিলিপুট যথার্থই প্রতিবন্ধী সে বরং তিনটা অ্যাপার্টমেন্ট পাবে—বাবা-মায়ের দুটোও তাকে দেওয়া হবে।
এ পর্যন্ত সবই ভালো। কিন্তু আমার মেজো ভাইটিই বলেছে, ‘লিলিপুটটাকে তাড়াতাড়ি বিদায় করতে পারলে সে নিজেও কিন্তু ঝামেলা থেকে বেঁচে যাবে। দমে চাপ দিয়ে নব্বই সেকেন্ড ধরে রাখলেই কাজ সারা। নিজেরাও করতে পারি কিংবা লোক ডেকেও কাজটা করিয়ে দিতে পারি। তবে ব্যাপারটা মাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। অবশ্য কাজটা সাক্সেসফুললি করতে পারলে সবাই বলবে, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই। ছেলেটাকে কষ্ট তো আর সহ্য করতে হচ্ছে না।’
আমার এমন কোনো কষ্ট হতো না। চেয়ারবন্দি জীবনের সাথে আমি নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছি। ব্যাপারটা যদি ঘটেই যায় আমার আম্মু কাঁদবে এবং শুকরিয়াও আদায় করবে। তার মৃত্যুর পর ছেলেটার কী হবে এ নিয়ে তো তাকে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আম্মু নিজেকে ভাববে ভাগ্যবতী, নিজের চোখে ছেলেটার বিদায় দেখতে পেয়েছে।
যেকোনো কারণেই হোক আমার আম্মুর মনে হয়েছে আগে তাকে বিদায় নিতে হলে আমাকে থাকতে হতো হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে। আব্বু অনেকদিন ধরে একটি কুিসত কুকুর পোষে, কুকুরটির নাম জর্জ বুশ, কিছুকাল আগে বাবা নাম বদলে রেখেছে ডোনাল্ড ট্রাম্প। গ্যারেজের পাশে একটি ছোট্ট ঘরে জর্জ বুশ থাকে। দুই কোট চুনা মেরে ঘরটির রং করা হয়েছে সাদা। সেজন্যই এটা হোয়াইট হাউস।
ডোনাল্ড ট্রাম্প হিসেবে নাম বদল হয়েছে, ঘর বদল হয়নি। তাকেও হোয়াইট হাউসে থাকতে হয়। কারো পছন্দ হোক বা না হোক আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসেই থাকবেন। আমাদের কুকুরটার পেছনে যথেষ্ট খরচ হয়। বাসি মাংস খায় না, ফ্রেসটা আনতে হয়। আমার পক্ষে বুশ কিংবা ট্রাম্পের কাছ থেকে কাঁচা মাংস টেনে নিয়ে খাওয়া সম্ভব নয়। তার চেয়ে কেউ যদি দম টিপে ধরতে চায় ধরুক। আমি বাধা দেব না, এমনকি এরকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে এটা যে আমার কানে এসেছে তাও কাউকে জানতে দেব না। আমি ঘাতককে শুধু বলব, তুমি আমার বড্ড উপকার করলে। গড ব্লেস ইউ।
স্বজনদের কথা বলার দোহাই দিয়েছি ঠিকই, কিন্তু নিজের কথাই বলছি। একটু ক্ষ্যান্ত দিই।
আট
আমার বোনের হাজব্যান্ডদের কথা একটু বলি। তিনজনেরই বিয়ে হয়েছে, তাদের হাজব্যান্ডরা একটার চেয়ে আরেকটা বড় বদমাশ। তা হোক, আমার বোনরা কেউই অর্থকষ্টে নেই। বদমাশ ধরনের লোকজন পয়সাকড়ি ভালোই কামায়।
সবচেয়ে বড় বোনের হাজব্যান্ড নওশাদ হাম্মাদি আমার আব্বুর কাছাকাছি বয়সের একজন। তার বাবা কালাচাঁন পাইকার বাবুবাজারে কাঁচামালের আড়ত চালাতেন এবং ইংলিশ রোডের আমজনতার পতিতালয়ের পাশে একটি তিনতলা বাড়িকে ভিআইপি খদ্দেরদের জন্য একটি স্পেশাল হৌরহাউসে রূপান্তরিত করেছেন। এখানকার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ যে ক’টা মেয়ে থাকত, তাদের প্রায় সবাই ছিল সিনেমার এক্সট্রা। কেউ কেউ শীতের মৌসুমে যাত্রাও করত।
কালাচাঁন পাইকারের ছেলের নাম কেমন করে নওশাদ হাম্মাদি হয় এটা জিজ্ঞেস করার মতো প্রশ্ন। কিন্তু এর জবাব আমি কখনো পাইনি। তাতে সমস্যা নেই। আত্মীয়তার গ্রন্থি এ কারণে খুব একটা আলগা হয়ে যাওয়ার কথা নয়।
আমার বড় দুলাভাই নওশাদ হাম্মাদি যথেষ্ট পরিমাণ আয়কর দিয়ে সিআইপি— কমার্শিয়াল ইম্পর্টেন্ট পার্সন হয়েছেন।
সিআইপি নওশাদ হাম্মাদির ছবি বছর অন্তত আট-দশবার খবরের কাগজে ছাপা হয়। কখনো পত্রিকার নিজস্ব সংবাদদাতার তৈরি করা সংবাদ হিসেবে, কখনো গাঁটের পয়সা খরচ করে বিজ্ঞাপনের দরে কলাম ইঞ্চির হিসেবে ছবি ছাপিয়ে।
গত এক বছরে যে সব কারণে তিনি খবরের কাগজের ছবি হয়েছেন তার একটি অসম্পূর্ণ তালিকা দিচ্ছি—
১. প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে হাম্মাদি গ্রুপের অফিসার ও কর্মচারীদের একদিনের বেতনের চেক দিচ্ছেন সিআইপি জনাব নওশান হাম্মাদি। তার পরনে খাদির পাঞ্জাবি এবং ঘিয়ে রঙের জহর কোট এবং মাথায় তুর্কি ফেজ টুপি।
একই বিষয়ে প্রায় দেড় মাস পর একটি স্বল্প প্রচার সংখ্যার কাগজে ছাপা হয় ছোট্ট সংবাদ :প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দেওয়া হাম্মাদি গ্রুপের চেয়ারম্যান স্বাক্ষরিত চেক বাউন্স হয়েছে। সংবাদের সাথে ছবি ছাপা হয়নি।
২. নওশাদ হাম্মাদি জাপানের ট্রেড ডেলিগেশনে উপনেতা, দলটি শীঘ্রই টোকিও, ওসাকা ও জাগোইয়া সফর করবে। এই সফরে একটি অঘটন ঘটে। টোকিওর নারিতা এয়ারপোর্টে অবতরণ করার পর ট্রেড ডেলিগেশনের দলনেতা ও উপনেতাকে ছয় ঘণ্টা এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনের ভেতর আটকে রাখা হয়। তারা এ দুজনকে আদম পাচারকারী সন্দেহ করেছে, পরে দূতাবাস ও জাপানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জোর প্রচেষ্টায় তারা মুক্তি পান।
৩. সিআইপি নওশাদ হাম্মাদির ওমরাহ পালন।
এটি সচিত্র বিজ্ঞাপন। এই বিজ্ঞাপনে লেখা হয় ওমরাহ পালনকালে তিনি বাংলাদেশের মানুষের মঙ্গল ও দেশটির সমৃদ্ধির জন্য বিশেষ মোনাজাত করেছেন।
৪. নতুন প্রজন্মের ব্যাঙ্ক আমাজন ব্যাঙ্ক লিমিটেডের স্পনসর ডিরেক্টর নওশাদ হাম্মাদির সাক্ষাত্কার। সাংবাদিকের মুখোমুখি বসে তিনি কথা বলছেন, এমন একটি ছবি ছাপা হয়েছে। এই সাক্ষাত্কারের আয়োজন করতে তার কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে।
৫. মগবাজারের একটি আবাসিক হোটেলে অসামাজিক কাজে লিপ্ত অবস্থায় নওশাদ হাম্মাদি গ্রেফতার। পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তার মতো বিত্তশালী ও সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন একজন মানুষ নারী সম্ভোগের প্রয়োজন মনে করলে কমপক্ষে কোনো পাঁচ তারকা হোটেলে যাবেন, মগবাজারের কোনো ঘুপচি হোটেলে নয়। তিনি সেখানে গিয়েছিলেন তার ছোটবেলার এক বন্ধুর সাথে সাক্ষাত্ করতে। সে রাতে তার এই হোটেলে অবস্থান করার কথা ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসেননি।
৬. ভারতের গঙ্গা-পদ্মা সংস্কৃাতি সংসদ নওশাদ হাম্মাদিকে মঙ্গলশ্রী খেতাব দিয়েছে। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি মঙ্গলশ্রী। আগামি নবান্ন উত্সবের দিন কলকাতার রবীন্দ্রসদনে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি পুরস্কৃত হবেন। এই অনুষ্ঠানে ভারতের উপরাষ্ট্রপতির প্রধান অতিথি হবার কথা।
বাস্তবে হাম্মাদি গ্রুপের পাচার করা টাকায় গঙ্গা-পদ্মা সংস্কৃতি সংসদ নামের একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি করা হয়েছে।
৭. একই দিনে দুটি পত্রিকায় সচিত্র নওশাদ হাম্মাদি। একটিতে তাকে উদ্ধৃত করে শিরোনাম করা হয়েছে। আগামী সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ভাবছি। অন্যটির শিরোনাম মন্ত্রিত্বের প্রতিশ্রুতি না পেলে নির্বাচনে যাব না। একটিতে তার সাফারি-পরা ছবি, অন্যটিতে মুজিব কোট গায়ে।
৮. সোনালি ব্যাঙ্কের হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় হাম্মাদি গ্রুপ অব কোম্পানির একটি প্রতিষ্ঠান জড়িত। চেয়ারম্যান নওশাদ হাম্মাদি বলেছেন অভিযোগ মিথ্যে ও ষড়যন্ত্রমূলক।
৯. নাইজেরিয়ায় বাণিজ্যিক প্রতিনিধি দলের হাম্মাদি এভিয়েশন পরিদর্শন। তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলটি প্রস্তাবিত এয়ারলাইন্স হাম্মাদি এভিয়েশনের কার্যালয় পরিদর্শন করেন। গ্রুপ চেয়ারম্যান নওশাদ হাম্মাদি তাদের মধ্যাহ্ন ভোজে আপ্যায়িত করেন।
১০. প্রায় সবগুলো পত্রিকায় সিনেমাপাতায় সংবাদ; নওশাদ হাম্মাদির সংসার ভাঙছে—নতুন স্ত্রী চিত্রনায়িকা লুসি রড্রিগস। অবশ্য এ বিষয়ে নওশাদ লুসি-দুজনের কেউই মুখ খুলতে রাজি হননি। উল্লেখ করা যেতে পারে এক সপ্তাহ আগে দুজনকে সিঙ্গাপুর মেরিনায় হাত ধরাধরি করে হাঁটতে দেখা গেছে।
আমার বড় আপ ুরাইসার জন্য নওশাদ হাম্মাদিকে পাত্র হিসেবে যে পছন্দ সে জন্য কেউ নয়, আমার আব্বু স্বয়ং। কিংবা কথাটা এভাবেও বলা যায় আব্বুই রাইসাকে হাম্মাদির দিকে ঠেলে দিয়েছে।
নওশাদ হাম্মাদি আব্বুর কাছাকাছি বয়সী, আব্বু তার চেয়ে দু-তিন বছরের বড়।
ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সময় জলোচ্ছাসের পর ত্রাণ সামগ্রী পাঠাতে স্পিড বোটের ঘাটতি দেখা দেওয়ায় স্পিডবোট সরবরাহে নিম্ন দরদাতা হাম্মাদি অ্যাসোসিয়েটস কাজটি পায়। তবে হাম্মাদি অ্যাসোসিয়েটসের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ঘাটতি থাকায় কাজের আদেশটি বাতিল হওয়ার ঝুঁকির মুখে ছিল।
আব্বু শেষ পর্যন্ত তা বাতিল হতে দেয়নি। টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী অন্যদের আনা অভিযোগ পরীক্ষা করে আব্বু দেখেন শুধু কাগজের ঘাটতিই নয়, হাম্মাদি অ্যাসোসিয়েটস ভুয়া কাগজ দাখিল করেছে।
নওশাদ হাম্মাদি সরাসরি ঘুষ দিয়ে আব্বুকে ছোট না করে তার হাতে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের বিজনেস ক্লাসে ঢাকা-সিঙ্গাপুর-ঢাকা একজোড়া টিকেট, হোটেল হিলটনে চারদিন চার রাত থাকা ও খাওয়ার ফ্রি ভাউচার, সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ফুলবডি মেডিক্যাল চেক-আপ করার প্রি-পেইড টিকেট এবং সেখানে টুকটাক কেনাকাটা ও হাতখরচ মেটানোর জন্য ৫০০০ সিঙ্গাপুর ডলারের টিসি একটি ব্রাউন খামে আব্বুর হাতে তুলে দিলেন। টিসি মানে ট্র্যাভেলার্স চেক। সরাসরি ডলার দিলে ব্যাপারটাকে ঘুষ মনে হতে পারে সেজন্য এই বিকল্প আয়োজন।
আমার আম্মু যাবে না এবং প্লেনে ওঠার মতো দুঃসাহসিক কাজ কখনোই করবে না এটা যেমন সত্য, এমন একজন আনস্মার্ট মহিলাকে আব্বু ব্যাঙ্কক, সিঙ্গাপুরে সফরসঙ্গী করবে না এটাও সমান সত্য। আম্মুর এবং আমাদের সবার অগোচরে আব্বু অন্য কোনো মহিলাকে সঙ্গে নিতে পারত—তখন সচিবালয়ের দ্বাদশ সুন্দরীর একজন আনিকা মেহমুদাকে সফরসঙ্গী করলেও মহাভারত এমন কিছু অশুদ্ধ হতো না। কিন্তু আব্বু ব্রেক দিল বড় আপু রাইসা আল আমিনকে। এটা তেমন ছোট কিছু নয়, যাকে বলে বিগ ব্রেক।
লেখালেখির সময় আব্বুর হাত কাঁপত চুপচাপ বসে থাকার সময়ও মাথা নড়ত। আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় ডাক্তার রশিদউদ্দিন আব্বুকে বলেছেন, ‘বাইরে গিয়ে আপাদমস্তক চেক-আপ করিয়ে আসুন, লক্ষণটা আমার সুবিধের মনে হচ্ছে না।’
আব্বুই হাম্মাদিকে বললেন, ‘টিকেট-ফিকেট দেওয়ার কি দরকার ছিল? আমি তো এমনিই যেতাম। বরং ওখানকার নিওরোলজির কোনো ডাক্তারের সাথে একটা অ্যপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দিন।’
হাম্মাদি জিজ্ঞেস করল, ‘ম্যাডামেরও যদি কোনো চেক-আপ করাতে হয়, বলবেন। চিকিত্সার জন্য সিঙ্গাপুর নম্বর ওয়ান ইন এশিয়া। সেখানে একটা মেডিক্যাল ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে।’
আব্বু বলল, ‘আমার ওয়াইফ যাচ্ছে না। বড় মেয়ে রাইসাকে সাথে নিচ্ছি।’
‘তাহলে স্যার মেয়ের পাসপোর্টটাও দিন, ভিসা লাগিয়ে দিই।’
‘রাইসার পাসপোর্ট নেই।’
হাম্মাদি বললেন, ‘নো প্রবলেম। আমার কোম্পানির একজন লেডি প্রটোকল অফিসারকে এনগেজড করে দিচ্ছি, আর্জেন্ট পাসপোর্ট করিয়ে দেবে, একবার শুধু ছবি তোলা আর আঙ্গুলের ছাপ দেওয়ার জন্য যেতে হবে।’
তিন দিন অন্তত লাগার কথা, দু’দিনের মধ্যে পাসপোর্ট হয়ে গেল, চারদিনের মধ্যে ভিসার স্ট্যাম্পও লেগে গেল।
জয়েন্ট সেক্রেটারির সুন্দরী মেয়ে যখন বাবার সফরসঙ্গী, মেয়েকে ও মেয়ের বাবাকে একই সঙ্গে ইমপ্রেস করার সুযোগ হাতছাড়া করতে হাম্মাদি রাজি নন।
নয়
এটাই রাইসা আপুর জীবনে প্রথম প্লেনে চড়া। সিঙ্গাপুর সফরে যা কিছু ঘটেছে, সবই তার জীবনের প্রথম ঘটনা। চাঙ্গি এয়ারপোর্ট থেকে বেরোবার সময় লম্বা একটি বিদেশি মেয়ের হাতে বাংলায় লেখা একটি প্ল্যাকার্ড দেখে রাইসা বিস্মিত। সবার উপরে গাঢ় সবুজ রঙে লেখা :সিঙ্গাপুরে স্বাগতম। দ্বিতীয় লাইনে উজ্জ্বল কমলা রঙে আপুর নাম, রাইসা আল আমিন, তৃতীয় লাইনে গাঢ় নীলে আব্বুর নাম—এম এ আমিন। আপু যখন হা করে তার নামের দিকে তাকিয়ে রইল লম্বা মেয়েটি এগিয়ে এসে বলল, ‘আমি তোমাদের রিসিভ করতে এসেছি। উড়োজাহাজে তেমন কোনো অসুবিধে হয়নি তো? আমি মার্থা লিম।’
আপু বলল, ‘কোনো অসুবিধা হয়নি।’
পরক্ষণেই বলল, ‘তবে আমার কান ব্যথা করেছে।’
মার্থা লিম বলল, ‘দ্যাটস নাথিং, হাই অলটিচিউডে উঠলে এমন হয়েই থাকে।’
মার্থা দুহাতে আব্বু ও আপুর ট্রলিব্যাগ দুটো টানতে টানতে ট্যাক্সিওয়ে পর্যন্ত পৌঁছে কাউকে ফোন দিলে দু মিনিটের মধ্যে কালো রঙের বিশাল একটি গাড়ি এসে হাজির হয়। মার্থার গাড়ির পেছনের বুটে উঠাল দুটো ট্রলিব্যাগ আর গাড়ির দুপাশের দরজা দিয়ে দুজনকে উঠিয়ে দিল শীতল এই গাড়িতে। গাড়ি স্টার্টের ওপরই ছিল। ড্রাইভার ঘাড় ঘুরিয়ে স্পষ্ট বাংলায় জিজ্ঞস করল, ‘জার্নিটা কম্ফোর্টেবল হয়েছে তো স্যার?’
আব্বু অবাক।
জিজ্ঞেস করে, ‘নওশাদ হাম্মাদি আপনি সিঙ্গাপুরে কখন এলেন।’
আপু আগে কখনো নওশাদকে দেখেনি।
আব্বুর প্রশ্নের জবাবে বলল, ‘স্যার, আমার আসার কথা ছিল না। আপনি আর ম্যাডাম এলে আসতাম না। কিন্তু যখন জানলাম আপনার মেয়ে আসছে আমার দায়িত্ব যে অনেক বেড়ে গেল। কোথাও এতটুকু কষ্ট হলেও সুইট ইয়াং লেডি আমাকে সারাজীবন অভিশাপ দেবেন। তাহলে তো আমি আর জীবনে কোনোদিন দাঁড়াতেই পারব না। কিন্তু এই সুইট ইয়াং লেডিকে একটু খুশি করতে যদি পারি তাহলে তার ব্লেসিংই আমাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে।’
আব্বু বলল, ‘এই মেয়েটি আমার জন্যও গুডলাক। রাইসার জন্মের ঠিক তিনদিন পর আমি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের চাকরিটা পেলাম।’
অবশ্য মুক্তিযোদ্ধা কোটায় এই কথাটি আব্বু বলেনি, ‘কখনো বলেও না। কোথায় একটু গর্ব করে বলবে তা না করে নিশ্চুপ হয়ে যায়।’
নওশাদ হাম্মাদি গাড়ি চালাতে চালাতে লুকিং গ্লাসের ভেতর রাইসা আপুকে দেখে সরাসরি আয়নায় তাকিয়ে বললেন, ‘আমি জানি স্যার, শি উড ব্রিং মি গুডলাক টু।’
হোটেলের আলো ঝলমলে বিশাল লবিতে দাঁড়িয়ে রাইসা আপুর মনে হলো জায়গাটা অনেকটা স্বর্গের মতো।
এগার তলায় মুখোমুখি দুটো রুম। রুম নম্বর ১১০৩ এবং ১১০৪ আব্বু প্রথমেই বলল, ‘দুটো রুমের কী দরকার ছিল রাইসা তো আমার সাথেই থাকতে পারত।’
নওশাদ হাম্মাদি বলল, ‘প্রাইভেসি বলে একটা ব্যাপার আছে না স্যার। মেয়েদের প্রাইভেসিটাই সবচেয়ে ইম্পর্টেন্ট।’
হাম্মাদি বলল, ‘স্যার একটু রেস্ট করুন। রেস্তোরাঁ স্কাইটপে একেবারে ছাদে। মেয়েকে নিয়ে লাঞ্চ সেরে নেবেন। লাঞ্চ কুপন রুমে দেওয়া আছে। সাড়ে তিনটায় আমি এসে আপনাদের নিয়ে বের হব। সিঙ্গাপুরটা দেখাব। আমাদের নেতারা সুযোগ পেলে তাদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে দেশটাকে লুটেপুটে খায় আর দেখুন লি কুয়ান দেশটাকে সত্যিই একটা স্বর্গ বানিয়েছে।’
হাম্মাদি লবি থেকে বিদায় নিলেন। আব্বু ১১০৩ নম্বর রুমে ঢুকেই নওশাদ হাম্মাদি, মার্গারিটা ব্রাউনমিলার এবং গক চুক এই তিনজনের সইকরা ওয়েলকাম টু সিঙ্গাপুর এই বার্তা ধারণ করা একটি চিঠি পেল। তার অবস্থান সুখময় করার জন্য যা প্রয়োজন, তা বলতে আব্বু যেন দ্বিধা না করে সে অনুরোধও রয়েছে তিনজনের চিঠিতে। এক ঝুড়ি ফলও টেবিলের ওপর।
১১০৪ নম্বর রুমে ঢুকে রাইসা আপু পেল একগুচ্ছ লাল গোলাপের স্তবক। সাথে একটি পঙক্তি—মাই লাভ ইজ লাইক অ্যা রেড রোজ :রবার্ট ব্ল্যাক। তার মানে কথাটা নওশাদ হাম্মাদির নয়, রবার্ট ব্ল্যাক নামক একজন কবির।
রাইসা আপুর মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রেমের কবিতার একটি পঙক্তি এবং কিছু গোলাপই যথেষ্ট ছিল। হিন্দি সিনেমা ও সিরিয়ালভক্ত রাইসা আপু প্রেমে পড়ার জন্য এক পা এগিয়েই ছিল। যে কেউ গোলাপ ও কবিতার ইশারায় ডাকলে তো তার ঘর ছাড়ার কথা।
নওশাদ হাম্মাদি গোলাপ ও কবিতার সাথে এক বোতল ফ্রেঞ্চ পারফিউমও পাঠিয়েছে। রাইসা প্যাকেট খুলে বোতলের মুখে আঙ্গুলের চাপ দেয়। সুগন্ধ বাষ্প ঘরটাকে ছেয়ে ফেলে। পুরো ব্যাপারটাই যেন রাইসার স্বপ্নের কোনো এক কল্পলোকের বাস্তবায়ন। আব্বুর সাথে স্কাইটপ রেস্তোরাঁয় খেতে উঠে। এমনিতেই তার মন ভরে আছে। মন ভরে থাকলে ক্ষুধা কম লাগে।
পারফিউমের সৌরভের কাছে তার ক্ষুধা মার খেয়ে গেছে। রাইসা আপু শত খাবারের মধ্যে কেবল ক্যাশিওনাট সালাদ আর পাইনাপল জুসে মুখ লাগায়।
রাইসা আপু এমনিতে কম খায়, বেছে বেছে খায়।
আব্বু যখন তাকে সিঙ্গাপুর সফরে সফরসঙ্গী করার প্রস্তাব দিল রাইসা বলল, ‘তিন শর্তে যেতে রাজি আছি। প্রথম শর্ত আমাকে ক্যাবল কারে চড়াতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত আমি নিজে ঘুম থেকে না উঠলে আব্বু আমাকে ডেকে ঘুম থেকে জাগাতে পারবে না। তৃতীয় শর্ত আরো বেশি খাবার জন্য আব্বু পীড়াপীড়ি করতে পারবে না বা আমি কেমন করে খাচ্ছি আব্বু সেদিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে পারবে না।’
শর্তগুলো মেনেই তো সিঙ্গাপুর যাত্রা।
নওশাদ হাম্মাদি সাড়ে তিনটায় যখন সাইট সিয়িং করার জন্য তাদের গাড়িতে তুললেন আব্বু সেই কথাটা আবার তাকে বলেছে, ‘মেয়েটার কারণে আপনাকে একটা বাড়তি রুমের ভাড়া গুণতে হবে। রাইসাকে এনে আপনার খরচ বাড়িয়ে দিলাম।’
তিনিও পুরোনো জবাবটিই দিলেন।
‘সে কি কথা? প্রত্যেকটা মেয়েই তো এক একটা ইন্ডিভিজুয়াল। তাদের তো প্রাইভেসি থাকতে হবে তাই না স্যার? তাছাড়া আপনার মেয়েও তো আমারই গেস্ট। তার ভালোটা মন্দটা প্রাইভেসিটা তো আমাকেই দেখতে হবে। আমি নিশ্চয়ই ভুল বলিনি স্যার।’
দ্বিতীয় দিন সকাল দশটা থেকে সাড়ে এগারটার মধ্যে আব্বুকে হাসপাতালের তিনজন ডাক্তার দেখালেন। তারপর নওশাদ হাম্মাদির গাড়িতে স্যান্টোজা আইল্যান্ড। আব্বুর টেইককেয়ার করার জন্য হাম্মাদি সাথে নিয়ে এসেছে গায়ে পড়ে কথা বলা ধরনের এক চাইনিজ তরুণী, যেভাবেই হোক আব্বুকে একই সঙ্গে সন্তুষ্ট করতে হবে ও ব্যস্ত রাখতে হবে এই নির্দেশই পালন করেছে চপলা শিন জিন। আর রাইসা আপুকে নওশাদ হাম্মাদির চেয়ে ভালো দেখভাল কে করবেন। রোলার কোস্টার, অ্যান্ডার ওয়ার্ল্ড, হাঙ্গরের হা আতঙ্কের ও উত্তেজনার সবগুলো ইভেন্টেই আপুকে নিয়ে এলেন যাতে সন্ত্রস্ত হয়ে চিত্কার করে তাকেই জাপটে ধরে। ওয়াটার ড্যান্স দেখে ক্যাবল কারে চেপে রাইসা আপুর ফিরে আসা।
অনাবৃত পা ও স্তনাভাস দেখানো শিন জিন দীর্ঘ সময়ের জন্য আব্বুকে এতটাই মোহগ্রস্ত করে রাখে যে নিজের মেয়েটি কোথায় ঘুরছে এটা তার মাথায়ই আসে না। তবুও চাইনিজ মেয়েটি তাকে বলেছে, ‘তোমার মেয়ে সবচেয়ে নিরাপদ হাতে। হাম্মাদির মতো দ্বিতীয় একজন পুরুষ সিঙ্গাপুরে নেই।’
শিন জিন আব্বুকে বলে, ‘ম্যাসেজ পার্লার নিয়ে যদি তার কোনো প্রিজুডিস না থাকে তা হলে কাল সন্ধ্যাবেলা তাকে সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে ভালো ম্যাসাজ পার্লারে নিয়ে যাবে। এক ঘণ্টার ম্যাসাজ তাকে একেবারে ঝরঝরে যৌবনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। একটু এক্সপেনসিভ। সমস্যা নেই। তাকে দেখভাল করতে যা টাকা লাগে হাম্মাদির অ্যাকাউন্ট থেকেই যাবে।’
যেহেতু এমন একটা প্রস্তাব প্রত্যাখান করতে আব্বুর মন চাইল না, তাই শিন জিনকে বলল, ‘তুমি যা চাইবে তাই হবে, তোমার চাওয়াই আমার চাওয়া।’
দশ
এদিকে নওশাদ হাম্মাদি রাইসাকে বলল, ‘আমি আপনাকে সার্ভ করার আর একটু সুযোগ চাই।’
রাইসা বলল, ‘অনেক তো করেছেন আর কত?’
তৃতীয় দিন আব্বুকে শিন জিন এবং হাসপাতালের অ্যাটেন্ডেন্টের কাছে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার জন্য গছিয়ে দিয়ে নওশাদ হাম্মাদি বেরিয়ে এলেন। ইসিজি এমআরআই থেকে শুরু করে শরীরের সব পরীক্ষা একটি প্যাকেজের, টাকা আগেই জমা দিয়েছেন।
আব্বু জানে রাইসার যাতে একঘেয়ে না লাগে সে জন্য নওশাদ হাম্মাদির অন্য একজন নারী কর্মচারী তাকে কয়েকটি শপিং সেন্টার এবং আর্ট গ্যালারিতে নিয়ে যাবে।
নওশাদ হাম্মাদি জানেন রাইসাকে তিনি এতটাই মুগ্ধ করেছেন যে মেয়েটি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারবে না। তারই ইচ্ছের কাছে সমর্পিত হতে হবে।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে নওশাদ হাম্মাদি ফুল কিনলেন, বহুবর্ণ চকলেটও। তারপর সোজা হোটেল হিলটনের ১১০৪ নম্বর রুমে।
রাইসা বলল, ‘আপনাকে দেখে আমি একটু অবাক হইনি। কারণ আমি জানতাম আপনিই আসবেন। কোথাও যেতে হলে আপনিই নিয়ে যাবেন।’
‘আপনি জানতেন?’
‘হ্যাঁ, আপনি আমাকে তুমি বলছেন না কেন?’
‘বলব, যখন দুজনই দুজনকে তুমি বলতে পারব।’
‘ধ্যাত্, আমি আপনার মতো একজন সিনিয়র মানুষকে তুমি বলতে পারব না।’
হাম্মাদি বলল, ‘পারবেন। একটা সময় আসবে যখন তুমি বলবেন, এমনকি ধমকও দেবেন।’
‘সত্যি?’
‘অবশ্যই সত্যি।’
নওশাদ হাম্মাদির হাতে সময় বেশি নেই। তাছাড়া এসব কাজে টাকা যায় যাক কিন্তু সময় নষ্ট করা যাবে না।
রাইসার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। আলতো করে নিজের শরীরের দিকে টেনে আনলেন। তারপরে প্রক্রিয়াগুলো যেন স্বয়ংক্রিয়, একটুও বাধা দেয়নি রাইসা আপু।
রাইসার প্রাইভেসি রক্ষা করার জন্য নওশাদ হাম্মাদি যে রুমটি ভাড়া নিয়েছিলেন, সেই রুমেই তার কাছে প্রাইভেসি বিসর্জন দিয়ে রাইসা আপু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।
হাম্মাদি তাকে আঁকড়ে ধরলে কান্না আরো বেড়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি নিজের কাছে প্রমিজ করেছিলাম আমার হাজব্যান্ড ছাড়া অন্য কাউকে আমার প্রাইভেট কিছু দেখাব না, কারো সাথে ওসব করব না।’
হাম্মাদি বললেন, ‘এক্সাক্টলি। এটাই হওয়া উচিত একটি ভালো মেয়ের প্রমিজ।’
এবার হাম্মাদি তুমিতে নামলেন, ‘আমি তোমার প্রমিজ মিথ্যা হতে দেব না। আমার যা হওয়ার হোক। স্যার রাজি থাকুন বা নাই থাকুন আমি এসব করার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, তোমাকেই বিয়ে করব। আমরা বিয়ে করে ফেললে তো আর সমস্যা নেই।’
রাইসা তার চেয়ে একত্রিশ বছরের বড় বিশালদেহী মানুষটিকে বলল, ‘আপনি সত্যিই আমাকে বিয়ে করবেন।’
তিনি বললেন, ‘করতে চাই কিন্তু কথাটা বলতে ভয়ও পাই যে তোমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় বলে তুমি যদি আমাকে রিজেক্ট করে দাও।’
রাইসা বলে, ‘আপনি কি এমন বয়স্ক মানুষ। শুধু কানের দুপাশের চুলগুলোতে একটা কালো রং লাগাবেন। তখন আপনার বয়স কুড়ি বছর কমে যাবে।’
এসব বলতে বলতে দুজনের মধ্যে আবার সেই প্রাইভেট ব্যাপারগুলো ঘটে যায়।
সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা হাসপাতালে অবস্থান করার পর আমার আব্বু জানল তার লক্ষণগুলো পার্কিনসন রোগের, তবে খুবই প্রাইমারি স্টেজে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
আমার রাইসা আপু আমাদের জানিয়ে দিল তার হাজব্যান্ডের নাম হবে মিস্টার এন এইচ। নওশাদ হাম্মাদি।
নয় মাস আগে একবার সংগোপনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে সতের দিন নিরুদ্দেশ থাকার ঘটনা ছাড়া রাইসা আপুর জীবনে অন্য কোনো বড় কেলেঙ্কারি নেই। আব্বু রাইসাকে আপুকে এই বলে ক্ষমা করে দিয়েছে যে এই বয়সে দু-একটা ভুলচুক হতেই পারে, এটা আমার মেয়ের দোষ নয়, দোষটা তার বয়সের।
সতেরতম দিন মধ্যরাতে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়ার লাহিড়ি মোহনপুর গ্রামে হোসেন আলীর ফুফুর বাড়ি থেকে রাইসা আপু এবং ওয়ার্কশপ মেকানিক হোসেন আলীকে গ্রেফতার করা হয়। রাইসা আপুকে তাত্ক্ষণিকভাবে আব্বুর জিম্মায় দিয়ে দেওয়া হয় আর হোসেন আলী চলে যায় ওসির জিম্মায়।
নারী অপহরণের মতো এত বড় একটা অপরাধ করায় তাকে শাহি ডলা দেওয়া হয়। রক্ত বের হয়নি তবে মাংস হাড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জোগাড়। হোসেন আলী মার খেতে খেতে পুলিশকে বলেছিল, ‘আমাকে যত ইচ্ছে মারুন কিন্তু রাইসার গায়ে যেন একটি টোকাও না পড়ে, এই কথাটা আল আমিন সাহেবকে জানিয়ে দেবেন। রাইসার গায়ে হাত দিলে আমি তার ডান পা হাঁটু থেকে কেটে বাম হাতে ধরিয়ে দেব। নইলে আমার হোসেন আলী নাম পাল্টে ফেলব।’
পুলিশের কাছে ১৬১ ধারার জবানবন্দিতে হোসেন আলী বলেছে এই সতের দিনের মধ্যে মাসিকের চারদিন আর প্রথম দিন বাদ দিয়ে প্রতিদিনই অন্তত দুবার করে রাইসার সাথে সহবাস করেছে।
ব্যাপারটা জেনে আব্বু ঠিক করল, এই কথাগুলো জানাজানি হওয়া ঠিক হবে না, সুতরাং মামলাটা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করল এবং স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট কিংবা মাদক দ্রব্য সংক্রান্ত মামলায় ধরে তাকে চার মাস জেল খাটানোর সিদ্ধান্ত নিল। জেল খাটা শেষ হলে আব্বুর লোকজন হোসেন আলীকে রীতিমতো হুমকির মুখে ঢাকা শহর ছেড়ে নিজ জেলা পাবনায় চলে যাওয়ার নির্দেশ দিল। নতুবা তার বিরুদ্ধে নাবালিকা ধর্ষণের মামলা দেওয়ার কথা বলল। যার শাস্তি নির্ঘাত্ চৌদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।
হোসেন আলী আল্লাহর কাছে নালিশ জানিয়ে আরিচা থেকে নগরবাড়ির ফেরিতে উঠে এবং নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করে আর কখনো ঢাকা শহরে আসবে না।
হোসেন আলী মেকানিকের কাজটা ভালো করেই শিখেছিল। সাঁথিয়ার মোড়ে নিজেই কম পুঁজির একটা গ্যারেজ দিয়ে বসল। দ্বিতীয় মাসেই দেখল তার আয় ঢাকার কামাইয়ের প্রায় তিনগুণ। আয় কমাতে ঢাকা যাবে কোন শালা। প্রথম কদিন একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে তার দিন কেটেছে চোখ লাগলেই মনে হয়েছে রাইসাকে বেদম পেটানো হচ্ছে। আর আল আমিন নামের বয়স্ক মানুষটা শুধু বলছে, ‘তোর উপযুক্ত শিক্ষা হওয়া দরকার।’
হতে পারে অন্য কোনো পাত্রপক্ষ গবেষণা করে রাইসা আপুর জীবনের সংক্ষিপ্ত এই অধ্যায়টি আবিষ্কার করে ফেলতে পারে এই আশঙ্কাতে আব্বু খুশিমনেই তার প্রায় সমবয়সী নওশাদ হাম্মাদির হাতে নিজের বড় মেয়েকে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেয়। রাইসা আপু এবং তার হাজব্যান্ড হানিমুন করতে সিঙ্গাপুর যায় এবং সেই ১১০৪ নম্বর কক্ষটিতেই থাকে। ফেরার পথে ব্যাংককে একরাত কাটায়।
তাদের বিয়ের তৃতীয় মাসে জয়নব ফারাহনাজ গুম হওয়ার মামলায় নওশাদ হাম্মাদি গ্রেফতার হন। জামিনের জন্য হাইকোর্ট পর্যন্ত লড়তে হয়। রাইসা আপু কোনো প্রশ্ন না করে দুদিনে স্বামীর পাশে দাঁড়িয়েছে।
জয়নব ফারাহনাজ নওশাদ হাম্মাদির দ্বিতীয় স্ত্রী, তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে নিখোঁজ। জয়নবের প্রথম পক্ষের পুত্র ১৯ বছর বয়সী সালমান আইনুদ্দিন নওশাদ হাম্মাদির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। নওশাদ তার মাকে খুন করে কোথাও লাশ গুম করে রেখেছে বলে তার ধারণা। পুলিশ একবার তাকে রিমান্ডে নিতে পারলে জয়নবের মৃতদেহের অবস্থান বেরিয়ে আসবে।
রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর হয়নি, জামিনও হয়েছে। রাইসা তখন বলেছে, ‘নওশাদের মতো নরম দিলের একজন মানুষ যিনি মুরগি জবাইও সহ্য করতে পারেন না, তিনি একজন নারীকে হত্যা করবেন এটা বিশ্বাস করা যায় না।’ সাংবাদিকরা বাসা পর্যন্ত ছুটে আসে। রাইসাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ধরুন, জয়নব ফারহানাজ ফিরে এলেন আপনি কি তাকে সতীন হিসেবে মেনে নেবেন?’
রাইসা আপুর স্মার্ট জবাব, ‘আমার কথা কেন ভাবছেন, জয়নাব ফারাহনাজ আমার আগে নওশাদ হাম্মাদি সাহেবের স্ত্রী ছিলেন। তিনি আমাকে মেনে নেবেন কি না সেটাই বড় প্রশ্ন।’
নওশাদ হাম্মাদির প্রথম স্ত্রী স্বামীর ছোটবেলার বন্ধু ইরতিজা হোসেনের সাথে বাংলাদেশ ছেড়েছেন এবং প্রায় তিন মাস পর তালাকের উকিল নোটিশ দিয়েছেন।
নওশাদ হাম্মাদি নোটিশটিকে এতটুকুও গুরুত্ব দেননি, এমন স্বাভাবিক আচরণ করেছেন যেন কিছুই হয়নি।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে জোয়ারভাটা থাকে। এই জোয়ারভাটার মধ্য দিয়ে রাইসা আপু ও নওশাদ দুলাভাইয়ের সম্পর্কটা বেশ টিকে আছে। তাদের তিনটি কন্যা সন্তান সোফিয়া হাম্মাদি এলিজাবেথ হাম্মাদি ও ম্যারিলিন হাম্মাদি।
সবশেষে যে বিষয় নিয়ে নওশাদ হাম্মাদির ডাবল কলাম ছবি খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে তা সরকারের জন্য খুব বিব্রতকর। হাম্মাদি বেসিক না সোনালি নাকি অন্য কোনো একটি ব্যাংকের ভল্ট খালি করে নিয়েছে। অজ্ঞাত কারণে তার গায়ে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। অজ্ঞাত কারণ কখনোই অজ্ঞাত নয়, এ নিয়ে সারাদিনই অফিসে ফিসফাঁস চলে তাতে জ্ঞাত দুটি বিষয় উল্লেখ করা হয়। নওশাদের মায়ের একজন আত্মীয় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এবং তার শ্বশুর একজন বিশিষ্ট আমলা।
জামিন নিয়ে ফিরে এলে রাইসা বলেছে, ‘ফর গডস সেইক, মেয়েদের কথা ভাবো। তোমার যা আছে যথেষ্ট। আমাদের আর টাকা চাই না। তুমি বাসা থেকে বোরোতে পারবে না।’
নওশাদ স্ত্রীর কথা শুনবেন না এটাই সত্য। তবু বললেন, ‘আচ্ছা সুইটি, তোমার আদেশই শিরোধার্য।’
রাইসা আপু তার হাজব্যান্ডের কাছে সুইটি ডাকটি খুব পছন্দ করে।
এগার
আমার মেজো বোনের নাম রাইমা। আমার রাইমা আপু। সুচিত্রা সেনের নাতনির নামও রাইমা। সেও অভিনয় করে।
আমাদের রাইমার অভিনয়ের ঝোঁক নেই। তার প্রায় সব কাজই পুরুষালি ধরনের। স্কুলের মহিলা ফুটবল টিমের ভাইস ক্যাপ্টেন হয়েছে, ভারোত্তোলনে সিনিয়র গ্রুপের মেয়েদের মধ্যে থার্ড হয়েছে। দড়ি টানাটানিতে দড়ির একপ্রান্ত নিজের কোমরে পেঁচিয়েছে এবং হেঁচকা টানে প্রতিদ্বন্দ্বীদের কুপোকাত্ করেছে। গলার স্বর বেশ স্পষ্ট এবং ভয়েস অব আমেরিকার পুরুষ সংবাদ পাঠকের মতো গমগম করা কণ্ঠ। একটি জিমনেশিয়ামে কিছুদিন কুস্তিও প্র্যাকটিস করেছে।
নারী কুস্তিগির হিসেবে কেমন অনুভব করেন?
একবার জিমনেশিয়ামে ঢুকে জলসা টিভি রাইমার সাক্ষাত্কার নিয়েছে। রাইমা বলেছে, ‘ব্যাপারটা দারুণ তবে আমার মতো নারীদের হারিয়ে মজা পাই না, বেটা ছেলেদের সাথে লড়তে চাই।’
তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘আপনি কি মনে করেন না মেয়েদের শরীরের গঠনই তাকে ছেলেদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বড় অন্তরায়।’ অন্যরা সবাই বিব্রত হলেও রাইমা অন এয়ারে অবলীলায় বলে ফেলল, ‘কুস্তি কিংবা বক্সিং দুটোতেই নারী হওয়ার সুবিধা বেশি। কোনোভাবে পুরুষমানুষের দু’পায়ের ফাকে ও দুটো মুঠোতে ভরে ঠিকমতো চাপ দিতে পারলেই তার দম বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা হবে। বলুন দুই পায়ের ফাঁকে আপনি মেয়েদের কী ধরবেন? কিছুই ধরার নেই। আমি যে নারী হয়ে জন্মেছি এজন্য আমি গর্বিত।’
রাইমার সাক্ষাত্কারের এই অংশটুকু একালের ভাষায় ভাইরাল হয়ে যায় কোনো সংবাদপত্র এ নিয়ে খবর তৈরি করে, কোনো কোনো সংবাদপত্র সাক্ষাত্কারটির পুনর্মুদ্রণ করে। একটি পত্রিকা লেখে পুরুষাঙ্গ নেই বলে কুস্তিগির রাইমার কোনো আফসোস নেই। একটি লিখল, পুরুষ কুস্তিগিররা সাবধান, স্ক্রোটাম সামলে রাখুন। এটি আপনাদের শরীরের সবচেয়ে নাজুক অঙ্গ। সাক্ষাত্কারে পুরুষাঙ্গ গোপনাঙ্গ এসব প্রসঙ্গ আনায় আব্বু রাইমার ওপর বেশ চটেছে।
রাইমা আপুর বিয়েটা বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে হয়েছে। তার হাজব্যান্ড এনএইচ মিন্টু একজন সিনিয়র মন্ত্রীর শ্যালক হওয়ায় কিছু মন্ত্রী দাওয়াত পেয়েছেন এবং কমদামি উপহার নিয়ে তারা হাজির হয়েছেন।
কাঠমান্ডুতে হানিমুন সেরে বিমানে করে রাইমা আপুকে নিয়ে যখন ঢাকা এয়ারপোর্টে নামলেন ইমিগ্রেশন লাইন পার হওয়ার পর সাথে সাথে সাদা পোশাকের কয়েকজন পুলিশ তাকে ঘিরে ধরে এবং বলে, ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।’
‘এটা কি মামাবাড়ির আবদার নাকি?’ এ কথা বলে স্ত্রীর সামনে নিজের বীরত্ব জাহির করার জন্য আর ঠিক সামনের পুলিশ সদস্যের নাক বরাবর এক ঘুষি বসিয়ে দেন। তখনই পুলিশের নাক থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করে। কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থেকে অন্য কজন পুলিশ তখনই আপুর বাধা উপেক্ষা করে দেড় মিনিটের মধ্যে তাকে চ্যাংদোলা করে এয়ারপোর্টের ভিআইপি গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল।
রাইমা আপু নিজেকে সামলে নিয়ে কনভয়র বেল্ট থেকে নিজেদের স্যুটকেস নামিয়ে আব্বুকে ফোন করল এবং বলল, ‘তুমি যদি এয়ারপোর্টের দিকে আসতে সবচেয়ে ভালো হতো, তোমার সমস্যা থাকলে এমন কাউকে পাঠাও যে মিন্টুর লোকেশনটা বের করতে পারবে এবং আমাকে কী করতে হবে সে পরামর্শ দিতে পারবে।’
বার
নেপালে থাকায় খবরের কাগজ তাদের দেখা হয়নি এবং আমার শরীরটা আরো খারাপ হয়ে যাওয়ার বাসার কাগজের ভাঁজও খুলিনি।
একেবারে প্রথম পাতায় নিচের দিকে একটি বিজ্ঞাপন, স্যুট-টাই পরা এনএইচ মিন্টুর ছবির নিচে লেখা প্রতারক মিন্টুকে ধরিয়ে দিন, নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার।
ছবি ও শিরোনামের নিচে যা লেখা তার সারকথা হলো; প্রতারক নুরুল হোসেন ওরফে এনএইচ মিন্টু রড্রিগস অ্যান্ড রড্রিগস কোম্পানির সিওও (চিফ অপারেটির অফিসার) সেজে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে কোম্পানির ভুয়া শেয়ার বিক্রি করে প্রায় আড়াই কোটি টাকা আত্মসাত্ করেছেন। প্রকৃত পক্ষে তিনি ছিলেন কোম্পানির বৈদেশিক লেনদেন শাখার অ্যাকাউন্টস অফিসার। রড্রিগস অ্যান্ড রড্রিগস কোম্পানির অর্গানোগ্রামে সিওওর পদ থাকলে এখন পর্যন্ত কাউকে সে পদে নিয়োগ করা হয়নি। প্রতারক এনএইচ মিন্টুকে চাকরিচ্যুত করে তার বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপনে আরো বলা হয় এনএইচ মিন্টুর সাথে কোনো ধরনের লেনদেন করে থাকলে সে দায় কোম্পানি বহন করবে না। তাকে ধরিয়ে দিলে কোম্পানি ৫০০০০ টাকা পুরস্কার দেবে।
মিন্টু দুলাভাইয়ের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও তিনি স্বাধীন মানুষের মতো সবার চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
আব্বু জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাকে আবার অ্যারেস্ট-ট্যারেস্ট করবে না তো?
‘প্রশ্নই আসে না।’
‘কেন, পুলিশের সাথে কোনো বোঝাপড়া হয়েছে নাকি?’
‘আমার হয়নি তবে কোম্পানি করেছে।’
‘মানে ওরাই তো তোমাকে ধরে দেওয়ার জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকার অ্যাওয়ার্ড ডিক্লেয়ার করেছে।’
‘তা করছে পরশু রাতে আমি নিজেই কোম্পানির চেয়ারম্যানের বাসায় গিয়ে হাজির হয়ে বললাম, দিন পঞ্চাশ হাজার। আপনাদের বিজ্ঞাপন দেখে নিজেই নিজেকে ধরে নিয়ে এসেছি। চেয়ারম্যান সাহেব একটু চটেছিলেন। কিন্তু যখন বললাম আমাকে বেশি ঘাটাবেন না। আপনার মানি লন্ডারিংয়ের আটটা স্পেসিফিক কেইস আমার হাতে আছে। বাকিগুলোও এসে যাবে। টাকা পাচারের বড় কাজগুলো আপনি আমাকে দিয়েই করিয়েছেন, ভুলে গেছেন স্যার। ব্যস, এক কথায় কাজ হয়ে গেল। কোম্পানি নিশ্চয়ই পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেছে নতুবা এতক্ষণে তো আমার শিকের ভেতরে থাকার কথা।’
দেরিতে হলেও তার বিয়ের আগের আর একটি কাহিনি রাইমা আপুর কানে আসে। হাতে টাকাপয়সা আসতে শুরু করলে তিনি একজন বয়স্ক কমার্শিয়াল সেক্স ওয়ার্কারের সাথে বসবাস করেন। মহিলার একমাত্র কন্যা সন্তানের পিতৃত্ব স্বীকারের অঙ্গীকার করে উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরে দুজনের যৌথ নামে পঁচানব্বই লক্ষ টাকা দামের একটি অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য একটি অ্যাকাউন্টে নিজের পঞ্চাশ লক্ষা টাকা সেই নারীর উপস্থিতিতে জমা রাখেন। যৌনবাণিজ্য ফেন্সিডিল বিক্রি—বিভিন্ন উত্স থেকে তার সারা জীবনের সঞ্চয় আটত্রিশ লক্ষ টাকা নিয়ে মিন্টু বলেন, ‘সমস্যা নেই বাকি সাত লক্ষ টাকাও আমিই দেব, অ্যাপার্টমেন্ট রেজিস্ট্রি হবে দুজনের নামে।’
টাকাটা হাতে পাওয়ার সাতদিনের মধ্যেই গলা টিপে সেই নারীকে হত্যা করে কালো পলিথিন ব্যাগে ভরে ঘরের ভেতরে একটা বড় কালো ট্রাঙ্কে ঢুকিয়ে তালা মেরে বেরিয়ে যান। পাসপোর্টে ইন্ডিয়ার মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা ছিল। আরবি পোশাক পরে চোখে সুর্মা দিয়ে একচল্লিশ দিনের এক ধর্মীয় সফরের কথা বলে দেশ ছাড়েন। হাতে তখন অঢেল টাকা। প্রায় বছর খানেক পর যখন তিনি ফিরে আসেন বাণিজ্যিক যৌনকর্মী মেঘনা হত্যাকাণ্ডের বিষয় তখন গুরুত্বপূর্ণ খবরের আড়ালে একেবারে তলিয়ে যায়।
দাড়িশোভিত ধবধবে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত নুরুল হোসেন মিন্টু তখন রড্রিগস অ্যান্ড রড্রিগস কোম্পনিতে যোগ দেন। খুনের অভিযোগে মেঘনার প্রাক্তন স্বামী তেজগাঁয়ের ঝুট ব্যবসায়ী ওসমান গনি তখন জেল খাটছেন। বারবার জামিনের আবেদন করা হলেও অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে তাকে জামিন মঞ্জুর করা হয়নি। তখন পর্যন্ত পুলিশও মামলার চার্জশিট দেয়নি।
তের
মিন্টু দুলাভাই প্রত্যেক শুক্রবার বিকেলে রড্রিগস অ্যান্ড রড্রিগস মেডিক্যাল ইউনিটের একটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আমাকেই দেখতে আসেন, আস্তে করে হুইল চেয়ারসহ আমাকে তাতে তুলে নেন। কোনো দিন বুুড়িগঙ্গা সেতু,ু কোনো দিন জাতীয় স্মৃতিসৌধ, হাতে সময় কম থাকলে আশপাশে চন্দ্রিমা উদ্যোন কি লালবাগ কেল্লা ঘুরিয়ে স্ট্রিট ফুড-বার্গার, চিকেন ফ্রাই এসব খাইয়ে আবার নামিয়ে দিয়ে যান। আমার প্রিয় আশুলিয়ার মোবাইল ফুড কোর্ট—ইয়ানতুন খাই যান। মিন্টু দুলাভাইও বলেন, ‘বড় রেস্তোরাঁয় খাবারের চেয়ে স্ট্রিট ফুড তার বেশি প্রিয়।’
তার কাছে রাজ্যের সব খবর থাকে। একদিন বললেন পরী নামের একজন নায়িকা একজন বিখ্যাত হুজুরের নাতনি। একদিন বললেন অপজিশনের দুজন ব্যারিস্টার গভর্নমেন্টের সাথে হাত মিলিয়েছেন, অন্যদিন শোনালেন উত্তরে নাকি কিসের ফিসফিস চলছে।
রাইমা আপু বলল, ‘লিলিপুটের সাথে এসব গল্প করতে তোমাকে কে বলেছে?’
মিন্টু দুলাভাই বললেন, ‘তোমাদের বাড়িতে একমাত্র ওকেই তো নিউজ পেপার ঘাটতে দেখি।’
যা রাইমা আপু জানে না, তা হলো নওশাদ হাম্মাদি সম্পর্কে তার স্বামী মিন্টুর ধারণা। আমাকে তিনি বলেছেন, ‘শালা হাম্মাদির দিন শেষ। আমি তার বহু অপকর্মের রেকর্ড নিজের কাছে নিয়ে এসেছি। শালা নিজের বউ ছেড়ে আমার বউ রাইমার দিকে হাত বাড়িয়েছে। আমি কব্জি থেকে তার দুহাত কেটে ফেলব আর মিডলস্ট্যাম্প গোড়া থেকে কেটে দিয়ে শালাকে খোজা বানিয়ে দেব।’
‘মিডল স্ট্যাম্প?’
মিন্টু দুলাভাই বললেন, ‘দুই ঠ্যাংয়ের মাঝখানেরটা।’
আমার ছোট বোনের হাজব্যান্ড সউদ ইব্রাহিম, আপাতদৃষ্টিতে পরহেজগার মানুষ। আমি সউদকে ‘তুমি’ বলি, আর ছোট আপুকে ‘তুই’। সউদ নিজেই আমাকে বলেছে, দাড়ি গজানোর পর কোনো দিন গালে ক্ষুর কিংবা ব্লেড লাগায়নি। এ ধরনের মানুষ নবীজীর শাফায়েতে সহজে পুলসিরাত পার হতে পারবে। তার বয়স তেত্রিশ বছর। যদি ষোলতে দাড়ি গজিয়ে থাকে গত সতের বছরে তা হাঁটুর নিচে নেমে যাওয়ার কথা। কিন্তু দাড়ির জন্মগত বিশেষ গোটিশ-প্যাটার্নের কারণে তা কখনো হোচিমিনের দাড়ি ডিঙ্গিয়ে যেতে পারেনি।
তার কোনো অফিস নেই কিন্তু গোটা দশেক বিজনেস কার্ড আছে। ছবির অ্যালবামের মতো দেখতে এমন একটা বিজনেস কার্ড হোল্ডার আমার আছে। প্রতিপাতায় চারটা করে পাশাপাশি দু’পাতায় তার আটটা কার্ড। কোনোটাতে ঠিকানা নেই। ই-মেইল আর ফোন নম্বর আছে। ১. সউদ ইব্রাহিম, চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার, অল সলিউশনস, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কনসার্ন, ২. সউদ ইব্রাহিম, ভাইস প্রেসিডেন্ট, টাইগার গ্রুপ, ৩. সউদ ইব্রাহিম পিএইচডি, ইনভেস্টমেন্ট অ্যানালিস্ট; ৪. সউদ ইব্রাহিম, লিড অর্গানাইজার, ঢাকা বিউটি কনটেস্ট, ৫. ডক্টর সউদ ইব্রাহিম প্রাইম মিনিস্টার্স অ্যাডভাইজার ফর এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স; ইউনিভাসিটি অব নেব্রস্কা, ইউএসএ ৮. এস ইব্রাহিম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট. রাস আল খাইমা টেলিভিশন।
আমার ছোট আপুর নাম রায়হানা। শুরু থেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া আমাদের পরিবারের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটার সুবিধাবঞ্চিত সদস্য। প্রথমত; ইংলিশ মিডিয়াম কোনো প্রতিষ্ঠান আর সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কি সন্তানের সন্তান কোটার তেমন কোনো গুরুত্ব দেয় না। তাছাড়া আব্বু যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রায়হানাই এটা ড্রাম পিটিয়ে বাসার সবাইকে বলেছে। সে আরো নিশ্চিত হয়েছে সউদের হিটলু মামার কাছ থেকে। একাত্তরে নবাবপুরের পাকিস্তানি কাবাবের দোকানে বসে এই হিটলু মামা এবং আব্বু প্রায়ই শিক কাবাব খেত এবং আরো কী সব করত। নারী বলে এবং একই সঙ্গে মুন্সি আল আমিনের মেয়ে বলে তা তিনি বলতে পারবে না।
‘কিন্তু আব্বু তো মুক্তিযোদ্ধা।’
হিটলু মামার জবাব, ‘আমারও সার্টিফিকেট আছে। নগদ পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বাহাত্তরের শেষদিকে সার্টিফিকেটটা নিয়ে ছিলাম। অবশ্য সউদ ইব্রাহিমের শ্বশুরের মতো আমি এটা তেমন কাজে লাগাতে পারিনি।’
সাধারণ কথাবার্তায় ইংরেজি ব্যবহার করলেও রায়হানা আপু যখন সউদ দুলাভাইয়ের সাথে ঝগড়া করে, তখন তার ভাষার যে ব্যবহার তা মোটেও নারীর কণ্ঠে শুনতে কেউ অভ্যস্ত নয়। যেমন বলে, ‘আব্বে সউদের বাচ্চা, তুই তো একটা পুরা ধ্বজভঙ্গা!’ কিংবা সউদকে শুনিয়ে বলে, ‘শালা তোর মায়রে বাপ, আর একটা কথা বললে তোর টেংরি ভেঙ্গে দেব।’
এ পর্যন্ত সউদ তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। কিন্তু রায়হানা কোঁকড়ানো চুলের একটি কন্যা সন্তান ডেলিভারি দেওয়ার ছয় মাস পর সউদ যখন নিশ্চিত হলো ফর্সা মেয়েটি সত্যিই কোঁকড়া চুলের, সে ক্ষেপে গেল। বলল, ‘আমার চৌদ্দগুষ্টিতে কোঁকড়া চুলের কোনো নারী নেই। তোমার ফ্যামিলিতেও কারো কোঁকড়া চুল দেখছি বলে মনে হয় না। এটা তাহলে আমার বাচ্চা নয়, কোঁকড়া চুলের অন্য কারো।’
রায়হানা হাতের কাছে থাকা পানিশূন্য গ্লাস তাকে তাক করে ছুড়ে মারল এবং বলল, ‘মোনালি তোর বাচ্চা নয় তো কার?’
মোনালি নামটা রায়হানার রাখা। সউদ চেয়েছিল নবীজীর পরিবারের কোনো নারীর নাম রাখতে, কিন্তু এগোতে পারেনি।
মোনালির যখন সাত মাস কেবল কিছু সংখ্যক বিজনেস কার্ড-সর্বস্ব, কার্যত বেকার সউদ ইব্রাহিম মেয়ের ও তার ডিএনএ টেস্টের দাবি তুলল। দুজনের ঝগড়ার বিষয় এই আল-আমিন ফ্রিডম আর্কেড ভবনের সুইপার থেকে দারোয়ান পর্যন্ত কারো জানার বাকি থাকল না। ঝগড়া শুরু করে আমার আপু রায়হানাই, ‘আব্বে সউদের বাচ্চা, তুই আমাকে সন্দেহ করিস? তাহলে এই দেখ তোর চোখের সামনে আমি গলা টিপে মোনালিকে হত্যা করব!’
হত্যার উদ্দেশ্যেই হোক কি সউদ ইব্রাহিমকে ঘাবড়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে রায়হানা যখন ছোট্ট মোনালির গলা টিপে ধরল সউদ দ্রুত তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে ক্রন্দনরত মেয়েটিকে পাশের রুমে নিয়ে এল। সউদকে যন্ত্রনা দেওয়ার নতুন একটি হাতিয়ার পেয়ে গেল আমার ছোটআপু। বলল, ‘যদি মোনালি তোমার মেয়ে না হয় তার ওপর তোমার কোনো অধিকার থাকতে পারে না। আমার যা ইচ্ছে তা করব। যখন ইচ্ছে গলা টিপে মারব নতুবা বাথটাব পানিতে ভরে তিন মিনিট ওকে চুবিয়ে রাখব। দেখি কেমনে বাঁচাও।’
আল আমিন আর্কেডে কোঁকড়া চুলের একজনই মানুষ ছিল, কম বেতনের একজন কর্মচারী। প্রায় একমাসের বেতন না নিয়ে এই মানুষটি নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। কিছুটা বিচ্ছিরি চেহারার এই মানুষটির নাম সোলায়মান আলী। বয়স কুড়ি একুশের বেশি হওয়ার কথা নয়। রায়হানার চেয়ে ছোটই হবে। সোলায়মান আলী আমাদের বিল্ডিংয়ের কেয়ারটেকারের অ্যাসিস্ট্যান্ট। কেয়ারটেকারের ফুটফরমাশ খাটা তার কাজ, ইলেকট্রিশিয়ানের ছোটখাটো কাজও তার জানা। ইন্টারকমে কোনো অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কোনো অভিযোগ এলে সরেজমিন দেখার জন্য সোলায়মানকেই পাঠিয়ে দিত। ফিউজড বাল্ব সরিয়ে নতুন বাল্ব লাগানো, বেসিনে আটকে যাওয়া পানি সরানোর জন্য মাথা নুইয়ে বেসিনের পাইপে একটি ঝাঁকি দেওয়া, কমোডের ফ্ল্যাশ ঠিকমতো কাজ করছে কি না দেখা—এসব সোলায়মানই করে, কোন সমস্যায় কোন ধরনের মিস্ত্রিকে ডাকতে হবে, তার জানা আছে, গ্যাসের চুলার মিস্ত্রি, তালাচাবির মিস্ত্রি, এয়ার কন্ডিশনারের মিস্ত্রি, ফ্রিজের কমেপ্রশার ঠিক করার মিস্ত্রি, প্লাম্বার খাট ও সোফা মেরামতের মিস্ত্রি, ইলেকট্রিশিয়ান এবং এমনকি বিয়ে পড়ানোর কাজির নম্বরও তার সস্তা দামের নকিয়া ফোনে সেইভ করা আছে।
সোলায়মান আলী যেকোনো কাজই ‘জ্বি আচ্ছা এখনই করে দিচ্ছি’ বলে লেগে পড়ত। এমনিতে চেহারাটা সুবিধের নয়, মুখেও হাসি নেই, চোখ তুলেও কারো দিকে তাকত না।
একটা কাজ খুব নিষ্ঠার সাথে করত, রাত গভীর হলে বাঁশি বাজাত। এ তার নিত্যকার রুটিন, কিছুক্ষণ বাঁশি বাজানোর পর একটু ক্লান্তি এলে ঘুমটা ভালো হতো। রাতে ঘুমাত গেটঘেঁষা গার্ডশেডে। তার সাথে থাকত লিফট অপারেটর মোফাজ্জল হেসেন।
চৌদ্দ
কোঁকড়া চুলের সোলায়মান আলীর নিরুদ্দেশ হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে কেউ গবেষণা না করলেও সউদ সন্দিহান হয়ে উঠেছিল। এক রাতে বাড়ি ফিরে সউদ দেখে রায়হানা এই ছোকরার কাছে বাঁশি বাজানো শিখতে চেষ্টা করছে।
সে রাতে সউদ খুব বিনয়ের সাথেই রায়হানাকে বলল, ‘যদি বাঁশি শিখতে চাও ছায়ানটে ভর্তি হয়ে যাও কিংবা বাফাতে। খুব দূরে তো নয়, কিংবা যদি বল একজন ওস্তাদকেও বলতে পারি বাসায় এসে শেখাবে। হয়তো টাকা একটু বেশি নেবে। বংশীবাদক হাকিম ভাই আমাদের পরিচিত, বললে একজন ভালো টিচার বের করে দেবেন।’
রায়হানা বলল, ‘আমার শিখতে ইচ্ছে করে রাতের বেলা। তখন ছায়ানট, বাফা বন্ধ থাকে। আমার জন্য এই ওস্তাদটাই ভালো, পয়সাকড়ি দিতে হয় না। চাও খায় না। শুধু বলেছে, তোমার পুরোনো শার্ট-পেন্ট যেগুলো বাতিল করে দেবে সেগুলো তাকে দিলেই খুশি থাকবে।’
‘সে কি বাঁশির ওস্তাদ নাকি?’
রায়হানা বলল, ‘আমার জন্য তার চেয়ে বড় ওস্তাদ দরকার নেই।’
সউদ বলল, ‘সে এই অ্যাপার্টমেন্টের কাজের ছেলে।’
রায়হানা বলল, ‘তাও ভালো, তোমার মতো বেকার তো নয়। তার কোনো বিজনেস কার্ড অবশ্য নেই।’
সউদ কাতর হয়ে বলল, ‘সে বাঁশি শেখাতে এলে এই বিল্ডিংয়ের মানুষ এটা ওটা বলবে।’
‘বলুক, রাতের বেলা বড় ওস্তাদ এলেও তো একই কথা বলত। বেশি ভয় থাকলে তুমি নিজে শিখে আমাকে শেখাও।’
সউদ বলল, ‘তাই শেখাব।’
রায়হানা বলল, ‘বেশি বাড়াবড়ি করবে না। তোমার মতো ধ্বজভঙ্গের ক্ষমতা আমার জানা আছে।’
সেই সোলায়মানের নিরুদ্দেশ হওয়ায় অন্তত সউদ ইব্রাহিমের মনে প্রশ্ন জাগবেই। সে কি পালিয়ে গেছে? নাকি রায়াহানা তাকে সরিয়ে দিয়েছে? নাকি কোঁকড়া চুলের মোনালির সঙ্গে সোলায়মানের আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই, পুরোটাই তার অবসেশন?
মোনালির বয়স তখন এক ছুঁই ছুঁই। তাকে নিয়ে দুজনের ঝগড়া তখন চরমে উঠেছে। যৌন অক্ষমতা গোপন করার জন্য রায়াহানা আপু সউদকে প্রতারক ও মিথ্যেবাদী বলে। আব্বুকেও এতটুকু ছাড় দেয় না। আব্বুর আগ্রহেই তার এককালের বস দাউদ ইব্রাহিমের ছোট ছেলে, ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট গ্র্যাজুয়েট সউদ ইব্রাহিমকে তার বিয়ে করা।
সানাউল নামের যে ক্লাসমেটটির সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক তাকে বেশ ভালো করে বুুঝিয়েছে কেন তাদের বিয়ে করাটা ঠিক হবে না। তাকে বলেছে, ‘যখন তোর বয়স পঞ্চাশ বছর হবে, আমারও তখন পঞ্চাশ। তখন পঞ্চাশ বছরী বয়স একটা আধ-বুড়িকে পাশে নিয়ে চলতে তোর ভালো লাগবে না। আমার চোখের সামনে তুই তখন কম বয়সী মেয়েদের পটাচ্ছিস এটা আমারও সহ্য হবে না। আমি বরং সাত-আট বছরের সিনিয়র একজনকে খুঁজে নিই। তুইও সাত-আট বছরের জুনিয়র কাউকে বিয়ে করিস। আমার হাজব্যান্ড আর তোর ওয়াইফের অ্যাইজ ডিফারেন্স হতে হবে পনের বছর।’
সানাউল বলল, ‘বেশ, তাহলে কখনো আমার সামনে পড়িস না। আমার মেজাজ যদি ঠিক না থাকে তা হলে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারতে পারি। তোকে আমি ভালোবাসব আর অন্য কোনো পুরুষ তোকে ভোগ করবে, তুই চাস আমি এটা মেনে নিই?’
রায়হানা বলল, ‘সেটা তুই কখনো করবি না, এমনকি তোর হাতে অ্যাসিড এনে দিলেও আমার গায়ে ছুঁড়তে পারবি না, কারণ তুই আমাকে ভালোবাসিস, ভবিষ্যতেও বাসবি।’
সউদ ইব্রাহিমের যৌন নিস্পৃহতা তাকে বারবার সানাউলের অসহায় কিন্তু কামপ্রবণ চেহারাটার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে, আকুল হয়ে সানাউল বলেছিল, ‘তাহলে অন্তত একটা রাত আমার সাথে থাকিস। যেদিন তোর সুবিধে সেদিনই।’
সউদ ইব্রাহিমের যখনই মোনালির উপর চোখ পড়েছে একই সঙ্গে দু ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছে। প্রথমত নিজের অক্ষমতার ক্ষোভ তাকে অস্থির করে তুলেছে। দ্বিতীয়ত রায়হানা এই নিরপরাধ মেয়েটিকে গলা টিপে মেরে ফেলতে পারে এই যন্ত্রণাটিও তাকে ভুগিয়েছে।
সাত হাজার টাকা বেতনের একজন অ্যাসিস্টেন্ট কেয়ারটেকারের কাছেই কি তাহলে সে মার খেয়ে গেল? আবার এটাও সে নিশ্চিত নয়।
পনের
মোনালির প্রথম জন্মদিনের অনুষ্ঠানটি বেশ জমজমাটই হয়েছে। মোনালির জন্মদিন উপলক্ষে সউদ দুলাভাই আমাকে দুটো লাল ফতুয়া ও দুটো সাদা ট্রাউজার উপহার দিয়েছে। পায়ের কারণে আমার ট্রাউজার পরা হয় না। সাড়ে তিন ফুট লম্বা তরুণের কাপড় তো আর দোকানে অ্যাডাল্ট ফ্লোরে পাওয়া যায় না, কিনতে হয় কিডস কর্নার থেকে। সউদই আমাকে একদিন বুঝিয়েছে—পৃথিবীকে রক্ষা করতে হলে ন্যাচারালি হোক কিংবা আর্টিফিশিয়ালি মানুষকে তার বর্তমান সাইজের অর্ধেক করে ফেলতে হবে। তাতে পৃথিবীর টিকে থাকার সময়টা দ্বিগুণ হবে। সাইজ অর্ধেক হলে দশতলা বিল্ডিংয়ের উচ্চতায় কুড়ি-তলা করা যাবে, দ্বিগুণ মানুষের আবাসন হবে, একজনের শার্টের কাপড়ে দুজনের শার্ট হবে, খাবার প্রায় অর্ধেক কমে আসবে, পৃথিবীর যে প্রাকৃতিক সম্পদ বিলীন হয়ে যাচ্ছে, তা হতে দ্বিগুণ সময় নেবে।
আমি তার সঙ্গে হাত মেলাই। বলি, তার মানে সার্ভাইভাল অব দ্য শর্টেস্ট । যত ছোট তত টিকে থাকার এবং পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখার সম্ভাবনা বেশি।
সউদ ও রায়হানা দুজনই মোনালিকে নিয়ে আমার রুমে এল। মোনালি তার বার্থডে কেকের খানিকটা আমার মুখে ঢুকিয়ে খানিকটা মুখমণ্ডলে মাখিয়ে আমার সাথে ছবি তুলল। আমার আর মোনালির জন্মের তারিখটা একই—একুশ। তবে তিন মাস আগে পরে, সাথে আরো সতের বছর। সেই জন্মদিনের রাতে পূর্ণিমা ছিল। আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে চাঁদটা দারুণ দেখায়। মোনালির জন্মদিনটিতে কোঁকড়া চুল কিংবা অন্য কোনো কারণে একবারও ঝগড়া হয়নি, দুজনই হাসাহাসি করেছে। মোনালি হওয়ার পর সউদ ঘরে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। খুব ইচ্ছে হলে ছাদে চলে যায়।
হয়তো সিগারেটের ইচ্ছেটা জাগায় মোনালিকে কোল থেকে নামিয়ে তার কপালে একটা চুমো দিয়ে প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট বের করে আরো কিছু একটা প্যাকেটে ঢুকিয়ে এই তো আসছি বলে সউদ ইব্রাহিম আল আমিন ফ্রিডম আর্কেডের ছাদে চলে যায়। কেক-মিষ্টি এসব খাওয়া হয়েছে, রাতের খাবার এখনো বাকি। ততক্ষণে দশটা বেজে গেছে। ছাদের একপ্রান্তে একটা ট্যাঙ্কি। ট্যাঙ্কি আর ছাদের দেয়ালের মাঝখানে দেড়-দু ফুট ফাঁকা জায়গা। সউদ এই জায়গাটাই বেছে নেয়। হুট করে কেউ ছাদে উঠে পড়লে তাকে দেখতে পাবে না। ঠিক এখানটাতেই প্রথম দিকে রায়হানাকে চুমোটুমো খেয়েছে।
স্বচ্ছ ও আলোকিত আকাশের দিকে তাকিয়ে সউদ সিগারেটের ধোঁয়া ছাঁড়ে, জ্বলজ্বলে একটা তারার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। জিনিসটা পকেট থেকে বের করে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে স্টাইলে নলটা মুখে ঢুকিয়ে সউদ ট্রিগার টেপে। মগজ, খুলি, রক্ত, দাঁত, মাংস সব একাকারে হয়ে ছিটকে পড়ে। অসমাপ্ত সিগারেটটি কিছুক্ষণ জ্বলে নিভে যায়। ডিনার শেষে অতিথিরা ফিরে যায়। রায়হানা সউদ ইব্রাহিমের নম্বরে ফোন করে, রিং হয়, বারবার বাজে, কিন্তু কেউ ধরে না।
রায়হানা প্রায় সারারাতই ফোন করেছে। ফোন বেজেছে। কেবল ভোরের দিকে শুনল—এই নম্বরটি এখন বন্ধ আছে। কিছুক্ষণ পর আবার ডায়াল করুন।
তার মানে সউদের মোবাইলের ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে গেছে।
সকাল এগারটার দিকে ছাদের এক প্রান্তে ট্যাঙ্কির পাশে তার মৃতদেহটি আবিষ্কৃত হয়।
কোনো মামলা-মোকদ্দমা হয়নি। সউদের বাবা দাউদ ইব্রহিম একটি অচল পা টেনে টেনে ছাদের প্রান্তে এসে ছেলের মৃতদেহ দেখে আমার আব্বুকে বরং সান্ত্বনা দেন, বলেন, ‘ইটস অল রাইট। মামলা-মোকদ্দমা, থানা-পুলিশ করে কোনো লাভ নেই। সউদকে আমি আর ফিরে পাব না। এর নামই নিয়তি। এটাই ছিল আমার জন্য ডেলফির ওরাকল।’
তিনি আমার আব্বুর পিঠে হাত রেখে বলেন, ‘আল আমিন, তোমার মেয়েটা অল্প বয়সে বিধবা হয়ে গেল। ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ো, আমি তোমার সাথে বিয়ের খরচ শেয়ার করব। সউদের মেয়েটার জন্য যখন যা লাগবে—আমি তো আছিই। আমি পঙ্গু হয়েও অনেকদিন টিকে থাকব। এ তো মাত্র শুরু, আমাকে আরো অনেক দুঃখ সইতে হবে। এটাই আমার নিয়তি।’
ষোল
উদ্যোগটা রায়হানারই। মেয়েকে রেখে দুদিনের সফরে বের হলো। আন্তঃজেলা কোচে বগুড়া নেমে আকবরিয়া হোটেলে খেয়ে আরেকটা লোকাল বাসে আদমদিঘি। সেখান থেকে রিকশায় রক্তদহ বিলের কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করতে করতে সোলায়মান আলীর বাড়ি খুঁজে বের করে। সোলায়মান তিনশ টাকা রোজের দিনমজুরি করতে গেছে পাশের গ্রামে। মাগরেব নাগাদ ফিরবে। আরো দেরি হলেও রায়হানা অপেক্ষা করবে। সে তাকে ঢাকার পুরোনো চাকরিতে ফেরত নিতে এসেছে।
সোলায়মানের মা বলল, যখন সাত হাজার টাকা বেতন পেত চার হাজার টাকা মাকে পাঠাত। বোনের বিয়ের জন্য এক হাজার টাকা জমা হতো আর মায়ের সংসারের খরচ তিন হাজার। দিনমজুরিতে মোট কামাই তিন-চার হাজারের বেশি নয়।
সোলায়মানের মা কাতর হয়ে অনুরোধ করেন তার ছেলে ঢাকার চাকরিতে যদি কোনো ভুলভ্রান্তি করেও থাকে তাকে যেন ক্ষমা করে দেওয়া হয়। আর বেতন যেন সাত হাজারের কম না হয়।
সোলায়মান ফিরে আসার আগেই রায়হানা প্রতিশ্রুতি দেয়, বেতন কমবে না, বরং শ পাঁচেক বাড়বে। আর সোলায়মান যে চার হাজার টাকা পাঠাত, এখন সাথে আরো পাঁচশ যোগ হবে। এই বাড়তি টাকার খাবার কিনে তার মাকে খেতে হবে। রায়হানা তার মায়ের হাতে দু মাসের আগাম নয় হাজার টাকা গুণে গুণে দেয়। যখন সোলায়মান ফিরে আসে রায়হানাকে কিছু বলতে হয়নি। যা বলার আর মা ও ছোট বোনই বলেছে। সেই সন্ধ্যায় সোলায়মানের মায়ের রান্না ভাত, ডিমভাজা আর ডাল খেয়ে রায়হানা সোলায়মানকে নিয়ে বগুড়ার গাড়ি ধরে। বগুড়া থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে মহাখালি, মহাখালি থেকে সিএনজি অটোতে আল আমিন ফ্রিডম আর্কেড। সারারাস্তা ব্রিফিং দিয়ে আনলেও গেট দিয়ে ঢোকার সময় সে পাশের গার্ডশেডে ঢুকে পড়ছিল। ধমক দিয়েই তাকে অ্যাপার্টমেন্টে তুলে আনে, মোনালি তখন ঘুমাচ্ছে। রায়হানা সোলায়মানকে বলে, ‘ওই দেখ তোমার মেয়ে। তোমার মেয়ের চুল দেখ, তোমার মতোই কোঁকড়া। আর নাকটা দেখ, তোমার মতো খাড়া।’
সোলায়মান বলতে চেয়েছিল মুখের গড়নটা অনেকটা আমার মায়ের, কিন্তু সাহস পায়নি। মোনালির কাছ থেকে খানিকটা দূরে তার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল তার বায়োলজিক্যাল ফাদার বগুড়ার আদমদিঘির রক্তদহ বিলের সোলায়মান আলী। রায়হানার দ্বিতীয় বিয়ের জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন না করা হলেও রায়হানা সোলায়মানকে কাজি অফিসে নিয়ে আসে। সাক্ষী হতে আসে রায়হানার একদা ঘনিষ্ঠ সানাউল এবং তার বান্ধবী ইয়াসমিনের স্বামী নতুন উকালতি শুরু করা তরুণ অ্যাডভোকেট আজম রেজা খান।
পুরো ব্যাপারটা সোলায়মানের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। আব্বু বাধা দিতে চাচ্ছিল, একটা কাজের ছেলেকে হবে তার মায়ের জামাই। আব্বু নওশাদ হাম্মাদিকেও বলেছে এটা ঠেকাও। এর সাথে তোমাদের মানসম্মানও জড়িয়ে আছে।
আব্বু যখন কাতর হয়ে ছোট আপুকে বলল, ‘আমি তোর জন্য ভালো পাত্র দেখছি, এই মূর্খ কেয়াটেকারকে ছাড়।’ আপু খুব বাজে ভাবে আব্বুকে বলেছে, ‘তুমি কি দেখবে আমার জানা আছে। তুমি খুঁজে বের করবে তোমার বন্ধু কোনো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অকর্মন্য সন্তান কিংবা সউদের মতো একটা ধ্বজভঙ্গ।’
রায়হানা আরো নোংরা কথা বলে ফেলতে পারে এই আশঙ্কায় আব্বু দ্রুত নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ঝিম মেরে বসে থাকে।
আব্বুসহ পরিবারের আরো কিছু লোকের গাত্রদাহ বাড়াতে সে এফিডেভিট করে নাম নেয় রায়হানা সোলায়মান। সোলায়মান মোনালির সাথে ঘনিষ্ঠ হতে খুব চেষ্টা করছে, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে মেয়েটি তার কাছে আসছে না।
সোলায়মান বাড়ির মালিকের মেয়ের জামাই এবং একইসঙ্গে গৃহকর্তা হয়ে যাওয়াতে সবচেয়ে বেশি বিব্রতকত অবস্থায় পড়ল তারই বস আল আমিন ফিডম আর্কেডের কেয়ারটেকার মুহাম্মদ আইয়ুব খান। এখনকার মুদ্রিত কর্মচারী আচরণবিধি অনুযায়ী যে কোনো অ্যাপার্টমেন্টের মালিক, মালিক নারী হলে তার স্বামী, যেকোনো ভাড়া দেওয়া অ্যাপার্টমেন্টের পরিবার প্রধান সকলকে সম্মানের সাথে স্যার সম্বোধন করতে হবে। রায়হানা বিষয়টি কেয়ারটেকারকে মনে করিয়ে দেয় এবং লিফট অপারেটর, দারোয়ানসহ গাড়ির ড্রাইভারদের তা মনে করিয়ে দেওয়ার কথা বলে। আরো জানায়, ‘আইয়ুব খান, আপনাকেও এটা মনে রাখতে হবে যে সোলায়মান সাহেব আমার হাজব্যান্ড। তাকেও সঠিকভাবে সম্বোধন করতে হবে।’
কেয়ারটেকার দাঁতে দাঁত চেপে সেই মাসের বাকি ক’টা দিন পার করে বেতনটা নিয়ে চাকরি ছেড়ে দিল। বলল, ‘সম্মানটা টাকাপয়সার চেয়ে বড়।’
কাজের ছেলের সঙ্গে প্রমাণিত সম্পর্ক ছোটআপুকে কিছুটা একঘরে করে দেয়। তার বেলায় ভালো দিক হলো এসব সে মোটেও আমলে নেয়নি। বরং দাপট কিছুটা বাড়িয়ে দেয়।
নওশাদ হাম্মাদি শ্বশুর ব্যাপারটা কিভাবে নেবে এটা চিন্তা না করেই রায়হানার দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। তার স্ত্রী রাইসা বাধা দেবে এটা তার হিসাবের মধ্যেই ছিল।
মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা বেতনে হাম্মাদি গ্রুপের চেয়ারম্যানের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে চাকরি দেয়। কাজ তেমন জটিল কিছু নয়। হাম্মাদির সাথে এখানে ওখানে যাওয়া, ঢাকার বাইরেও তার সাথে যেতে হতে পারে, এমনকি দেশের বাইরেও। দেশের বাইরে গেলে কোম্পানির শিডিউল অনুযায়ী ওভারসিজ অ্যালাউন্স এবং হোটেলের প্রকৃত ভাড়া পাবে।
রাইসা এক পর্যায়ে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, চাকরি করবে কিন্তু বাইরে যাবে না, রাত কাটাবে না।’
হাম্মাদি তার শর্ত শুনে একটা হায়েনার হাসি উপহার দিয়ে বললেন, ‘রায়হানা রাতে বাইরে থাকলে তোমার সমস্যা কী? তুমি যদি রাতে বাইরে থাকো তাহলে সে কি এসে বলবে যে তার সমস্যা হচ্ছে? তাছাড়া রাত নিয়ে তোমার ভয়টা কিসের সেটা আমি ভালো করেই জানি। তুমি আগাম ধরে নিয়েছ যে রাতে রায়হানা আমার সাথে শোবে এবং ওসব করবে। আমি তোমাকেই জিজ্ঞেস করি, ওসবের জন্য রাত হতেই হবে এমন কোনো ফরমান আছে নাকি? দেশি, ভারতীয়, পাকিস্তানি কিংবা অন্য কোন দেশের আইন?’
রাইসা এবার জোর দিয়ে বলল, ‘বললাম তো রাতে কেবল তোমার সাথে নয়, রায়হানা কারো সাথেই থাকবে না।’
এবার নওশাদ হাম্মাদি বেশ কোমল কণ্ঠে বললেন, ‘তুমিও যে কী ভুল করো। সিঙ্গাপুরে তুমি যখন প্রথম আমার সাথে শুয়েছিলে, মানে আমরা ওসব করেছিলাম, তখন কি রাত ছিল? সেটা ছিল সকালবেলা সাড়ে নটা কি পৌনে দশটা।’
রাইসার হাতের কাছে ছিল কফিভর্তি মগ, সেটাই ছুঁড়ে মারল হাম্মাদির ওপর।
নওশাদ নিজের রুমে ফিরে গিয়ে শার্ট-প্যান্ট-টাই বদল করলেন আবার ফিরে এসে রাইসা আপুকে বললেন, ‘দেখো এসব পাগলামি করে লাভ নেই। আমার শরীরের যে অবস্থা আমি ওসব করতে চাইলেও যে পারব না এটা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়। তুমি কি চাও না অল্প বয়সে বিধবা হয়ে যাওয়া তোমার ছোট বোনটা নিজের পায়ে দাঁড়াক?’
বড়আপুও কোমল স্বরে বলল, ‘তোমাকে ভালো করে জানি বলেই তো বলতে পারছি যে তোমার ওপর ভর দিয়ে কেউ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। আমিও পারিনি হাম্মাদি।’
সতের
স্টিফেন হকিংয়ের মতো আমার মাথাটা একদিকে ঝুঁকে পড়ছে। কথাও জড়িয়ে আসছে। তবে আমারটা মোটরনিউরন ডিজিজ নয়। জবান বন্ধ হয়ে আসার আগে আমার ভাইদের কথাও বলতে চাই।
আমাদের সবার বড় ভাই, আমরা বলি ভাইজান, সৈয়দ জালালউদ্দিন রুমী দুই জমজ ছেলে এবং এক মেয়ের বাবা। আমাদের পুরুষ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে দেখতে সবচেয়ে সুন্দর, মুখটা খুবই মিষ্টি, একটু গোলগাল। ভাইজান আর একটু শুকালে তাকে নায়ক উত্তম কুমারের মতো দেখাত। ভাইজান বিশ্বাসও করতেন তিনি চাইলে উত্তম কুমার হতে পারতেন। সুচিত্রা সেনকে পেছনে বসিয়ে কোনো একটা সিনেমায় উত্তম ভেসপা চালিয়েছেন আর গান গেয়েছেন :এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বল তো/ যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয় তবে কেমন হতো তুমি বল তো।
পেছন থেকে সুচিত্রা বলেছেন :না, না, তুমি বলো।
ভাইজান একটা ভেসপাও কিনল, এফডিসির আশপাশে ঘুরঘুর করল, কিন্তু কেউ তাকে ডাকল না।
তারপর টানা কয়েক মাস নিজেকে গৃহবন্দি করে রাখল। সিগারেট কেনার জন্য দোকান পর্যন্ত যেতে হবে সেজন্য সিগারেটও ছেড়ে দিল। নৈঃসঙ্গ ও বিষণ্নতা থেকে তাকে মুক্ত করার জন্য আব্বু এক সহকর্মী ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিলেন এবং তার জ্যাঠাসের ক্লাস টেনে পড়া মেয়ে নূর-ই-চমনকে দেখালেন।
আব্বু কিন্তু বলার আগেই, পাত্রী দেখার দিন ভাইজান সবার সামনে বলল, ‘আমি চমন আরাকেই বিয়ে করব।’
সেজেগুজে বসে থাকা পাত্রী ফিক করে হেসে বললেন, ‘আমার নাম চমন আরা নয়, নূর-ই-চমন।’
ভাইজান বলল, ‘একই কথা। নাম যাই হোক মানুষ তো একটাই। নামে কি বা এসে যায়, গোলাপকে যে নামেই…’
আব্বু ভাইজানকে থামিয়ে দেয়, বলে, ‘আমাদের কথা বলতে দাও।’ ভাইজান থামল না, বলল, ‘বেশি কথা বললে বিয়ে ভেঙে যায়।’ পাত্রীর বড়ফুপা বললেন, ‘বাবাজি খুব সহি বাত্ বলেছে। বিয়ে ভাঙ্গার সেটাই কারণ। দুই পক্ষের পছন্দ হয়ে থাকলে আর কথা বাড়ানোর দরকার নেই। কাজিকে ডেকে এনে কাবিনটা করিয়ে ফেললেই হয়। অন্যসব অনুষ্ঠান পরে করা যাবে।’
কাবিনে স্বাক্ষর ও মোনাজাত শেষ হওয়ার পর যখন বউ তোলার তারিখ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ভাইজান বলল, ‘আজকেই বউ নিয়ে যাব।’
আব্বু বলল, ‘বিয়ের তো একটা মিনিমাম প্রস্তুতি লাগে আমরা প্রস্তুত হয়ে আসি।’
সকলকে বিব্রত করে ভাইজান বলল, ‘তোমরা পরে প্রস্তুত হও সমস্যা নেই, আমি পুরোপুরি প্রস্তুত।’
কেউ একজন আস্তে করে এমনও বলেছে, ‘বীর্য মাথায় উঠে গেছে নাকি?’
পাত্রীর বড় ফুপা বললেন, ‘শরিয়ত অনুযায়ী কাবিনের পর আর কোনো কিছু বাকি থাকে না। খানাপিনা ধূমধাম এসব কাজও বেশরিয়তি, নবীজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় অতিথিদের মধ্যে কেবলমাত্র খেজুর বিতরণ করে তাদের সন্তুষ্ট করা হয়েছে। বাবাজি সৈয়দ জালালউদ্দিন রুমী ঠিক কথাই বলেছে। আমাদের মেয়ের কাপড়-চোপড় সোনাগয়না নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। আপনাদের বড় বউকে যে সম্মান দেবেন, তার ওপর নির্ভর করবে আপনাদের সম্মান। পাত্রের বাবা মুন্সি আল আমিন সাহেব সরকারের যেমন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য মানুষ, আমাদেরও তাই। আলহামদুলিল্লাহ, বাবাজির কথাই আমরা রাখব।’
হঠাত্ পাত্রীর বাবা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন, ‘আমার মেয়েটা চলে যাবে!’
এই আলোচনার ঠিক দেড় ঘণ্টার মধ্যে ভাইজান তার স্ত্রী নূর-ই-চমনকে নিয়ে রওয়ানা হলো।
সপ্তম দিন ইস্কাটন লেডিস ক্লাবে নবদম্পতিকে সংবর্ধনা জানানো হলো, আব্বুর গুরুত্বপূর্ণ সব বন্ধু এবং চমন ভাবির বাপের বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ আত্মীয়স্বজন সবাই এলেন। খাওয়া-দাওয়ার খরচে আব্বু এতটুকু কার্পণ্য করেনি। ভাবিকেও সোনাগয়না কম দেয়নি।
বিয়ের তৃতীয় মাস না পেরোতেই প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজেটিভ, ভাবি গর্ভবতী। গর্ভাবস্থার সপ্তম মাস থেকে সৈয়দ জালালুদ্দিন রুমীর অবস্থান রিহ্যাবে, মানে পুনর্বাসন কেন্দ্রে। এখন আর পাগলাগারদ বলা হয় না, টয়লেটকে ওয়াশরুমের মতো কোমল করে বলা হয় রিহ্যাব। সেখানে মূলত ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। দু’চার দিন পরপর হঠাত্ চিত্কার দিয়ে উঠে, ‘এনিমি অ্যাহেড, টেইক ইয়োর পজিশন, অ্যাটাক।’ তারপর কথাটা বাংলায় অনুবাদ করে বলেন, ‘সামনে শত্রু, তোমরা অবস্থান নাও, আক্রমণ করো।’
কথা শেষ হতেই নিজের মুখে ট্যাট ট্যাট ট্যাট, বুম বুম বুম, বিভিন্ন ধরনের ট্রিগার টেপা মারণাস্ত্রের শব্দ করতে থাকে।
এই প্রক্রিয়াটি অনেকক্ষণ ধরে চলে, শেষদিকে গুলির শব্দ কমে আসে, ভাইজান ঘুমিয়ে পড়ে।
এটা সাময়িক যুদ্ধ বিরতি।
সৈয়দ জালালউদ্দিন রুমীর যুদ্ধটা চলতেই থাকে।
আঠারো
সমস্যাটা ধরা পড়ে আগেই। আব্বুর সহকর্মী কিছুটা জানলেও পাত্রীপক্ষ কিছুই জানেনি। তারা জেনেছে ছেলে দেখতে খুব সুন্দর। ছেলের বাবা সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা।
বছর দু-এক আগে একদিন হঠাত্ আব্বুর বেডরুমে ঢুকে ঘুমন্ত আব্বুকে হাতের আঙুল দিয়ে টার্গেট করে ট্যাট ট্যাট ট্যাট বুম বুম বুম শুরু করে।
হতভম্ব আব্বু বিছানায় উঠে বসে এবং জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছে রুমী?’ ভাইজান জবাব দেয়, ‘এনিমি অ্যাহেড, টেইক ইয়োর পজিশন, অ্যাটাক।’ তারপর আবার শুরু করে দেয় ট্যাট ট্যাট ট্যাট বুম বুম বুম।
ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে টানা এক সপ্তাহ ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। মনে হয়, স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে, কিন্তু আসেনি।
যেদিন চমন ভাবির জমজ ছেলে দুটো জন্ম নেয় ভাইজান সেদিনও রিহ্যাব নামের পাগলা গারদে ট্যাট ট্যাট ট্যাট করছে। থেকে থেকে এই যুদ্ধটা চলছেই।
ভাইজানের মানসিক অসুস্থতা ভাবিকে কতটা বিচলিত করেছে তিনি তা বুঝতে দেননি। বরং বলেছেন, ‘তোমরা ফাঁকি দিলে কি হবে যেদিন আমাকে দেখতে গেল সেদিনই বুঝেছি মানুষটা আসলে পাগল। নতুবা দুই ঘণ্টার মধ্যে পাত্রী দেখে কাবিন সই করে বউ নিয়ে কেউ বাড়ি রওয়ানা হয়। এমন সুন্দর একটা মানুষ, আমিও তো চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। আমিও তো বলতে চাচ্ছিলাম আমাকে এখনই নিয়ে যান, আমি আপনার সাথে যাব। বেশি দেরি হলে বিয়েটা ভেঙে যাবে। আমার চাচাতো বোন সানজিদাকে পাত্রপক্ষ দেখল, পছন্দ করল, হাতে আংটি পরালো, বিয়ের তারিখ চূড়ান্ত হলো, আমাদের কার্ডও ছাপা হলো, পাত্রের বড় ভাই এসে জানিয়ে গেল, বিয়েটা হবে না। মেয়ের চরিত্র নিয়ে তাদের কানে কথা গেছে। সত্য কি মিথ্যে আমাকে নিয়েও তো কেউ কিছু শোনাতে পারত। তার চেয়ে তোমার ভাইজানই ঠিক কাজটি করেছেন।’
ভাইজানের পাগলামি নিয়ে চমন ভাবি নির্বিকার। একটু অভিযোগও তার নেই। বরং উল্টো বলেন, ‘তোমাদের রুমী ভাই যদি আমাকে বিয়ে না করতেন আমি কি এমন সুন্দর দুটো ছেলের মা হতে পারতাম। ইনশাল্লাহ তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।’
তাদের দুই জমজ ছেলে আলাল ও দুলাল ছোটবেলা থেকেই বাবার এই যুদ্ধটাকে বড়দের একটা খেলাই মনে করেছে এবং নিবিড়ভাবে বাবার অঙ্গভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করে খেলাটা দুজনই বেশ রপ্তও করে নিয়েছে। আলাল ও দুলাল পরস্পরের দিকে আঙুল তাক করে বলতে থাকে ট্যাট ট্যাট ট্যাট বুম বুম বুম, এনিমি অ্যাহেড, টেইক ইয়োর পজিশন, অ্যাটাক।
কখনো কখনো চমন ভাবি দুই ছেলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যেতেন। তখন দুজনই চেঁচিয়ে উঠত, ‘সরে যাও আম্মু গুলি লাগবে।’
দুজনের পঞ্চম জন্মদিবসে ছোটচাচা হিসেবে আমিই কিছু উপহার দিতে চাইলাম, কিন্তু আমার টাকাই বা কোথায় আর কিনবই বা কেমন করে।
আমার সহায় মেজো দুলাভাই, রাইমার হাজব্যান্ড এনএইচ মিন্টু। আমি বললাম, ‘আমাকে দুটো একে ৪৭ সাবমেশিনগান কিনে দিতে হবে।’
তিনি বললেন, ‘তুমি চাইলে অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট মেশিন গানও কিনে আনতে পারি। রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের বড় একটা চুক্তি হয়েছে। এমনকি অ্যাটম বোমাটোমা চাইলেও ওরা না বলবে না।’
গুলশানের কোনো একটি খেলনার দোকান থেকে তিনি খেলনা একে ৪৭ নিয়ে এলেন। একে মানে আনাতোলি কালাশনিকভ। এই মানুষটি কবি হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হলেন পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ঘাতক আগ্নেয়াস্ত্রের আবিষ্কারক।
আমার দুই ভাস্তে যখন আমাকে তাদের জন্মদিনের কেক খাওয়াতে এলো আমি দুজনের হাতে দুটো কালাশনিকভ তুলে দিলাম। আমার সামনেই দুই ভাই ট্রিগার টিপে লড়াই শুরু করে দিল। একই সঙ্গে দুজন আমাকে বলল, ‘হ্যান্ডস আপ।’ আমি বাম হাতে ডানহাতটাকে ধরে ওপরে উঠাতে চেষ্টা করলাম, পারলাম না। শুধু বাম হাত উপরে তুলে আত্মসমর্পণ করলাম।
উনিশ
কোনটা আলাল কোনটা দুলাল খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ না করলে বোঝার উপায় নেই। আলাল জিজ্ঞেস করল, ‘ছোটচাচা, তুমি আর বড় হবে না?’
আমি বললাম, ‘আই হ্যাভ স্টপড গ্রোয়িং আপ। আমি বড় হওয়া থামিয়ে দিয়েছি।’
দুলাল জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি বিয়ে করবে?’
আমি হেসে উঠলাম।
দুলাল বলল, ‘তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে আমার আম্মুকে বলব, বাবা মারা যাওয়ার পর যেন তোমাকে বিয়ে করে।’
মানে? কী বলছিস?
এবার দুলাল যোগ করল, ‘মা বলেছে, ভাইদের মধ্যে তুমি সবচেয়ে ভালো। তুমি সারাদিন বাসায় থাকো। আমার বাবা তো আট ন’মাসই রিহ্যাবে।’
‘কিন্তু তোদের বাবা মারা যাবে, একথা কে বলেছে?’
‘মা। মা জানে এ ধরনের প্যাশেন্ট বেশিদিন বাঁচে না।’
দুই ভাই দুটি কালাশনিকভ নিয়ে নিজেদের ঘরে ফিরে যায়। মারণাস্ত্র হাতে তারা হঠাত্ বড় হয়ে উঠে। বাবার যুদ্ধটাকে আর খেলা মনে হয় না।
দুই ভাই আর কোনোদিন ট্যাট ট্যাট ট্যাট বুম বুম বুম এই খেলাটা খেলেনি। বলেনি, এনিমি অ্যাহেড, টেইক ইয়োর পজিশন, ফায়ার।
চমন ভাবি একদিন শাহি টুকরা বানিয়ে নিয়ে এলেন। বললেন, ‘আগে তোমাকে খাওয়াব, তারপর অন্যদের।’
মুখে নিয়ে আমি বললাম, ‘দারুণ।’
ভাবি বললেন, ‘তুমি কি বন্দুক দিলে, পাবার পর ওদের যুদ্ধের খেলাটা বন্ধ হয়ে গেছে। আগেই ভালো ছিল আঙুল দিয়ে গুলি করত। বন্দুক পেয়ে এখন বড় হয়ে গেছে।’
‘সরি ভাবি, এমন করবে জানলে কি আমি দিতাম নাকি?’
‘ভাবি আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, মাথাটা একদিকে ঝুলে পড়েছে যে, সমস্যা হচ্ছে না।’
আমি বললাম, ‘স্টিফেন হকিংয়েরও তো এ অবস্থা হয়েছিল, তার কোনো সমস্যা হয়নি, আমারও না।’
ভাবি কাঁদতে শুরু করলেন। আগে তাকে কখনো কাঁদতে দেখেনি। কাঁদতে কাঁদতে বিষাদ সিন্ধুর ভাষায় বলে ফেললেন, ‘আমি পাপীষ্ঠা নারী আমার পাপেই আমার স্বামীর এ অবস্থা। তোমার ভাইয়ের শরীরটা ভেঙে পড়ছে। আমি ভয় পাচ্ছি। আমার পেটে তোমার ভাইয়ের আর একটা সন্তান।’
চমন ভাবি কিসের পাপের কথা বলছেন? তিনি তো দূরের মানুষ। পাপের কারণে যদি এ অবস্থা হয়ে থাকে তা হলে তা কাছের মানুষের পাপ। যদি অন্য কারো পাপের প্রায়শ্চিত্ত তার জন্য বরাদ্দ হয়ে থাকে তা হলে তা এ বাড়িরই পাপ—যুদ্ধ না করে যোদ্ধা সাজার পাপ। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার পাপ। আমার আব্বুর সেই যুদ্ধটাই তো জালালউদ্দিন রুমী সর্বশক্তি দিয়ে করে যাচ্ছে।
এ নিয়ে আব্বুর মনে কোনো গ্লানি আছে বলে অন্তত আমার মনে হয়নি।
আব্বু টক শোতে যায়, রাউন্ড টেবিলে যোগ দেয়, গাঁটের পয়সা খরচ করে নিজের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে—স্পষ্টভাবে বলে দেয়—পরিচিতি দেওয়ার সময় নামের আগে অবশ্যই বীর মুক্তিযোদ্ধা কথাটা লিখতে হবে, বলতে হবে। এ পর্যন্ত শুনেছেন, কেউ বলেছে, আমি ভীরু মুক্তিযোদ্ধা? সবাই বীর! যুদ্ধ না করেও কাগজের জোরে আমার আব্বুও বীর!
জালালউদ্দিন রুমী বীরের মতো একটা যুদ্ধ করে চলেছেন। ভাবি বললেন নতুন সঙ্কট দেখা দিয়েছে : ভাইজান তাকে গুপ্তচর মনে করছেন, ভাবি তার কাছ থেকে তথ্য হাতড়ে নেবার চেষ্টা করছে বলে তার ধারণা।
আমার মেজোভাই মাহমুদ দারবিশ কবি হতে পারত কি না জানি না, তবে সে আমার আব্বুর লাঠিয়াল এবং তার রুরাল পলিটিক্স ডিপার্টমেন্টের প্রধান নির্বাহী। আবার শহরেও সানস অ্যান্ড ডটার্স অব ট্রু ফ্রিডম ফাইটার্স নামের একটি সংগঠন দাঁড় করাতে চেষ্টা করছেন। একটি লিফলেটে বেশ বড় হরফে তার পরিচিতি ছাপা হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল আমিনের সুযোগ্য পুত্র একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী মাহমুদ দারবিশ। তারপর মাহমুদ দারবিশের কালো সানগ্লাস পরা ছবি। লিফলেটে অপর সংস্থাগুলোকে হেয় করে বলা হয়েছে :একটি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ক্ষুদ্র প্রাপ্তির লোভে বৃহত্তর প্রাপ্তি থেকে আমাদের বঞ্চিত করছে। আমরা এবং আমার পরবর্তী প্রজন্মসমূহ জাতীয় সংসদে শতকরা তেত্রিশ ভাগ আসনের গ্যারান্টি চাই, মন্ত্রিসভায় সমানুপাতিক হারে মন্ত্রী চাই। সরকারের সামরিক ও বেসামরিক পদগুলোতে আমাদের জন্য ৩৩% সংরক্ষিত পদ চাই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ট্রু ফ্রিডম ফাইটার্সদের সাথে তাদের পুত্রকন্যা ও নাতি-নাতনির সাথে অধস্তন প্রজন্মের সাথে সাক্ষাতের জন্য রাষ্ট্রীয় বেসামরিক বিমান পরিবহন কোম্পানির সার্বক্ষণিক ফ্রি টিকেটের নিশ্চয়তা প্রদান আমাদের আরো একটি দাবি।
মাহমুদ দারবিশ মূলত আব্বুর পরিচিতি ভাঙ্গিয়ে সরকারি অফিসে কিছু দালালির কাজও করেছে, কিন্তু আরামবাগের একটি আবাসিক হোটেলে অসামাজিক কাজে লিপ্ত থাকাকালীন গ্রেফতার হওয়ায় এবং ছবিও সংবাদপত্রে ছাপা হওয়ায় আব্বু তাকে সচিবালয়ে যেতে নিষেধ করেছে।
সে-ই আব্বুকে আমাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একটি সংবর্ধনার আয়োজন করে। কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার পরিচিতি সভা হয় এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার বীজ তার মনে বপণ করে।
সরকার আব্বুকে দু-এক বছরের এক্সটেনশন দেয়নি, না দেয় না দিক। আব্বু নিজেই বলল, জনগণ যদি ম্যান্ডেট দেয় তাহলে টানা পাঁচ বছর জনসেবা করা যাবে। এমনকি মন্ত্রী, মন্ত্রীর মর্যাদায় উপদেষ্টা এসব হওয়াও সম্ভব। তাহলে এদিকটায় একটু নজর দেওয়া দরকার। এখন প্রশ্ন হলো সরকারি দলের এমপি রেজ্জাক চৌধুরী কিংবা বিরোধী দলের শক্তিশালী তরুণ নেতা মাহবুব আলীকে পাশ কাটিয়ে তাকে কেন ভোট দেবে?
কুড়ি
নওশাদ হাম্মাদির সাথে কথা বলতে গিয়ে আব্বু নিজেও এই প্রশ্নটা তুলেছেন। মেয়ের জামাই হলেও বয়সের নৈকট্যের কারণে আব্বুর সাথে নওশাদ হাম্মাদির সম্পর্কটি বন্ধুত্বের। বড়আপুর হাজব্যান্ড এত বছর পরও আব্বুকে স্যার সম্বোধন করে চলেছেন।
হাম্মাদি বললেন, ‘স্যার, আমরা তাহলে কী জন্য আছি? আপনি প্রোবলেম বলবেন, আমরা সলিউশন দেব।’
‘তাহলে এখানে তোমার সলিউশনটা কী?’
‘তার আগে স্যার দয়া করে বলুন এ দুজন যদি একটি ভোটও না পায় তা হলে কি আপনার পাস করা নিশ্চত?’
‘আর তেমন উল্লেখযোগ্য ক্যান্ডিডেট থাকবে না।’
‘যদি এ দুজনই আপনার বাধা হয়ে থাকে তাহলে কাজটা খুবই সহজ। শুটার বাবুলকে দিয়ে রেজ্জাক চৌধুরীকে শুইয়ে দিয়ে মাহবুব আলীকে মামলায় ফাঁসিয়ে দিতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনা নতুন নয়। এটা মিডিয়াও খাবে। আপনি কোনো সিনেই নেই, দরকার হয় অপারেশনের দশদিন আগে থেকে আজমির শরিফ গিয়ে তসবিহ জপতে থাকুন। অপারেশন শেষ হওয়ার দশ পনের দিন পর ফিরে আসুন। তারপর এলাকায় যান, এমপির হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি জানান। ব্যস, তখন থেকেই আপনার ইলেকশন প্রচারণার শুরু।’
‘হাম্মাদি কাজটা কি এতই সহজ? সহজ হলে তিনশ আসনে একই ঘটনা ঘটত।’
‘স্যার আপনার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটাবার এবং সামলাবার মতো একজন করে নওশাদ হাম্মাদি কি তিনশ আসনেই পাবেন? পাবেন না স্যার। আপনি ইলেকশন করার সহি নিয়ত করার পর আমাকে বলবেন। সাথে সাথেই আমার কোনো এক এজেন্টকে দিয়ে শুটার বাবুলকে এক লাখ টাকা দিয়ে দেব, বাকি টাকা সাক্সেসফুল অপারেশনের পর। আমার ওপর পুরো ভরসা করে আপনি কখনো ঠকেননি স্যার। এবারও ঠকবেন না।’
এটা ঠিক, হাম্মাদি আমার আব্বুকে ঠকাননি।
আব্বু তখন লোকাল গর্ভনমেন্ট মিনিস্ট্রিতে। মেট্রো ম্যানিলার মেয়র দাওয়াত করেছেন। ম্যানিলা মেট্রোপলিটন শহরের প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা দেখাবেন।
হাম্মাদি বললেন, ‘স্যার বোরিং লাগবে। সন্ধ্যার পর সবাই যখন ড্রিঙ্ক করতে পাবে চলে যাবে আপনি নিঃসঙ্গ বোধ করবেন। ম্যানিলায় এস্কর্ট সার্ভিস থেকে একটা মেয়ে বের করে দেব, সে আপনার পুরো টেইককেয়ার করবে, টিকেট কনফার্মেশন থেকে শুরু করে ম্যাসেজ করা পর্যন্ত সব দায়িত্বই নেবে। আপনি কোন দেশি মেয়ে চান স্যার—ফিলিপিনো? নাকি চাইনিজ? সাউথ ইন্ডিয়ার মেয়েও আছে।’
আব্বু ফিসফিস করে বলল, ‘বাঙালি পেলে সবচেয়ে ভালো, মনের কথা বুঝিয়ে বলতে পারতাম।’
‘স্যার হিন্দু মেয়ে না মুসলমান মেয়ে এ নিয়ে কোনো প্রিজ্যুডিস নেই তো?’
‘নেই।’
‘তাহলে বাঙালি নিশ্চিত পাওয়া যাবে।’
ম্যানিলা এয়ারপোর্টে আব্বুর নাম লেখা কার্ড নিয়ে যে মেয়েটি দাঁড়িয়েছিল। এগিয়ে এসে বিশুদ্ধ বাংলায় বলল, ‘এখন থেকে আপনাকে বিদায় না জানানো পর্যন্ত পুরো সময়টা আমি শুভ্রা সম্পূর্ণভাবেই আপনার। আপনি শুধু ইচ্ছে প্রকাশ করবেন। দিন বা রাত যখনই চান, আমার কোনো সমস্যা নেই। ফোন পেলে দশ মিনিটের মধ্যে চলে আসব।’
নওশাদ হাম্মাদিকে নিয়ে বড়আপুর মনে যাই থাকুক, আব্বু তার উপরই পুরোপুরি ভরসা করে। হাম্মাদি জানে আব্বু কখন কি চাইতে পারে। হাম্মাদি নিজের কোন মেয়ে কিংবা বাইরের কোন মেয়ের দিকে হাত বাড়ালো কি না এটা তার কাছে কোনো বিষয়ই নয়।
শুভ্রা দত্ত মেট্রো ম্যানিলায় আব্বুকে এতটাই ভালো সময় উপহার দিয়েছে যে ম্যানিলার একটি পশ মল থেকে তাকে একটি নেকলেস কিনে দিয়েছে এবং এয়ারপোর্টে মেয়েটিকে ছেড়ে আসার সময় নিজেও একটু কেঁদেছে।
একুশ
আমাদের কারো নামের সাথেই সৈয়দ নেই। কিন্তু আমার ছোটভাই কেমন করে সৈয়দ আব্দুল মোক্তাদির হলো আমার জানা নেই। আব্বুর নিষেধ অগ্রাহ্য করে মোক্তাদির বাবরি মসজিদের অবস্থান ও ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য গুজরাট গিয়েছিল। সেখানেই মধ্যপ্রাচ্যের আরো কিছু তরুণের সাথে তার সৌহার্দ্য বিনিময় হয়।
ফিরে এসে সে বিসিএস পরীক্ষায় বসল। পরীক্ষা ভালো হয়নি, মানে আশানুরূপ হয়নি। তবুও আব্বুর সন্তান হিসেবে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় চাঞ্চ পেল। যেভাবেই হোক বাবার জোগাড় করা সার্টিফিকেটের আরো সুফল আসতে শুরু করেছে। গুজরাট সফরটা না করলে মোক্তাদির হয়তো চাকরিটাতে যোগ দিত। সে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল।
দুর্ভাগ্য আমার আব্বুর, যাদের ভবিষ্যত্ সুন্দর করতে তার সেই সার্টিফিকেট কাজে লাগাচ্ছে, তারাই যদি এ সার্টিফিকেটের উত্স ও যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে এটা সহ্য করা কষ্টকরই। আমাদের সকলকে হতভম্ব করে দিয়ে সৈয়দ আবদুল মোক্তাদির আব্বুকে ভণ্ড, প্রতারক এবং এমনকি রাজাকার গাল দিয়ে তার অ্যাপার্টমেন্ট দুটিকে বালিকা এতিমখানা তৈরির নির্দেশ দিয়ে চিরদিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।
বছর না ঘুরতেই আলজাজিরা টেলিভিশনের একটি প্রতিবেদনে নিহত নয়জন নন-অ্যারাবিক আইএসআইএসের ছবি দেখানো হয়, পরদিন ঢাকার প্রায় সব দৈনিকের প্রথম বা শেষ পাতায় নিহত তরুণদের ছবি ছাপা হয়। মাথায় আরবীয় পাগড়ি, হাতে একে ফর্টিসেভেন রাইফেল এবং থুঁতনি অল্পকিছু দাড়ি এক তরুণের ছবি দেখে আমার সমবয়সী ফুপাতো বোন উম্মুল ওয়ারা খবরের কাগজটা আমার কাছে নিয়ে আসে। উম্মুল ওয়ারা যখন সাধারণ মানুষের ভাষায় আমাদের সাথে কথা বলে বোঝার উপায় নেই এই মেয়ে স্কলাসটিকা স্কুলের ফার্স্ট গার্ল, ও-লেভেলে ৯টা এ স্টার পেয়েছে, সামনে এ-লেভেল অন্তত চারটা এ স্টার যে পাবে এটা সে নিশ্চিত। যখন ইংরেজিতে কথা বলে কে বলবে উম্মুল ওয়ারা এ দেশের বাঙালি। কাগজটা আমার সামনে ধরে বলল, ‘ডোন্ট টেল মি ইউ ডোন্ট নো হিম।’
‘আমি জিজ্ঞেস করি, কার কথা বলছ?’
‘দ্য ওয়ান ইন দ্য মিডল উইথ অ্যা রাইফেল ইন হ্যান্ড।’
আমি বললাম, ‘চেনা মনে হচ্ছে।’
ওম্মুল ওয়ারা বলল, ‘ডোন্ট টেল মি হি ইজ ডেড।’
তারপর সে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল, ‘যদি সে মরে গিয়ে থাকে দ্যান আই কিল্ড হিম, আই কিল্ড মাই লাভ।’
উম্মুল ওয়ারা বলে, ‘মোক্তাদিরের মতো একটা ছেলেকে ধরে রাখার জন্য যতটুকু ভালোবাসা দরকার আমার সবটুকুই ছিল। কিন্তু আমি হচ্ছি কিপ্টে ডাইনি। আমি সবটুকু ভালোবাসা দিইনি।’
উম্মুল ওয়ারার কান্না কেমন করে থামাব, আমার জানা নেই। তার কান্না বাড়ির অনেককে জড়ো করে।
উম্মুল ওয়ারা হুইল চেয়ারের উপর দিয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরে বলে, ‘তুই আমার লিটল স্টিফেন হকিং। তোর অনেক নলেজ। তুই আমাকে বল, হাউ ডু আই গেট হিম ব্যাক টু লাইফ।’
আব্বুর বিভিন্ন ধরনের দু নম্বরি কাজ দেখে বহুদিন ধরে আম্মু প্রায় নির্বাক জীবনযাপন করছিল। ছেলের এই ছবি দেখে হিংস্র হয়ে আব্বুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, ‘তুমি আমার ছেলের লাশ নিয়ে এসো। আমি নিজের হাতে গোসল দেব, কাফন পরাব, দাফন করব। তোমার বদমায়েশি আর ভণ্ডামি দেখে আমার ছেলে দেশ ছেড়েছে।’
আম্মু ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বলে, ‘সাবধান, তোমার চেহারা আমি সবাইকে দেখিয়ে দেব। তুমি আমার মোক্তাদিরকেও খুন করিয়েছ।’
কোত্থেকে নওশাদ হাম্মাদি এসে দ্রুত আম্মুকে বের করে নিয়ে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল।
রাইসা একদলা থুতু ছুঁড়ে মারল আব্বুর মুখে।
আব্বু পকেট থেকে সাহেবি রুমাল বের করে মুখ লেপ্টানো থুথু মুছতে মুছতে বলল, ‘ইটস ওকে।’
আমি রায়হানাকে ফিসফিস করে বললাম, ‘আম্মুকে দেখো রেখো, মেরে ফেলতে পারে।’
এবার আব্বু ঠাণ্ডা মাথায় সবাইকে বলল, ‘তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি বাইরের একটা কাকপক্ষীও যেন টেন না পায় যে মোক্তাদির কোথায়। কারো কান্নার শব্দ যেন দেয়ালের বাইরে না যায়। সামনে ইলেকশন। আমি চাই না অপজিশন কোনো সুযোগ নিক।’
নওশাদ হাম্মাদি পেছন থেকে বললেন, ‘স্যার ঠিকই বলেছেন।’
আব্বুর চাহনিতে ভয়ঙ্কর একটা কিছু আমাদের সবাইকে নিশ্চুপ করে রাখল।
এতটুকু ফোঁপানির শব্দও নেই।
আব্বু বলে দিলো, ‘মোক্তাদিরের কথা কেউ তুললে বলবে আমেরিকায় পড়াশোনা করছে, নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে, খুব ভালো রেজাল্ট করছে।’
মোক্তাদির নিরুদ্দেশ হওয়ার পর আমার স্বল্পভাষী আম্মু বলেছিল, ‘মোক্তাদির যদি ছোটটার মতো পঙ্গু হতো তাহলে তাকে হারাতাম না।’
আমি তখন বুঝতে শিখি সবকিছুরই একটা ভালো দিক থাকে—বামন ও পঙ্গু হওয়ারও।
নওশাদ হাম্মাদি আব্বুকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। পরদিন খবর পাই আব্বুর লাঠিয়াল মাহমুদ দারবিশ তাকে মারার জন্য লাঠি নিয়ে ছুটে আসছে। কারণ অজ্ঞাত। এমনকি আমার কাছেও।
মাহমুদ দারবিশ সে রাতেই গ্রেফতার হয়।
সামনে সাধারণ নির্বাচন। আমি অল্পদিনের মধ্যেই আঠার হচ্ছি। ভোট দেওয়ার বয়স আঠার বছর। আমি একটা ভোট দেব। এদেশে ভোট দেয় বিরুদ্ধে। আমিও বিরুদ্ধে একটা ভোট দেব। ভোট দেব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে।
বাইশ
আমার ছোট আপু রায়হানার স্ফীত পেট আর একটি সন্তানের আগমন ঘোষণা করছে। সাউদ ইব্রাহিম মোনালির কোঁকড়া চুল দেখে বলেছিল, মোনালি তার সন্তান নয়।
এবার সোলায়মানের কথায় রায়হানা অবাক হয়।
কী স্পর্ধা সাত হাজার টাকা বেতনের অ্যাসিস্ট্যান্ট কেয়ারটেকার কিংবা দৈনিক তিনশা টাকা বেতনের দিনমজুর সোলায়মানের।
বাচ্চা পেট থেকে নামার আগেই সে রায়হানাকে বলেছে, ‘তোমার পেটের বাচ্চা আমার নয়।’
ক্ষিপ্ত রায়হানা বলল, ‘ছোট লোকের বাচ্চা আগে পাট ক্ষেতের আলে বসতি এখন বসিস ইংলিশ কমোডে। তোর মুখে এত বড় কথা।’
সোলায়মানও বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছে, ‘সাবধান রায়হানা, আমি তোমার হাজব্যান্ড মনে রেখো।’
রায়হানা থামার নয়। সোলায়মান তার গলা টিপে ধরে।
তারপর কোঁকড়া চুলের মোনালির কথা মনে করে ছেড়ে দেয়।
কাতর কণ্ঠে রায়হানা বলল, ‘তুমি পারলে?’
সোলায়মান দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়। নতুন কেয়ারটেকার যথারীতি তাকে স্যালুট করে।
সোলায়মান রাস্তায় নেমে হাঁটতে থাকে। সিদ্ধান্ত নেয় বগুড়ার আদমদীঘিতে যাবে না।
ঘটনাটা সেদিন শেষরাতের। সেজন্য খবরের কাগজওয়ালারা রিপোর্টটি করতে পারেনি।
সকাল থেকেই কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল দেখিয়ে যাচ্ছে অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে বিশিষ্ট নাগরিক হাম্মাদি গ্রুপের চেয়ারম্যান নওশাদ হাম্মাদি সিআইপি নিহত। তার শ্বশুর সাবেক আমলা আল আমিনের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। ঘাতক উভয়ের উপরই কুড়াল জাতীয় অস্ত্র চালিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। নওশাদ হাম্মাদির জননাঙ্গ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মরদেহের পাশে পড়েছিল।
কর্তিত জননাঙ্গ বড্ড চুপসে যায়।
আমি জানি নওশাদ হাম্মাদি আব্বুর ইলেকশন প্রস্তুতির নকশা চূড়ান্ত করছিল। অনেক কাজ সামনে। শুটার বাবুলের সাথে অপারেশনটা চূড়ান্ত করতে হবে। একজনকে শুইয়ে অন্যজনকে ফাঁসিয়ে দেবে। প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর বিদায়ের পর মাঠ ফাঁকা হয়ে যাবে। আব্বুকে তখন কে ঠেকাবে?
কোঁকড়া চুলের মোনালিকে আমার চেয়ারের পাশে বসিয়ে রেখে রায়হানা দ্রুত বেরিয়ে গেল।
আমি আমার ভেতরে চিত্কার করে বললাম, ‘ওয়েলডান, সোলায়মান তুমি পালাও, পালিয়ে যাও।’
সেদিন থেকে সোলায়মান আলী নিরুদ্দেশ।
তেইশ
শুনেছ নাকি স্টিফেন হকিং মারা গেছে। মাত্র ক’দিন আগে। আমিও আর বেশিদিন নেই। উম্মুল ওয়ারা কিংবা ফজলু বামনের শ্যালিকা শিরন, কিংবা যে কোনো একজন মমতাময়ী নারী আমার মৃত্যুর সময় পাশে থেকো। কোঁকড়া চুলের মোনালি থাকলেও হবে।
আমি ঘোরের মধ্যে দেখি আমার বিয়ের আয়োজন করছে সৈয়দ জালালউদ্দিন রুমীর দুই জমজ ছেলে আলাল ও দুলাল।
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘পাত্রী কে?’
দুজন এক সাথে বলে, ‘আম্মু, নূর-ই-চমন।’
আমার আর ঘোর কাটে না। আমি সৈয়দ জালালউদ্দিন রুমীর কণ্ঠ শুনতে পাই :‘এনিমি অ্যাহেড, টেইক ইয়োর পজিশন, অ্যাটাক।’