আমি সারা জীবন একটা স্টেশনের জন্য ধাবমান গাড়ির
জানালায় বসে থাকি। বাইরে কত গ্রাম আর চাষা জমির চলচ্চিত্র।
কুয়াশার ভেতর মানুষের অস্পষ্ট নড়াচড়া।
ভোরের মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসা কর্মনিপুণ কিষানের
মেহেদিরাঙা দাড়ির মতো ভেজা বাতাস। আর
সদ্য দুইয়ে নেওয়া গাভীর বাঁটের মতো হাল্কা মেজাজের বাংলাদেশ।
আমি সব পেরিয়ে যাচ্ছি। প্রতিটি স্টেশন আমার চেনা।
আখ মাড়াইয়ের কল থেকে ছিটকে আসা মাছির ঝাঁক সরিয়ে
আমি নীল রুমালে মুখ মুছে নিয়েছি। যদিও
ঝোল গুড়ের গন্ধে আমার কেবলই খিদে বাড়ে।
মনে হয় আমার সারাজীবনই বুঝি অফুরন্ত শীতকাল।
আমি যতবার সূর্যকে পৃথিবী প্রদক্ষিণের জন্য উঠে দাঁড়াতে দেখলাম
দেখি জেলে পাড়ার শুকোতে দেয়া জালের ভেতর
লালচোখো মাছের তোলপাড়।
নুনের পানিতে ভেজা চোখ কচলে আমি পৃথিবীকে দেখি
প্রথম আমি যার কাছে যাবো তার বাম স্তরের মতোই পৃথিবীটা নিখুঁত,
যা কোন, সুদূর সীমান্তের কাস্টম কলোনিতে আমার জন্য
অকস্মাৎ বিদ্যুতের বোতাম উদাম করে দেখলো।
আমার মনের মধ্যে কেবলই ঘুরে ফিরে স্টেশনটা আসছে,
শুধু নামটাই খেয়া নৌকায় ফেলে আসা পুঁটলিতে চিরকালের
জন্য হারিয়ে এলাম। অগত্যা
রেল কাউন্টারের ঘোলা চশমাপরা টিকেট বিক্রেতাকে
এমন একটা স্টেশনের টিকেট দিতে বললাম
যেখানে কুয়াশা ঢাকা স্টেশনের প্লাটফরমের পাশে
আমার জন্য কেউ না কেউ ঘোমটা তুলে
যাত্রীদের ওঠানামা দেখছে। আর
তার দীর্ঘশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসছে অপেক্ষার
ব্যাকুল বাষ্প।
এখন আমার পকেটে আছে হলুদ হালকা বিস্কুটের মতো
কুয়াশা ঢাকা স্টেশনের টিকেট। সাতটা কাব্যগ্রন্থের
অমূল্য দামে আমি তা কিনে নিয়েছি।
গাড়ির দুলুনিতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখি আমি
আমি নেমে পড়েছি সেই ষ্টেশনে কুয়াশার সাদা পর্দা ঢাকা প্লাটফরমে
কই, কেউ তো নেই দাঁড়িয়ে?
শুধু স্টেশনের নামটাই দু’হাত তুলে আমাকে সান্ত্বনা দিলো, ফুলতলী।
হ্যাঁ, এই তো সেই নাম যা মেঘনার খেয়াঘাটে আমি ফেলে এসেছি।
আমি সর্ষে ক্ষেতের পাশ দিয়ে, মটরশুঁটির ঝোপ মাড়িয়ে
সেই গাঁয়ের হিজলতলায় দাঁড়াতেই বৌঁ ঝিরা
মাছের মতো ঝাঁক বেঁধে আমাকে ঘিরে দাঁড়ালো।
পাথরকুচির পাতার মতো তাদের স্বাস্থ্যোজ্জ্বল আনন।
তাদের খোঁপা আর বেনী থেকে ছড়িয়ে পড়ছে
নিসিন্দাÑনিংড়ানো কেশতলের গন্ধ।
তাদের বুকে মাতৃত্বের ঈষৎ হেলানো গৌরব।
তারা একযোগে এক কুটিরবাসিনীকে আহ্বান করে আমাকে ঘিরে
দাঁড়ালো।
একটি ঘর তার ঝাঁপ খুলে দিচ্ছে।
ঐ তো সে। মেঘনার লাফিয়ে ওঠা কালো রুই।
গোধূলিতে ঘর-ফিরতি রাখালদের হাঁকডাকের মতো খুশিতে উপচানো।
পড়ন্ত বেলায় লুকিয়ে পড়া সহস্র শালিক নিয়ে
দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারুর মতো দেহ তার। চোখ যেন
রাজ মহীপালের দীঘি।
তার বুকের ভেতর একটি ভারতপাখির মতো আমি
অনন্তে হারিয়ে গেলাম।