৮২ বছরের জীবনে তাঁর সুবিশাল রচনাসম্ভার বিস্ময় উদ্রেককারী তো বটেই, সেই সঙ্গে তাঁর প্রতিভারও পরিচায়ক বটে। এর মধ্যে ১৫০টি উপন্যাস আর ৩৬০টির মতো হীরকদ্যুতি ছড়ানো ছোটগল্প রয়েছে, যেগুলোর ভেতর আবার বেশ কয়েকটি বিশ্বসাহিত্যে স্থান পাওয়ার যোগ্য। এ ছাড়া টুকরাটাকরা লেখালেখির সংখ্যা যেমন অগণন, তেমনি প্রবন্ধের সংখ্যাও কম নয়। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ গ্রামের মানুষ হলেও শহরজীবন তাঁর লেখালেখিতে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। যদিও প্রথম জীবনে বাঙালি ঘরের রেওয়াজ অনুযায়ী বাড়ি থেকে পালানোর অভ্যাস তাঁর সহজাত হয়ে উঠেছিল। এই পালানোর ব্যাপারটা খানিকটা প্রকৃতির সঙ্গে অর্থাৎ নৈকট্যে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।
বাবা সৈয়দ আবদুর রহমান ফেরদৌস ছিলেন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। লেখালেখির বীজটা পেয়েছেন অকালমৃত মায়ের কাছ থেকে। মাত্র ৯ বছর বয়সেই সিরাজ মাতৃহারা হন। মায়েরা ছিলেন দুই বোন। একই সঙ্গে তাঁরা ছিলেন খালা আর চাচিমা। খালা ছিলেন বিধবা। স্বদেশি করার কারণে বাবা নিজ এলাকা মুর্শিদাবাদে ঢুকতে পারতেন না। আমাদের চার ভাইকে মানুষ করার ভার পড়ল খালার ওপর। ওদিকে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের তদবিরে বাবার নির্বাসন সংক্ষিপ্ত হলে আমার নানাজির আদেশে বাবা অপরিণতবয়স্ক ছেলেদের দেখভালের জন্য খালাকেই বিয়ে করলেন। বাড়িতে শুরু থেকেই পড়াশোনার পরিবেশ ছিল। মা-খালা দুজনেরই লেখাপড়ায় ঝোঁক থাকলেও খালা মায়ের মতো গল্প-কবিতা নয়, অন্যান্য লেখালেখি করতেন। তাঁর হাতের গদ্যটা ছিল অত্যন্ত সাদু। তিনি ছিলেন অসাধারণ এক মহিলা। খুব যত্ন-আত্তি করতেন শুধু প্রথম পক্ষের আমাদেরই নয়, পরের চার ভাইকেও সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্বও তাঁর কাঁধেই বর্তেছিল। বাবাও লেখালেখি করতেন পত্রপত্রিকায়, তবে সেগুলোর বেশির ভাগ ছিল রাজনৈতিক গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ। বাবা, মা ও খালার প্রভাবই হয়তো আমাকে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করার ইন্ধন জুগিয়েছে।
সর্বোপরি আমার মধ্যে সেই ছোটবেলা থেকেই মানুষের জন্মগত প্রবৃত্তি স্বাধীনচেতা মনমানসিকতা কাজ করত। প্রথমে আমি ‘ইবলিস’ ছদ্মনামের আড়ালে লেখালেখি করতে শুরু করি। ইবলিস যে শয়তানের আরেক নাম কে না জানে। উপরন্তু সে যে সবচেয়ে জ্ঞানী সে কথা মাটিতে চলাফেরা করা মানুষকে সালাম না করার মধ্যেই লুকিয়ে আছে। মাটির তৈরি মানুষের কাছে সে কখনোই নত হবে না। নিজের মনের ভেতর এ রকম একটা ভাব আনার চেষ্টা থেকেই ওই ধরনের প্রচেষ্টা।
এখানে আরেকটা কথা না বললেই নয়। আমার কোনো লেখাই নিজস্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া লেখা নয়। আমার বিশ্বাস, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ব্যতিরেকে কোনো লেখা দাঁড় করানোটা প্রায় অসম্ভবেরই শামিল।
হঠাৎ বিগত ৫ সেপ্টেম্বর পত্রিকায় তাঁর মৃত্যুসংবাদ পড়ে চমকে গিয়েছিলাম। বলা নেই কওয়া নেই, একমাত্র বয়স ছাড়া কোনো অসুখবিসুখ বা অসুস্থতার খবরও আগে থেকে জানা যায়নি, বলতে গেলে কোনো রকমের চিকিৎসা করার সুযোগ না দিয়েই চলে গেলেন এ সময়ের একজন সত্যিকারের প্রতিভাবান কথাশিল্পী। কী কাকতাল, ঠিক একই সমান্তরাল সময়ে বাংলাদেশ তথা বাংলা ভাষার আরেকজন মৃত্যুঞ্জয়ী লেখককেও আমরা হারিয়েছি, যাঁর অকালপ্রয়াণ শোকতাপে মুহ্যমান বাংলা ভাষার পাঠক কত দিনে কাটিয়ে উঠবে বলাটা খুবই কষ্টকর। মাত্র ৬৪ বছর বয়সে বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ূন আহমেদকে হারানোর ব্যথা-বেদনা এখনো এতটা দগদগে আর ব্যথাভাবাতুর যে সেটা সামাল দেওয়ার আগেই আবার সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে হারানোটা আমাদের স্বল্পবিত্ত জীবনে কতটা বিয়োগান্ত তা বোধ করি বলার অপেক্ষা রাখে না।
এই যে এত শতসহস্র লেখালেখি, এর মধ্যেও সিরাজ তাঁর পর্বতপ্রমাণ সৃষ্টির মধ্যে জীবনের মাঝামাঝিতে এসে বহু পরিশ্রমসাধ্য ‘অলীক মানুষ’ নামের যে উপন্যাসটি লিখলেন, সেই উপন্যাস তাঁকে শুধু খ্যাতির শীর্ষেই নিয়ে গেল না, সমগ্র বাংলা সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করল। সে সম্পর্কেও সিরাজের সহজ-সরল স্বীকারোক্তি_’অলীক মানুষ উপন্যাসটা লেখার পেছনে ছিল অগ্রজ গৌরকিশোর ঘোষের প্রণোদনা। মুসলিম জীবন নিয়ে এতকাল যা কিছু লিখেছি তার নির্যাস বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। নিরন্তর সংবাদ লিখতে লিখতে যখন আমার হাত বসে যাওয়ার দশা, ঠিক সে অবস্থায় আর কোনো কিছু না ভেবে আমার মাওলানা দাদা সম্পর্কে লিখতে শুরু করলাম। ফরায়েজি আন্দোলনের প্রবক্তা এই মানুষটি, গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়ানোটাই ছিল যাঁর কাজ, ‘আংরেজ হঠাও’ স্লোগান দেওয়া কট্টর মৌলবাদী এই পিতামহটি যে রসকষহীন ছিলেন তা নয়, নানা বৈপরীত্যে গড়া আশ্চর্য এক আকর্ষণীয় চরিত্র।
‘উপন্যাসটিতে আমি আমার সমসাময়িক কালটাকে বদলে কয়েক শতক পিছিয়ে হিন্দু-মুসলমান চরিত্রকে পাশাপাশি রেখে গোটা সমাজটা তুলে ধরতে চেয়েছি। একটা সময়ে এসে টের পেলাম, এই কাহিনী লেখা আমার পক্ষে খুবই দুরূহ, তাই ফর্মটা ওলটপালট করে অনেক খাটাখাটুনি আর অনিশ্চয়তা কাটিয়ে একটানা সময় নিয়ে উপন্যাসটা শেষ করলাম। অবশ্য এর জন্য নানা ঘাত-প্রতিঘাত ডিঙাতে হয়েছিল।’
সিরাজ কিন্তু সাহিত্যের অন্য শাখা-প্রশাখায়ও সমান দাপটে সৃজনশীল ছিলেন। ডিটেকটিভ লেখার ক্ষীণধারাটিও সজীব রাখতে প্রয়াসী হয়েছিলেন কর্নেল নীলাদ্রি শেখরের মতো অনবদ্য চরিত্র সৃষ্টি করে। সামনের শারদীয় সংখ্যার জন্য এই কর্নেল সিরিজের লেখা ডিকটেশন দিতে দিতেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিলেন হাতে কলম গুটিয়ে সারা জীবন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় লেখকটি, যাঁর নাম সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। তাঁর চরিত্রে ছিল বহুমুখী অসামান্য বুদ্ধি ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের মিশেল। ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে তাঁর ছিল দারুণ সখ্য। হয়তো আমার মধ্যে সিরাজ নিজেকেই খুঁজে পেতেন, কে জানে?
'অলীক মানুষ' এক অনবদ্য সৃষ্টি
