সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চলে গেলেন। তার তো তেমন কোনো অসুস্থতার খবর শুনিনি। যখনই দেখেছি, প্রাণবন্ত, হাসিখুশি মানুষ হিসেবেই জেনেছি। তার সঙ্গে প্রথম কবে দেখা হয়েছে, আজ আর তা মনে নেই। তবে যতবারই তাকে দেখেছি মনে হয়েছে, অকপট নির্ভেজাল একজন মানুষ। যার ভেতরে ও বাইরের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো সৃষ্টিশীল লেখকদের বহু বহু বছর বেঁচে থাকা উচিত।
মাত্র ক’দিন আগে আনন্দবাজার গ্রুপের কোনো একটি পূজা সংখ্যায় তার কবিতা এবং উপন্যাস পড়েছি। উপন্যাস পড়ে আমার একটুও মনে হয়নি সুনীল ফুরিয়ে গেছেন। বরাবর তার লেখার মধ্যে একটা বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখতেন। যে কোনো বিষয়কে গল্প, উপন্যাস বা কবিতায় রূপান্তর করার অসামান্য ক্ষমতা ছিল তার। আমি তার মৃত্যুতে প্রথমে যা ভাবলাম তা হলো একটা যুগের শেষ হয়ে গেল। সে যুগটা কল্লোল সাহিত্য যুগের পর বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যুগ। যৌবনে সুনীল, শক্তি, সন্দীপন, সঞ্জীব এরা সব বাউণ্ডুলে তরুণ এবং অসম্ভব রকম সৃষ্টিশীল ছিলেন। অভিজ্ঞতার জন্য জীবনের আয়ু ক্ষয় করতে এতটুকু সংকোচ ছিল না তাদের। টাইম ম্যাগাজিনে এই রাগী-সৃষ্টিশীল তরুণদের নিয়ে একটি প্রচ্ছদ নিবন্ধ হয়েছিল। সেটা অবশ্য বহুকাল আগের কথা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আর বেঁচে নেই। থাকার মধ্যে আছেন শীর্ষেন্দু। তবে শীর্ষেন্দু ভিন্ন বৃত্তের লোক। তিনি তাদের দলে পড়েন না। সাহিত্যে তার জাত আলাদা।
সুনীল প্রায়ই বাংলাদেশে আসতেন। বিশেষ করে বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিনি আসতেন। আমরা সবাই জানি বাংলাদেশ তার পিতৃভূমি ছিল। সেটা ভুলে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। বহু গল্প, উপন্যাস, কবিতায় তিনি তার কৈশোরের ফেলে আসা স্মৃতি ব্যক্ত করেছেন। শেষদিকে তো বলতেন, ‘বাংলাদেশে আমি জন্মেছি। বাংলাদেশ আমার প্রাণের একটা অংশ।’
১৯৮০ সালের একটু আগে আমি ইত্তেফাক ভবন থেকে ‘সাপ্তাহিক রোববার’ পত্রিকাটি প্রকাশনার দায়িত্বে ছিলাম। এ সময়ে একবার আমরা পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন লেখককে ঢাকা ক্লাবে দাওয়াত দিয়ে আপ্যায়িত করেছিলাম। তাদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো ছিলেনই, আরও ছিলেন সাগরময় ঘোষ-সপত্নীক, সন্তোষ কুমার ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়সহ অনেকেই। ব্যক্তিগতভাবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন আড্ডাবাজ। আমার মনে আছে, আমরা একবার বলধা গার্ডেনে এক চাঁদনি রাতে সারারাত আড্ডা দিয়েছিলাম। সেদিন অনেক বিষয় নিয়ে আমাদের কথা হয়েছিল। সুনীলকে দেখলাম সারা রাত জেগেও সকাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন সজীব এবং প্রাণচঞ্চল। তার এ সজীবতা, প্রাণচাঞ্চল্য সর্বোপরি এই তারুণ্যই তার সাহিত্যে নানাভাবে এসেছে। তার ভাষা ছিল সহজাত, টানটান গদ্যে তিনি ছবি মূর্ত করতে পারতেন দ্রুত। তার ছিল সরস হাস্যময় দৃষ্টি যেকোনো কিছুর মধ্যে সজীব সরসতা খুঁজে দেখার চোখ ছিল তার। এটি যেকোনো লেখকের জন্য অনেক বড় বিষয়। কালজয়ী লেখকদের মধ্যেই আমরা এ ধরনের চোখ দেখি। সুনীলের সেই চোখ ছিল।
সুনীল ছিলেন বরাবর আধুনিক। সারা বিশ্বে কোথায় কখন কী হচ্ছে হোক তা বিজ্ঞানে বা দর্শনে সবকিছু ছিল তার নখদর্পণে। প্রচুর পড়তেন তিনি; এমনও দেখেছি মুড়ি-চানাচুর খেতে খেতে মুড়ি রাখার কাগজটিতেও চোখ বোলাচ্ছেন। আর প্রায় ধর্মজ্ঞানে সাহিত্যের কাজটি করতেন। হয়তো সারারাত আড্ডা দিয়েছেন; কিন্তু ঠিক ভোর সাতটায় উঠে নিজের ধারাবাহিক উপন্যাসের নতুন কিস্তিটি ঠিকই লিখে শেষ করেছেন। ছিলেন অসামান্য বন্ধুবৎসল, পরোপকারী। আর এসবই করতেন নিঃশব্দে; কাউকে জানতেই দিতেন না কার জন্য তিনি কী করছেন।
সুনীল ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম অনুরাগী। এদেশ ও দেশের মানুষের জন্য ছিল তার আত্মার টান। হয়তো এদেশে তার শেকড় বলেই সুনীলের এতো অনুরাগ ছিল বাংলাদেশের প্রতি।
সুনীলের সঙ্গে একত্রে আড্ডার বহু স্মৃতিই আমার আছে। তিনি মনেপ্রাণে ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। ক্ষুদ্রতা এবং নীচতার উর্ধে থাকা একটা সুন্দর মানুষ। তার জীবনদর্শন যে কী ছিল তা আমি নানাভাবে বোঝার চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয়, তিনি জীবনবাদী লেখক। সময়ের মূল্য পরিশোধ করেছেন নিজের মতো করে, সফলভাবে। অনেক কথাই বলা যায় সুনীলকে নিয়ে। তবে একথা সত্য যে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো এ রকম শক্তিশালী লেখক শত বছরেও জন্মায় না। তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ঈশ্বর বিশ্বাস সম্পর্কে নীরব থাকতেন। সেটা একান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার; কিন্তু আমি তার মৃত্যুতে সৃষ্টিকর্তার কাছে তার বিদেহী আত্মার শান্তি ও স্থিতির জন্য সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা জানাই। সেই সঙ্গে জানাই স্বাতী বৌদি এবং তার পুত্র সৌভিকের জন্য গভীর সমবেদনা।