আসলে মানুষ আনন্দের খোঁজ দীর্ঘদিন ধরেই করছে। আনন্দ এবং শান্তি এ ধারণাগুলো অনেকটাই আমাদের এ অঞ্চলের। হয়তো এশীয়ই। বরং সুখ, ফুর্তি, বিনোদন বা যাকে বলে প্লেজার এগুলো পশ্চিমারা খুঁজেছে। তারা পেয়েছেও কিছু। কিন্তু শান্তি এই শব্দটিকে টিএস এলিয়ট শান্তিই রেখেছিলেন, পিস্ (peace)করেননি। আনন্দ শব্দটির ক্ষেত্রেও তাই। এর কারণ আছে। যেমন অভিমান শব্দটির ভালো ইংরেজি শব্দ নেই; তেমনি আমাদের ধারণা বা মানসে যে আনন্দ; সেটা ওদের মধ্যে নেই। আল মাহমুদের একটি কবিতায় আছে যে, কতদূর এগুলো মানুষ। মানুষ অনেক ক্ষেত্রে এগিয়েছে ফুর্তির ক্ষেত্রে, বিনোদনের ক্ষেত্রে। প্রচার মাধ্যমে, প্রযুক্তিতে সে অগ্রগতির শব্দে আমরা যা মুখস্থ করে নিয়ে কোনোমতে মুখস্থ দিনাতিপাত করছি, তাতে আনন্দ আছে কি-না জানি না। হয়তো আছে। শুধু এখানেই নয়; মানুষ বিনোদনের ক্ষেত্রে এগিয়েছে আরও অনেক দূর। কিন্তু শান্তির দিক থেকে ক্রমশ দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। মাওলানা রুমি তার সমাধিলিপিতে লিখেছিলেন ‘মাটির পৃথিবীতে আমার সমাধি খুঁজো না/ মানুষের মনে খুঁজো।’ আজ থেকে আটশ’ পাঁচ বছর আগে যার জন্ম, ২০০৭ সালে তার বইটি ছিল আমেরিকার বেস্ট সেলার বই। কিন্তু সমকালীন এত লেখক-কবি পৃথিবীতে! তবু রুমির বইটি আজকের দিনে এসে বেস্ট সেলার হলো কেন? কারণ তিনি সেই বাঁশিটির সুরটাকে খুঁজছেন। বাঁশ থেকে বিচ্ছিন্ন বাঁশিটি যেভাবে কান্নাকাটি করছে বাঁশের কাছে ফিরে যাবার জন্য সেই পরমাত্মার কাছে ফিরে যাবার জন্যই যেন তার করুণ চিৎকার। এই বাঁশি আমরা শ্রীকৃষ্ণের মাঝেও পাই। যেখানে রাধা কৃষ্ণকে অনুযোগ করছেন যে, ‘পরজনমে হইও রাধা’; মানে পরের জন্মে তুমি রাধা হইও। তাহলে তুমি আমার এই বেদনা বুঝতে পারবে। বলছেন, ‘দুখিনীর দিন দুখিতে গেল/ মথুরা নগরে ছিলে তো ভালো?’ এতো কিছুর পরেও মঙ্গল কুশল জানবার জন্য রাধার এই যে ঐকান্তিকতা_ এটাই হচ্ছে আমাদের বিষয়। আমাদের আনন্দ-বেদনার মূল সুর। মানুষ আনন্দিত হয় কেন? মানুষের আনন্দিত হবার কারণের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। বিপুল বৈচিত্র্যময় এ আনন্দ। তবে এর মূল সুর একই। প্রচলিত অর্থেই যদি বলি মানুষ শত্রুর পরাজয়ে খুশি হয়, সাফল্যে দুঃখিত হয়। আবার নিজের কিংবা আপনজনের সাফল্যে আনন্দিত হয়; পরাজয়ে দুঃখ পায়। এবং মানুষ ব্যর্থ হওয়াটা পছন্দ করে না। জীবনকে চালিয়ে নিতে মানুষ আনন্দের সংস্পর্শে থাকতে চায়। এ আনন্দ আমরা কখনও কখনও পাই, আবার কখনও কখনও আকাঙ্ক্ষা আর প্রাপ্তির ব্যবধানে ভারাক্রান্ত হই। তবু আনন্দহীনতায় কে বাঁচিতে চায়? সব মানুষের মনেই, জীবনের নানা বাঁকে সফলতা একটি আনন্দদায়ক বিষয়। বেঁচে থাকার চেষ্টায় সফলতা সাধারণভাবে সব মানুষের মনেই একটা উপলব্ধির সঞ্চার করে। আবার কিছু আনন্দ আছে, যা আমরা সমস্ত জীবন ধরে তিলে তিলে খরচ করে বেঁচে থাকি। যেমন, পরিবারের সবাই অর্থাৎ মা-বাবা, ভাই-বোনদের নিয়ে বসবাস করা এবং তাদের সঙ্গে জীবনের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে বেঁচে থাকার আনন্দ। জীবন যাপনের সাধারণ এ আনন্দ মানুষ সমস্ত জীবনে বহন করে বেঁচে থাকতে চায়। এটা আমার কাছে খুব বড় ব্যাপার মনে হয় যে, শত প্রতিকূলতার মাঝেও মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজেকে চেনার জন্য; নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ভালো-মন্দগুলো যাচাই করে দেখার জন্য চিন্তা-ভাবনা করছে বিস্তর। এ জন্য মানুষ যদিও সময় নিচ্ছে অনেক; আনন্দের ধরনটাও দিনে দিনে পাল্টায়। সময় ও পরিবর্তনের হাত ধরে ধীরে ধীরেই পাল্টায়। এটা স্বাভাবিক। আনন্দের সঙ্গে বিশ্বাসের ব্যাপারটিও আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কথা মনে পড়ছে। তিনি ঈশ্বরকে বলছেন, ‘তাই তোমার আনন্দ আমার ‘পর তুমি তাই এসেছ নীচে আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার সব হত যে মিছে’ ২. মানুষ এখন
অনেক কিছু ধরে রাখতে জানে, যা আগে সম্ভব ছিলো না। ছাপাখানাই বা আবিষ্কার হয়েছে কত বছর? এই গত কয়েক বছরে কম্পিউটার, মোবাইল ফোন কত পরিবর্তনই না এনে দিয়েছে! ভাবা যায় না। তবে সমস্যা হচ্ছে, অন্য জায়গায় এই দ্রুত পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের আকাঙ্ক্ষার পরিমাণটাও বেড়ে যাচ্ছে। রাতারাতি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে মানুষের আকাঙ্ক্ষার আগুন। এমনকি আকাঙ্ক্ষা ব্যাপারটা অনেকটা লোভের আকার ধারণ করছে। মানুষ অনেক বেশি লোভী হয়ে উঠছে। এর ফলে, লোভ নিবৃত করতে গিয়ে মানুষ দিগ্বিদিক ছুটছে ভীষণ। এই গতির কবলে পড়ে মানুষের এত বছরের অর্জিত মূল্যবোধ ধ্বংসপ্রায়। এই লোভ মানুষের সকল পুণ্যাকাঙ্ক্ষাকে গ্রাস করে ফেলছে। তৈরি হচ্ছে শত্রুতার মায়াজাল। উনিশশো শতকের বড় বড় মনীষীর আবির্ভাব একটা সময়ে এ শত্রুতার ধারণাকে পরাজিত করতে পারছিলো। কিন্তু কোনো এক অশুভ শক্তির কবলে পড়ে, এই আধুনিক সময়ে এসেও দেখা যাচ্ছে, গ্রামে গ্রামে মারামারি বেধে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এর বাইরে থাকতে পারছে না। প্রভুত্ব বিস্তার, দাপট আর ক্ষমতার দৌরাত্ম্যে মানুষ লোভী হয়ে উঠছে। শত্রু হয়ে উঠছে একে অপরের। কিন্তু আরও এক লোভ হয়তো জন্মাতে পারতো আমাদের মনে সেটা হলো আনন্দ পাবার লোভ। কিন্তু আনন্দ পাবার লোভ আমাদের আর নাই। আনন্দের প্রকৃত স্বাদ কি মানুষ পেতে চায় না? সবচেয়ে দুঃখ লাগে, এটা না বলে পারছি না মানুষের লজ্জা কমে গেছে। ক্রমশ নির্লজ্জ হয়ে উঠেছে মানুষ। প্রচণ্ড মিথ্যা বলার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে মনে মনে আনন্দ পাবার মুহূর্তে চলে এসেছে মানুষ। আর কেউ এর বিপরীত হলে তাকে হেয় করাটাও তো এখনকার রীতি। তাকে, ‘তুমি তো স্মার্ট না’ শুধু এই কথাটা বলার জন্য সমাজ একেবারে পাগল হয়ে ওঠে। এসবের বাইরে আরও কিছু মানুষ আছেন। যারা কোথাও আশ্রয় না পেয়ে শেষমেশ ধর্মের মাঝেই আনন্দ খুঁজে নেবার চেষ্টা করছে। একসময় মানুষ ভেবেছে, অর্থনৈতিক মুক্তিই তার চূড়ান্ত মুক্তি। তারপর ভেবেছে, তার রাজনৈতিক মুক্তি প্রয়োজন। এক পর্যায়ে মানুষ এও ভাবছে যে, আমাদের সংস্কৃতিকে আগ্রাসন থেকে মুক্ত করতে পারলে হয়তো বিজয়ী হব। কিন্তু দেখা গেল, এই বিজয়গুলোর কোনোটাই আর টেকসই হচ্ছে না। তাহলে কি ‘কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার’ এমন হতাশা নিয়েই আমাদের দিন ফুরাবে? যুগে যুগে যেখানে মৃত্যুকে মানুষ এড়াতে চেষ্টা করেছে, সেখানে আমাদের সাধুরা মৃত্যুকে আহ্বান করছেন। ‘হরি দিনতো গেল/ সন্ধ্যা হলো/ পার করো আমারে’। কিংবা ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি… পারে নিয়ে যাও আমায়’। কিন্তু বাস্তবে মানুষ মায়া থেকে আর বেরুতে পারছে না। সন্ন্যাস নেবার দিন শেষ। কিন্তু বস্তুত মানুষ তো কষ্টে আছে। একটা বিষাদময় বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। এ বিপর্যয়ে আমাদের চারপাশে শুধুই মানুষের ভিড়। তবু যেন আমরা প্রত্যেকে একা। কারণ আমরা বিভেদের মন্ত্র পাঠ করে নিয়েছি নিজ নিজ স্বার্থকৌশলে। সেই ফাঁকে আনন্দ চলে গেছে দূরে। আগে যেমন একটা কথা ছিলো দিলি্ল বহুদূর। তেমনি আনন্দের ঠিকানাও বহুদূরে। সময়টা মানুষের নিয়ন্ত্রণে নাই। উল্টো মানুষই এখন সময়ের হাতে বন্দি। যার ফলে আনন্দ নিয়ে ভাববার দুদণ্ড সময় তার নাই। তবু বলতে হয়, যে মানুষ ধৈর্য ধরে বহুদূর সে যেতে পারে। আমার ধারণা বা আমার বিশ্বাস, মানুষ একদিন ঠিকই ফিরে আসবে তার আপন আনন্দের খোঁজে। হয়তো সময় নেবে। কিন্তু হবে। একদিন কবিতায় সত্য ফেরী করার কথা বলেছিলাম। আজ মনে হয় ‘আনন্দ ফেরারী’ লিখতে হবে। তবু আনন্দ খোঁজে মন সারাক্ষণ।