মানুষের মৃত্যু হয়, কবির মরণ নেই। শারীরিকভাবে ‘নেই’ হয়ে গেলেও কবি বেঁচে থাকেন পাঠকের মানসপটে, বইয়ের পাতায়। আমার দোস্ত কবি শহীদ কাদরীকে নিয়ে দু-চার কথা লিখতে বসে প্রথমত এসব কথাই মনে আসছে। স্বীকার করি, খবরটা শোনার পর থেকে বেশ ভারাক্রান্ত অবস্থায় আছি। ‘একে একে নিভিছে দেউটি’, চলে যাচ্ছে সবাই। কেবল বসে আছি আমিই অধম, কখন ডাক আসে তার অপেক্ষায়!
খবরটা যখন পেলাম তারপর থেকে আসলেই ‘কাদরী’ময় হয়ে আছি। কত স্মৃতি আমাদের। দুজনের। বেশুমার আড্ডা, সাহিত্য সাহিত্য করে উড়িয়ে দেওয়া, পুড়িয়ে দেওয়া জীবন! শহীদ কাদরী ছিলেন তুখোড় আড্ডাবাজ, আমার চেয়েও। একবার আড্ডায় বসলে, কথা শুরু হলে ওঠার নামগন্ধ থাকত না। কী ছিল না সেখানে—বৈষ্ণব কবিকুল থেকে রবীন্দ্রনাথ হয়ে তিরিশি কবিরা, ছিলেন পাবলো নেরুদা, গিওম আপেলিনেয়ারসহ আরও কত সৌরভ! শিল্পকলার নানা অঙ্গন তখন আমাদের হাতের মুঠোয়। আজ মনে হয়, গত শতকের সেই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে জীবনকে এভাবেই তো আমরা ছড়িয়ে দিয়েছিলাম বাংলাদেশের কবিতার বীজতলা তৈরির জন্য, কাব্য-বাস্তবতা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায়। আর সেই আন্দোলনের অন্যতম সেনানী শহীদ, আমার ‘কাদরী সাহেব’।
শহীদ কাদরীকে আমি ‘দোস্ত’ বলে ডাকতাম। হ্যাঁ, তিনি আমার দোস্তই ছিলেন। বয়সে তিনি আমার চেয়ে কিছুটা ছোট হবেন হয়তো। অবশ্য সেটা কোনো বড় বিষয় নয়। আমার কবিতা বরাবরই পছন্দ করতেন তিনি, আমিও পছন্দ করতাম তাঁর কবিতা। তবে আমার লেখার সমালোচনাও করতেন শহীদ। তাঁর সাহিত্যের চোখ ছিল উচ্চমার্গীয়—খুবই প্রখর।
জীবন সায়াহ্নে এখন যে স্মৃতিহীন হয়ে বসে আছি! অতীতজীবন এখন ঢেউয়ের মতো আসে, মুহূর্তে মিলিয়েও যায়, মনের মধ্যে বিস্তারিতভাবে স্থায়ী হয় না কিছু। তাই কী বলব তাঁকে নিয়ে। বলি যে, তিনি—শহীদ কাদরী—আমার দোস্ত—বড় কবি ছিলেন। তাঁর কবিতায় নাগরিক অনুষঙ্গের বহুমাত্রিক ব্যবহার ঈর্ষণীয়। ওঁর একটা কবিতা আছে ‘বৃষ্টি বৃষ্টি’ নামে—‘সহসা সন্ত্রাস ছুঁলো…’—বর্ষণমুখর দিনের সঙ্গে নাগরিক জীবনের যে সরল অথচ বহুমাত্রিক যোগাযোগ ফুটে উঠেছে কবিতাটিতে, তা অসম্ভবরকম মনোহর। মনে পড়ে, প্রণম্য সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফরের নির্দেশে সমকাল পত্রিকার তরফ থেকে কবিতা আনার জন্য এক বৃষ্টিমুখর দিনে শহীদদের হাটখোলা রোড়ের বাড়িতে গিয়ে হানা দিয়েছিলাম। তিনি তখন ‘বৃষ্টি বৃষ্টি’ নামে কবিতাটি লিখে শেষ করেছেন। তাঁকে বললাম, ‘দোস্ত, কবিতাটি দাও।’ তিনি বললেন, ‘মাত্র তো লিখে শেষ করলাম, এটা খসড়া।’ বললাম, ‘ওটাই দাও।’ পরে সেই খসড়াটিই আমি নিয়ে এসেছিলাম। নাগরিক খোলসের সঙ্গে বৃষ্টিকে যুক্ত করে এমন সার্থক কবিতা কমই লেখা হয়েছে বাংলা সাহিত্যে।
জীবনের স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী আমরা একে অন্যের সঙ্গে বহু মান-অভিমান করেছি, গল্পগুজবে মেতেছি, ভালোওবেসেছি পরস্পরকে। বিউটি বোর্ডিংয়ে আমাদের একটা নিয়মিত আড্ডা হতো। নিয়মিত তাঁর বাসায়ও যেতাম। ওঁদের বাড়িতে কত যে খেয়েছি, সেই রন্ধন-স্বাদ যেন মুখে লেগে আছে, এখনো! দু-একবার হয়তো তাঁর অফিসেও গিয়েছি। নতুন কবিতা লিখে সেটা পড়ে শোনানোর বাতিক ছিল শহীদের। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে বহু ঘাত-প্রতিঘাত ছিল, ঝগড়া ছিল। আবার দুজন দুজনকে ছেড়ে থাকতেও পারতাম না—রসায়নটা ছিল এমনই।
পারিবারিক নানা কারণে তাঁর জীবনটা স্থিতিশীল হয়নি। কিন্তু গোছানো জীবনের প্রতি ওঁর একটা মোহ ছিল। মনে হয় না যে সেটা তিনি পেয়েছেন। চালাক-চতুর লোক বলতে যা বোঝায় শহীদ কাদরী তেমনটা ছিলেন না। থাকলে হয়তো জীবনটা তাঁর আরেকটু গোছালো হতো।
মূলত ছিলেন দিলখোলা, ফুর্তিবাজ, সাদাসিধে ভালো মানুষ। আর ভালো মানুষ ছিলেন বলেই তাঁর অভিমানও ছিল বেশি। আমাদের সমসাময়িক কালে তাঁর মতো জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ খুব কমই দেখা গেছে। কী তাঁর বিদ্যাবুদ্ধির ধার!
শামসুর রাহমানও পছন্দ করতেন তাঁকে। তবে আমার সঙ্গে সম্পর্কটা ছিল বেশি প্রগাঢ়। আজ এত দিন পরে ঠিক মনে করতে পারছি না, বুদ্ধদেব বসু কার লেখা আগে ছেপেছিলেন তাঁর কবিতা পত্রিকায়—আমার না শহীদের? নাকি আমার আর শহীদের লেখা একই সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল? স্মৃতির বুকে এখন ধুলো জমেছে। কিছুই মনে পড়ে না। তো, লেখা ছাপা হওয়ার আগ থেকেই অবশ্য আমাদের পরিচয়, বন্ধুত্ব ও গলায় গলায় ভাব। সেই বন্ধুত্বের কত বাঁক! একেক বাঁকে একেক রকম রং। আমার সোনালি কাবিন প্রকাশের পর প্রবল উৎসাহে বইটি দিয়েছিলাম তাঁকে, যেন পড়ে প্রতিত্রিয়া জানান, এই আশায়। সেই প্রতিক্রিয়া কাদরী জানালেনও বটে; কিন্তু বেশ খানিকটা দেরিতে। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কিঞ্চিৎ মন-কষাকষিও হয়েছিল। দুজনেই আমরা দুজনের লেখা পড়তাম। দেশান্তরী না হলে, জীবনে স্থিতি পেলে তিনি কি আরও কিছু বেশি কবিতা লিখতেন? জানি না ঠিক।
তবে সবকিছুর পরও শহীদ কাদরী লিখতে ভালোবাসতেন, লিখতেন অসম্ভব যত্নে। জীবনের চড়াই-উতরায় মেনে একসময় তিনি চলে গেলেন বিদেশ-বিভুঁইয়ে—জার্মানি হয়ে ব্রিটেন, তারপর আমেরিকা। এরপরও আমার মনে হতো না যে খুব বেশি দূরে চলে গেছেন তিনি। আমাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। আর দেশে এলে আমার সান্নিধ্য কামনা করতেন তিনি। এই তো কিছুদিন আগেও ফোন করেছিলেন। বললেন, ‘আমি শহীদ।’ জানতে চাইলেন, ‘দোস্ত, কেমন আছ?’ এখন আমি চোখে যেমন ঠিকভাবে দেখতে পাই না, তেমনি কানেও শুনতে পাই না ভালোমতো, ফোনে কথা বলতে কষ্ট হয় এ জন্য। তবুও কাদরীর সঙ্গে সেদিন খুব আনন্দ নিয়ে কথা বলেছি।
তাঁর মৃত্যুসংবাদ শোনা আমার জন্য খুব কষ্টের। কে যেন ফোন করে জানাল খবরটা। মানুষ হিসেবে এমনিতেই আমি নিঃসঙ্গ। শহীদের মৃত্যুর খবর জানার পর থেকে আরও বেশি নিঃসঙ্গ বোধ করছি। তাঁর সঙ্গে আমার অনেক-অঢেল স্মৃতি। এতকাল পর সে সবের অনেক কিছুই বিস্মৃত হয়েছি। কিন্তু আমাদের মধ্যে যে একটা ভালো বন্ধুত্ব ছিল, শুধু সেটাই এখন এই বৃদ্ধ কবির স্মৃতিপটে অমলীন হয়ে আছে।
২৯ আগস্ট ২০১৬, মগবাজার, ঢাকা।