পারুলকন্যা

কী খবর কবি সাহেব, কেমন রয়েছেন?

সোফা-কাম বেডটিকে বেড করে দিয়ে গেছে একজন বয়। কেবিনেটে রাখা বালিশ বের করে দিয়েছে। দুপুরের পর থেকে শুয়ে আছে কবি। নকশিকাঁথা বের করে পা থেকে গলা পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে। ঘুমাবার চেষ্টা করেছিল, হয়নি। ভেতরে শুধুই এক অস্থিরতা। এই হয়তো জ্ঞান ফিরলো মেয়েটির। জীবন-মৃত্যুর মাঝখান থেকে জীবনের দিকে ফিরে এলো। ছুটে এসে খবর দিল কোনও নার্স। সেই খবরে উৎফুল্ল হয়ে ছুটে গেল কবি।
উলটো চিন্তাও হয়েছে দুয়েকবার। মেয়েটির অবস্থা হয়তো ডিটরয়েট করলো। নার্স হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, শিগগির আসুন স্যার। রোগীর অবস্থা ভালো না। কবি ছুটে গিয়ে দেখল শেষ টান উঠেছে। এক্ষুনি বন্ধ হয়ে যাবে সব।
এই চিন্তা একদমই প্রশ্রয় দিতে চায় না কবি। না না নেগেটিভ চিন্তা করা যাবে না। আমেরিকানরা যেমন বলে থিংক পজেটিভ ওই থিউরিতে থাকতে হবে। পজিটিভ চিন্তা পজিটিভ রেজাল্ট আনবে। মেয়েটি অবশ্যই ভাল হয়ে উঠবে। এত চেষ্টা ব্যর্থ হতে পারে না।
আধঘণ্টা চল্লিশ মিনিট পরপরই রুম থেকে বেরিয়েছে কবি। আইসিইউতে গিয়ে মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়েছে। অপলক চোখে তাকিয়ে থেকেছে তার মাস্ক পরা মুখের দিকে। আর মনে মনে আল্লাহকে ডেকেছে। ইয়া হে আল্লাহ, পাক পরোয়ারদিগার, তোমার রহমতের সবগুলো দরজা এই অসহায় মেয়েটির জন্য খুলে দাও। তাকে তুমি দয়া করো। তার ওপর তোমার রহমত বর্ষণ করো। মৃত্যুর হাত থেকে তাকে তুমি ফেরাও। তাকে জীবন দান করো।
যতবারই এভাবে আল্লাহর কাছে রহমত চেয়েছে ততবারই পানি এসেছে চোখে। ডাক্তার নার্স কেউ না কেউ দেখে ফেলতে পারে ভেবে নিজেকে সামলেছে। আইসিইউতে ছটা বেড। মেয়েটিকে নিয়ে চার বেডে পেসেন্ট। এক বৃদ্ধ বাবার পাশে প্রায়ই এসে দাঁড়াচ্ছে তার দুমেয়ের একজন না একজন। চেহারা দেখে বোঝা যায় অবস্থাপন্ন। কবিকে যতবার দেখছে ততবারই মৃতপ্রায় বাবার কথা ভুলে তার দিকে তাকাচ্ছে। একবার কবিকে দেখছে আরেকবার দেখছে মেয়েটিকে।
অন্য দুটো বেডের একটিতে মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক। হার্ট অ্যাটাক করেছে। বাহাত্তর ঘণ্টা অবজারভেশনে রাখতে হবে। তারপর এনজিওগ্রাম করতে হবে। কটা ব্লক আছে হার্টে জেনে তারপর চিকিৎসা। পাশে চিন্তিত মুখে এসে দাঁড়াচ্ছে ভদ্রলোকের বোন আর বোনের ছেলে। কবি এক ফাঁকে জেনেছে ভদ্রলোক চিরকুমার। বোনের সংসারে থাকতেন। ভাল ব্যবসায়ী। এই ভাগ্নেকে আপন সন্তানের মতো ভালোবাসেন। ভাগ্নেই তাঁর সব ব্যবসা-বাণিজ্যের মালিক। সেই ছেলের নাম তুহিন। মামার জন্য তার কাতরতা অপরিসীম। কবির মতোই ছটফট ছটফট করছে। কিছুক্ষণ পর পর মামার শিয়রে এসে দাঁড়াচ্ছে। মামার হাতটা ধরছে, বুকে হাত বুলাচ্ছে। অচেতন মামা কিছুই টের পাচ্ছেন না। সুন্দরী মেয়ে দুটোর দিকেও তুহিন তাকায় না, কবির দিকেও তাকায় না। সে আছে মামাকে নিয়ে। তুহিনের মা ভাইয়ের জন্য চোখ মুচছেন, মাকেও সামলাচ্ছে ছেলে।
তুহিনকে খুবই ভাল লেগেছে কবির। দায়িত্ববান ছেলে। মামার জন্য যা যা করণীয় সব করতে তৈরি। আলাপ-পরিচয়ের সময় কবিকে বলেছিল, আমার বাবা আছেন, ভাইবোনরা আছে, অন্য মামাও আছেন কিন্তু কারও জন্যই আমার তেমন টান নেই। আমার সব টান এই মামার জন্য। এই মামাই আমার বাবা। তাঁর সম্পত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য আমার নামে করে দিয়েছেন বলেই যে আমি তাঁকে ভালবাসি তা না। যদি তিনি আমাকে একটা পয়সাও না দিতেন, যদি তিনি খুব গরিব হতেন, দরকার হলে আমি আমার রক্ত বিক্রি করে মামার চিকিৎসা করাতাম। যেমন করে পারি মামাকে বাঁচিয়ে রাখতাম। এই হসপিটালের চিকিৎসা ভাল বলে এখানে নিয়ে এসেছি। ওপেন হার্ট করাতে হলে সঙ্গে সঙ্গে করিয়ে ফেলবো। একমিনিটও দেরি করবো না। মামা না থাকলে কেউ থাকবে না আমার।
শেষদিকে গলা ধরে এসেছিল তুহিনের, চোখ ছলছল করে উঠেছিল।
আশ্চর্য ব্যাপার, শুধু মামাকে নিয়েই কথা বলে গেল তুহিন। একবারও কবিকে জিজ্ঞেস করলো না তার রোগী সম্পর্কে। যেন মামা ছাড়া পৃথিবীর কোনও ব্যাপারে কোনও আগ্রহ নেই।
অন্য বেডে আছেন বয়স্ক এক ভদ্রমহিলা। তাঁর অ্যাটেনডেন্ট আরেক মহিলা। তিনি আইসিইউতে ঢোকেন কম। বারান্দার চেয়ারে উদাস ভঙ্গিতে বসে থাকেন। দুপুরের দিকে চেয়ারে বসে তাঁকে ঘুমাতেও দেখেছে কবি। মনে হয় বাড়ির দীর্ঘদিনের কাজের লোক। ভদ্রমহিলাকে আগলে রাখাই তাঁর কাজ। মহিলার ছেলেমেয়েরা হয়তো বিদেশে।
খানিক আগে আইসিইউ ঘুরে এসেছে কবি। মেয়েটির একই অবস্থা। কোনও পরিবর্তন নেই। হাপরের মতো শ্বাস টানছে। অক্সিজেন মাস্কে জমছে কুয়াশা। কবি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে ফিরেছে। নকশিকাঁথায় শরীর ঢেকে টিভি দেখছে।
এ সময় দরজায় টুকটুক শব্দ।
কবি বলল, কাম ইন।
দরজা ঠেলে অম্লান বদনে ঢুকলেন হায়দার হোসেন। তারপর ওই কথা।
কবি উঠে বসলো। রিমোট টিপে টিভি অফ করলো, গা থেকে কাঁথা সরালো। হায়দার হোসেনকে দেখেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। খারাপ মেজাজ সামাল দেওয়ার কায়দা জানা আছে কবির। মেজাজ খারাপ অথচ মানুষটিকে এভয়েডও করা যাবে না এই ধরনের সমস্যায় ভাল রকম নির্বিকার হয়ে যায় সে। এখনও তাই হল। হায়দারের দিকে তাকিয়ে বলল, খাবার সকালের মতোই। রয়েছিও সকালের মতোই।
নো উন্নতি?
নো উন্নতি।
কিন্তু আপনি কেবিনে একা! রোগী কোথায়?
আইসিইউতে।
তাই নাকি?
জ্বি।
আমি ভেবেছি এই রুমেই আছে। আপনি তাকে পাহারা দিচ্ছেন।
এখনও সুযোগ আসেনি। ভবিষ্যতে এলেই দেব। রুম এডভান্স বুকড করে রেখেছি।
প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় নহাজার আটশো টাকা ভাড়া।
কাউন্টার থেকে জেনে এসেছেন?
না। অন্যভাবে জেনেছি।
চেয়ারে বসলেন হায়দার হোসেন। জানতে চাইলেন না কীভাবে জেনেছি!
না।
কেন?
আগ্রহ নেই।
গুড, ভেরিগুড। বেশি আগ্রহ না থাকাই ভাল। আচ্ছা এই রুমে সিগ্রেট খাওয়া যাবে?
না।
চা?
যাবে।
দিন তাহলে।
দিতে পারবো না।
কেন?
চা নেই।
আনান।
তার মানে আপনি অনেকক্ষণ থাকতে চাচ্ছেন?
অনেকক্ষণ না, কিছুক্ষণ।
রুম সার্ভিসে ফোন করলো কবি। তিনশো একে এককাপ চা পাঠান।
হায়দার তীক্ষ চোখে কবিকে খেয়াল করছিল। আচমকা বলল, এত বিরক্ত হয়ে আছেন কেন?
কবি হায়দারের দিকে তাকাল। বোঝেননি কেন বিরক্ত হয়ে আছি?
বুঝেছি। আমাকে দেখে।
রাইট।
আচ্ছা আমার সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
ভাল না।
কেমন?
খারাপ।
কতটা খারাপ?
অনেকখানি।
এক্সপ্লেইন করবেন!
করতে পারি।
করুন না, শুনি।
আপনি খুবই চালিয়াত টাইপের লোক। মিষ্টি মিষ্টি কথা দিয়ে শুরু করেন তারপর চলে যান আসল কথায়। অযথা গল্প তৈরি করে লোককে প্যাঁচে ফেলেন।
হায়দার হাসলেন। শুনে মুগ্ধ হলাম। আমার চরিত্রের এত ভাল এনালিসিস আমি নিজেও করতে পারবো না। ইউ আর সিম্পলি গ্রেট। লোককে প্যাঁচে ফেলি কেন জানেন?
জানি। ঘুষ খাওয়ার জন্য।
গ্রেট। এই তো আসল জায়গা ধরে ফেলেছেন। ঘুষই আমার প্রধান খাদ্য। ঘুষের জন্য যা যা করণীয় সবই আমি করি।
সেটা সকালবেলাই বুঝেছি কিন্তু এখানে সুবিধা হবে না।
হবে হবে। কীভাবে হবে টের পাবেন।
দরজায় নক করে চা নিয়ে ঢুকলো বেয়ারা। হায়দারের সামনে নামিয়ে রেখে হোটেলের কায়দায় বিল দিল কবিকে। কলম এগিয়ে দিল। কবি সই করলো।
বেয়ারা বেরিয়ে যেতেই চায়ে চুমুক দিলেন হায়দার। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন?
আপনার কোনও ব্যাপারই খেয়াল করছি না।
তাহলে আমি বলি।
আপনি খেজুরে গল্প করতে পছন্দ করেন?
করি। শুনুন যেটা বলতে চাইলাম। সকালবেলাই আপনার খেয়াল করা উচিত ছিল, চা খাওয়ার সময় আমার মুখে শব্দ হয় না। অনেক বড় মানুষকেও দেখি চা খাওয়ার সময়, না না চা পানের সময় লুইস লুইস করে শব্দ করে। এটা ছেলেবেলায় শিখেছিলাম।
ওরকম শব্দ করা?
আরে না ভাই, শব্দ না করা।
বুঝলাম।
ছেলেবেলায় গ্রামে ছিলাম। রাতের খাবারে সবশেষ আইটেম থাকতো দুধভাত। কখনও একটা বাংলাকলা, কখনও একটুখানি গুড়ও থাকতো দুধের সঙ্গে। ওসময় মা একটা কঞ্চি হাতে নিতেন। আগেই বলা থাকতো ভাত শেষ হওয়ার পর থালায় যেটুকু দুধ থাকে ওটা খাওয়ার সময়, না না পানের সময়, শব্দ যেন না হয় মুখে। যার শব্দ হতো তাকেই একটা কঞ্চির বাড়ি। এই কারণে দুধ চা কফি মানে যে কোনও তরল পান করার সময় আমার মুখে শব্দ হয় না।
কবি হায়দারের দিকে তাকালো। খেজুরে আলাপ রেখে আসল কথা বলুন। কেন এসেছেন?
ইনভেস্টিগেশনে। কীভাবে মেয়েটিকে আপনারা দিনের পর দিন টর্চার করেছেন নিজ চোখে সেটা দেখতে এসেছি। ভাল পথ ধরেছেন। ওই সেই গানের মতো, চোরেরে কও চুরি করো, পুলিশরে কও ধরো ধরো।
এখন আমি একটু রাগবো।
রাগুন রাগুন। নো প্রবলেম। এই ধরনের বড়লোকদের কেসে অনেক রাগারাগি ফাটাফাটি দেখে আমরা অভ্যস্ত। একদমই গায়ে লাগে না। রাগুন না, যতটা ইচ্ছা রাগুন। গালাগাল করতে চাইলে তাও করুন, নো প্রবলেম। শুধু গায়ে হাত টাত তুলবেন না। পুলিশের গায়ে হাত তুললে আরেক কেসে ফাঁসবেন। অবশ্য আপনাকে ফাঁসাতে চাইলে কোনও কারণ ছাড়া এখনই ফাঁসিয়ে দিতে পারি। নিজের নাকের কাছে নিজে একটা ঘুষি মেরে সামান্য রক্ত বের করবো। বাইরে দুজন কনস্টেবল আছে তাদের ডেকে বলবো, তোমরা সাক্ষী, কবি সাহেব ঘুষি মেরে আমার নাসিকা ফাটিয়ে দিয়েছেন। পুলিশ অফিসারের গায়ে হাত তুলেছেন, তোমরা সাক্ষী। আর কিছু লাগবে না, আপনি ফেঁসে গেলেন।
কবি হাসল। আপনি একটা জিনিস দেখছি। কথার ফাঁকে ফাঁকে সুন্দর শব্দও ব্যবহার করেন।
নাসিকা শুনে বললেন?
রাইট।
আপনি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা শোনালেন সকালবেলা। পুলিশ গাহিল রবীন্দ্রসঙ্গীত। এইসব কারণে চা খাওয়াকে চা পান করা বললাম, নাক না বলে বললাম নাসিকা। হা হা হা।
দুবার আপনাকে দেখে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আপনি আমার মতো। মাথায় ছিট আছে। ছিট খুপরি।
আমারও তাই ধারণা। তবে আপনার ভাই ভাবী কেউ আমাকে পছন্দ করেনি।
আপনি আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। ভাই ভাবীর কাছে জানতে চাইলাম, ওই তো সকালবেলা আপনার কাছে যা জানতে চেয়েছিলাম। কতদিন মেয়েটিকে টর্চার করা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। একটা জিনিস শুধু জানা হয়নি, মেয়েটির নাম কী? মা-বাবার নাম কী? বাড়ি কোথায়? ঠিকানাটা দিন অথবা মোবাইল নাম্বার থাকলে দিন, আমি ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করবো। একটা পর্যায়ে সাহস হারিয়ে ফেললাম। কারণ হচ্ছে একটি নাম। মোরশেদ হক।
ও মোরশেদ ভাই। তিনি ঢাকার পুলিশ কমিশনার।
জ্বি আমাদের বস। শুনলাম স্যার আপনার ভাইয়ের বন্ধু। তখনই ভেতরে ভেতরে সব গুবলেট হয়ে গেল। যা জানতে চাওয়ার তা মনেই এলো না। অবশ্য আমি যে নার্ভাস হয়েছি আপনার ভাই-ভাবীকে তা বুঝতে দেইনি। এজ ইফ মোরশেদ স্যার আমারও বন্ধু। হা হা। আপনার এখানে আসতে আসতে ভাবলাম আপনার কাছ থেকে জেনে নেব মেয়েটির নাম কী? ওর মা-বাবা ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেই ইত্যাদি ইত্যাদি আমি আপনাকে বলতে পারছি না। সরি।
পুলিশকে হেল্প করা নাগরিক দায়িত্ব!
আমি তাই করছি। সকালবেলাই রিপোর্ট লিখিয়ে এসেছি।
হায়দার গম্ভীর হল। ওটা আসল রিপোর্ট না। সাজানো নাটক।
আপনি একই কথা বলছেন।
যা সত্য তাই বলছি।
সত্য বুঝলেন কী করে?
অনুমানে। পুলিশদের অনুমান মিথ্যা হয় না। আমি প্রমাণ করে ছাড়বো কাণ্ডটা আপনাদের বাড়িতেই ঘটেছে। আপনার ভাই-ভাবীর সঙ্গে কথা বলেও তাই মনে হয়েছে আমার।
হায়দারের চোখের দিকে তাকিয়ে শীতল গম্ভীর গলায় কবি বলল, খাগড়াছড়ি যাবেন?
কমিশনার স্যারকে বলে ট্রান্সফার করিয়ে দেবেন?
যে রকম বিরক্ত করছেন, এছাড়া উপায় দেখছি না।
ওসব আমি কেয়ার করি না। যেখানে যাবো চুলবুল পাণ্ডে হয়েই যাবো।
হায়দার উঠলেন। চলুন দেখি কতটা ইনজিউরড মেয়েটিকে আপনারা করেছেন। বাই দ্যা বাই, মেয়েটির নাম…
জানি না।
আপনি বেশ কঠিন জিনিস দেখছি।
আইসিইউতে এসে মিনিট দুয়েক মেয়েটিকে দেখলেন হায়দার। কথা বললেন না, শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বেরিয়ে এসে কবিকে বললেন, এত সুন্দর মানুষ আপনারা তিনজন। মানে আপনার ভাই-ভাবী আর আপনি, এমন কি কাজের ছেলে রতনটাও সুন্দর, এত সুন্দর মানুষের ভেতরটা এত খারাপ? এইটুকু একটা মেয়েকে এভাবে মেরেছেন? না না আমি ভাবতেই পারছি না।
কবি আগের মতোই শীতল গলায় বলল, ভাবতে আপনি পারবেনও না। কারণ আপনি হচ্ছেন হিন্দি চুলের পুলিশ অফিসার।
হিন্দি চুলের অফিসার মানে? এটার তাৎপর্য তো বুঝলাম না।
একটু ভাবুন, ভাবলে বেরিয়ে যাবে।
না বুঝতে পারছি না।
আছেন ঘুষের ধান্দায়, বুঝবেন কী করে। হিন্দিতে চুলকে কী বলে?
এবার হায়দার প্রায় লাফিয়ে উঠলেন, বুঝেছি বুঝেছি। আরে অদ্ভুত আবিষ্কার তো!
আবিষ্কারটা আমার না।
তাহলে?
বাংলাভাষার একজন খুবই জনপ্রিয় লেখক জন্মেছিলেন আমাদের দেশে… …
জানি, হুমায়ূন আহমেদ।
জ্বি। এটা তাঁর আবিষ্কার। আপনি এবার আসুন।
সেটা আপনি না বললেও আসবো। কিন্তু মেয়েটার নাম, বাবার নাম, বাড়ির ঠিকানা অথবা মোবাইল নাম্বার! আজকাল ভিখিরিদের হাতেও মোবাইল থাকে। সেটা না থাকলেও পরিচিত কারও না কারও নাম্বার জরুরি দরকারে দিয়ে রাখে। ওরকম হলেও চলবে।
কবি আগের মতোই গম্ভীর গলায় বলল, আসুন।
ওকে বাই।
চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছেন হায়দার, কবি বলল, হুমায়ূন আহমেদের আরেকটা উদ্ধৃতি শুনে যান। এক পাগল কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে ট্রেনগুলোকে বলছে, লাইন মতন থাকিস বাবারা। বেলাইন হইস না। আপনিও লাইন মতো থাকবেন, নয়তো খাগড়াছড়ি। আমি মানুষের ক্ষতি করি না। আপনি বেশি বিরক্ত করছেন। আমাকে বাধ্য করবেন না আপনার ক্ষতি করতে।
কবি আর দাঁড়াল না।
দুই
মে আই কাম ইন স্যার।
রুনু সাহেব চোখ তুলে দরজার দিকে তাকালেন। আপনি তো ঢুকেই গেছেন।
হায়দার হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। পুলিশ তো স্যার, একটু ডেসপারেট ভাব আছে। বসবো?
বসুন।
হায়দার বসলেন। আপনি বোধহয় স্যার আমার ব্যাপারে আগে থেকেই ইনফরমড!
রুনু সাহেব ল্যাপটপে কাজ করছিলেন। ল্যাপটপ অফ করে বললেন, না। আপনার সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা নেই। কী নাম আপনার?
নাম বললেন হায়দার। কোন থানায় কোন পোস্টে আছেন তাও বললেন।
রুনু সাহেব বললেন, বুঝতে পেরেছি কেন এসেছেন।
বুঝবার কথা স্যার। আপনার মতো ব্রিলিয়ান্ট ডক্টর এই সামান্য ব্যাপার বুঝবেন না কেন?
ব্রিলিয়ান্ট ডক্টর বুঝলেন কী করে?
আপনার হসপিটাল আমার এলাকায়। আপনার সম্পর্কে সবই জানি।
থ্যাংকস। কফি খাবেন?
না স্যার। কবি সাহেবের রুমে চা খেয়েছি। আপনার এখানকার সবই ভাল। এমন কি চা-ও। ফাসকেলাস চা। আমি আবার স্যার চায়ের খুব ভক্ত। ঘন দুধের বেশি চিনি দেয়া চা পেলে পাগল হয়ে যাই। আমাদের গেণ্ডারিয়াতে, লোহারপুলের পুবদিককার ঢালে, আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের ঠিক উলটো দিকে ছিল সালাউদ্দিনের চায়ের দোকান। দোকানের সামনে বিশাল একটা কড়াইতে সারাদিন দুধ জ্বাল দিত সে। জ্বাল দিতে দিতে হলুদ করে ফেলতো। গরুর চর্বির মতো সর পড়তো। এলাকার কেউ কেউ চায়ের মধ্যে একটুখানি সর ভাসিয়ে খেতে ভালবাসতো। দোকানে ঢুকেই বলতো, য়েক কাপ চা। মালাই ভাসাকে। হা হা হা।
রুনু সাহেব হাসলেন না। বললেন, আপনি কি এখনও গেণ্ডারিয়াতে থাকেন?
না স্যার। পাস্ট টেনস।
বলুন, কাজের কথা বলুন।
পাঁচ দশ মিনিট সময় নেব যে!
আমি খুবই ব্যস্ত।
তা বুঝি স্যার। আপনার মতো ডক্টর, এত বড় হাসপাতালের চেয়ারম্যান, তিনি কি ব্যস্ত না থেকে পারেন! বিজনেস কেমন স্যার?
আছে আর কী!
এই হলো স্যার বড় ব্যবসায়ীদের কথা। ব্যবসা যত ভালই হোক কোনও দিনও বলবেন না ভাল হচ্ছে। হা হা হা।
রুনু সাহেব ভ্রু কোঁচকালেন। ব্যাপারটা খেয়াল করলেন হায়দার। অমায়িক ভঙ্গিতে বললেন, বিরক্ত হবেন না স্যার। আমি এভাবেই কথা শুরু করি। একটু লাইট মুডে। খানিক কথা বলার পরই বুঝতে পারবেন কীভাবে আসল কথায় ঢুকে গেছি।
খান, কফি খান।
আপনি যখন এত করে বলছেন, খাই।
রুনু সাহেব ফোন তুলে বললেন, দুমগ কফি।
আপনি স্যার খুবই হ্যান্ডসাম। মোম্বাইতে থাকলে অমিতাভ বচ্চন টাইপের ক্যারেক্টার করতে পারতেন। ভয়েসও সুন্দর। তবে অমিতাভের মতো অতটা পুরুষালি না।
রুনু সাহেব কথা বললেন না। ভেতরে ভেতরে বিরক্ত। হায়দার বুঝলেন, তোয়াক্কা করলেন না। নিজের ভঙ্গিতে হাসিমুখে বললেন, আমিও একসময় হ্যান্ডসাম ছিলাম স্যার। গেণ্ডারিয়ার মেয়েরা আমাকে খুবই পছন্দ করত। প্রথম প্রেমপত্র পেলাম ক্লাস নাইনে পড়ার সময়। জলি নামে একটি মেয়ে দিয়েছিল। পরির মতো সুন্দর মেয়ে স্যার। চিঠির সঙ্গে একটা ক্যাঙারুর ছবি। পত্রিকা থেকে কেটে পাঠিয়েছিল। পেটের থলি থেকে তিনটি বাচ্চা উঁকি দিয়ে আছে। অনেক পরে শুনেছি জলির বিয়ে হয়েছে এক কাপড়ের ব্যবসায়ীর সঙ্গে। বাচ্চা হয়েছে তিনটি। হা হা হা। ক্যাঙারুর মতো থলিতে তিন বাচ্চা নিয়ে সুখেই আছে সে।
বেয়ারা কফি নিয়ে ঢুকলো। অতিযত্নে এবং সাবধানে টেবিলে নামিয়ে রাখলো। যেমন নিঃশব্দে ঢুকেছিল তেমন নিঃশব্দেই বেরিয়ে গেল।
রুনু সাহেব কফি নিলেন। হায়দারের দিকে তাকিয়ে বললেন, নিন।
থ্যাংকস।
হায়দার কফিতে চুমুক দিলেন। আপনি খুবই গম্ভীর ধরনের লোক স্যার। গম্ভীর না বলে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বলা ভাল। কঠিন টাইপ।
কী করে বুঝলেন?
বোঝা যায়। আপনার বয় যেভাবে কফি নিয়ে ঢুকলো, খুবই নার্ভাস মনে হল তাকে। যেন যখন তখন কফি পড়ে যাবে হাত থেকে।
এই ধরনের প্রতিষ্ঠান চালাতে হলে কঠিন না হয়ে উপায় নেই। নানা ধরনের রোগী, রোগীর সঙ্গে আসা লোকজন হ্যান্ডেল করতে হয়।
হায়দার কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, আমার মতো প্যাঁচাল পাড়া পুলিশ অফিসার হ্যান্ডেল করতে হয়। হা হা। আপনি স্যার চব্বিশ ঘণ্টাই হাসপাতালে থাকেন নাকি?
মানে?
রাত হয়ে গেছে, এখনও আছেন।
এটা রাত না। সন্ধ্যা। মাত্র সোয়া আটটা বাজে।
তাও আপনার মতো লোকের এ সময় হাসপাতালে থাকার কথা না। আসেন কখন?
সকালে। সাড়ে নটার মধ্যে। বাড়ি কাছেই। একটার দিকে বাড়ি যাই। লাঞ্চ সেরে হাফ এন আওয়ার ন্যাপ নিই তারপর আবার হাসপাতাল। রাত দশটা পর্যন্ত থাকি।
তার মানে পার্সোনাল লাইফ বলে কিছু নেই?
রুনু কফিতে চুমুক দিলেন। ওই আর কি!
ম্যাডামও কি ডক্টর?
না, ওর সাবজেক্ট ইংরেজি লিটারেচার। একটা কলেজে পড়ান।
বাচ্চা কাচ্চা?
দুই ছেলে। বড় ছেলেটা আমেরিকাতে পড়তে গেল কিছু দিন আগে। এ লেবেল শেষ করেছে। ছোটটা সান বিমসে নাইনথ গ্রেডে পড়ছে।
আমারও স্যার দুই বাচ্চা। বড়টা মেয়ে, ছোটটা ছেলে। ছেলে পড়ে ধানমন্ডি হাইস্কুলে, মেয়ে ভিকারুননিসায়।
তারপর আচমকা বললেন, রবিউল হাসান সাহেব কি শুরু থেকেই এই হাসপাতালের ডিরেক্টর?
হ্যাঁ। আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে করেছিলাম।
বাকি তিনজন?
ডক্টর রিয়াজ আর ডক্টর করিম এই হাসপাতালেই বসেন। রবি আর মামুন বাইরে। দুজনই বড় ব্যবসায়ী।
কত টাকার প্রজেক্ট?
সাতশো কোটির মতো।
আপনাদের আরেক বন্ধু বোধহয় আমাদের কমিশনার স্যার।
কী করে জানলেন?
রবিউল স্যার বলেছেন। কবি সাহেব খানিক আগে ধমকালেন। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমাকে নাকি খাগড়াছড়িতে ট্রান্সফার করে দেবেন।
কবিটা একটু পাগলা টাইপের। ওর কথা ধরবেন না।
কিন্তু স্যার, আপনাদের মতো লোকের বাড়িতে যদি এই ধরনের ঘটনা ঘটে…
কফিতে চুমুক দিতে গিয়ে থতমত খেলেন রুনু সাহেব। মানে?
এই যে রবি সাহেবের বাড়িতে ছোট্ট একটা কাজের মেয়েকে টর্চার করে প্রায় মেরে ফেলল! আইসিইউতে মেয়েটিকে দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলাম না। কী নির্মম, নৃশংস ঘটনা।
রুনু সাহেব চোখ থেকে চশমা খুললেন। অবাক বিস্ময়ে বললেন, রবির বাড়িতে এই ঘটনা ঘটেছে? বলেন কী!
জ্বি স্যার।
আরে না না, মেয়েটিকে কীভাবে পাওয়া গেছে কবি আপনাকে বলেনি?
সকালবেলাই থানায় গিয়ে রিপোর্ট লিখিয়েছে, বলেছে সবই।
তাহলে?
ওটা স্যার বিশ্বাসযোগ্য না। বানোয়াট নাটক।
কী বলছেন আপনি?
ঠিকই বলছি স্যার। আমি ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম। গিয়েই যা বোঝার বুঝে গেছি। অবশ্য সকালবেলা কবি সাহেবের সঙ্গে কথা বলেই বুঝেছিলাম। ঘটনা কীভাবে ঘটেছে অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি। সিকোয়েন্স ওয়াইজ নাটক সাজিয়েও দিয়েছি রবি সাহেবকে।
না না এ হতে পারে না। রবিরা ওরকম না। ওরা খুবই নরম ধরনের পরোপকারী মানুষ। কবির স্বভাব গল্প উপন্যাস নাটক সিনেমার পরোপকারী নায়কদের মতো। লাখ লাখ টাকা মানুষের কল্যাণের জন্য ওরা খরচা করে। ওদের বাড়িতে এই ধরনের ঘটনা ঘটলে আমি জানতে পারতাম। ওই বাড়িতে এরকম কাজ করার কেউ নেই। জয়াভাবী অসাধারণ মানুষ। না না ওই বাড়িতে এসব ঘটতেই পারে না। আমি বিশ্বাস করি না।
মানুষের বিশ্বাসের বাইরেও অনেক কিছু ঘটে। একসঙ্গে বহুদিন থাকার পরও পরস্পরকে ঠিকঠাক চিনতে পারি না আমরা। একটু ফিলোসফি হয়ে গেল। কিছু মনে করবেন না।
কিন্তু আপনি এত নিশ্চিত হয়ে বলছেন কী করে?
সকাল থেকে এ পর্যন্ত ব্যাপারটা নিয়ে গবেষণা করেছি। রবি সাহেবের বাড়িতে গেলাম, হাসপাতালে এসে আবার কবি সাহেবের সঙ্গে কথা বললাম। পুলিশি সন্দেহ বলে একটা কথা আছে। সেই সন্দেহ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সত্য হয়।
এক্ষেত্রে হবে না। আমি এক্ষুনি কবিকে ডেকে আনছি, রবির সঙ্গে কথা বলছি।
ওসব আমি চলে যাওয়ার পর করলেও অসুবিধা নেই। আপনার বন্ধু সম্পর্কে যেটুকু জানার ছিল তা ইতোমধ্যেই আপনি বলে ফেলেছেন। আমি স্যার ইতিমধ্যে বলি না। আজকাল খবরের কাগজে ইতোমধ্যে লেখা হয়। ভাষাটা স্যার ভাল রাখতে চাই। সম্বলিতও বলি না, বলি সংবলিত। হা হা হা।
রুনু সাহেব গম্ভীর।
হায়দার বললেন, মেয়েটির অবস্থা খুবই খারাপ দেখলাম স্যার। তবে এত দামি হসপিটালের আইসিইউতে রাখা হয়েছে, আপনার মতো ডক্টর টেককেয়ার করছেন, আশা করি প্রাণ ফিরে পাবে।
আমিও তাই আশা করি। এবং আপনার উচিত মেয়েটির জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করা। যাতে ওর মুখ থেকে সব জানতে পারেন।
সকালবেলা কবিকে যে যুক্তি দিয়েছিলেন হায়দার, তাদের বাড়িতে গিয়ে রবি এবং জয়াকে যে যুক্তি দিয়েছেন, রুনু সাহেবকেও একই যুক্তি দিলেন। নিজের মনগড়া নাটক যেভাবে সাজিয়েছিলেন সেভাবে সাজিয়ে বললেন। শুনে ফ্যাল ফ্যাল করে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন রুনু সাহেব। খুলে রাখা চশমা পরে বললেন, এ হতেই পারে না।
কেন হতে পারে না?
বললাম না রবির বাড়িতে এই কাণ্ড হলে আমি জানতাম।
কীভাবে জানবেন? কাজের মেয়েকে টর্চার করার কথা বন্ধুকে কেউ বলে?
তা বলে না। তবে আমি ছেলেবেলা থেকে ওদেরকে চিনি। ওরা এরকম মানুষই না।
ওই যে আমি বললাম, কাছাকাছি থেকেও পরস্পরকে চেনা কঠিন। একসঙ্গে দীর্ঘদিন সংসার করার পরও স্বামী পুরোপুরি চিনতে পারে না স্ত্রীকে, স্ত্রী চিনতে পারে না স্বামীকে।
রুনু সাহেব মহাবিরক্ত। রাখুন ভাই আপনার এসব কচকচানি। যতই এসব বলুন, আমি বিশ্বাস করবো না। আমরা মেয়েটির ট্রিটম্যান্ট করছি, সে ভাল হউক, তার সঙ্গে কথা বলে সব জানুন।
আর যদি সে ভাল না হয়? যদি মারা যায়?
রুনু সাহেব থতমত খেলেন।
হায়দার বললেন, মারা গেলে তো সবই শেষ হয়ে গেল! তখন কী করে আসল ঘটনা বের করবো! নাকি তখন ঘুষ দিয়ে আমাকে ম্যানেজ করাবেন।
আপনি ঘুষ খান?
খাই মানে? ঘুষই আমার প্রধান খাদ্য।
বুঝেছি।
কী বুঝলেন?
টাকা পয়সা খাওয়ার জন্যই এই লাইন ধরেছেন।
কমিশনার সাহেবের সঙ্গে কথা বলবেন?
আপনি বেশি বাড়াবাড়ি করলে বলতে হবেই।
বাড়াবাড়ি আমি করছি না, আসল ঘটনা উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছি।
কী চেষ্টা করছেন? যে ছেলে মেয়েটিকে বাঁচাতে চাইছে তার পরিবারকে আপনি চাইছেন ফাঁসাতে! এটা কী ধরনের কথা! আমার সামান্য জ্ঞানে বুঝি মেয়েটি যে স্পটে পড়েছিল তার আশেপাশে খোঁজখবর করা। কে বা কারা ফেলে গেল, নাইটগার্ডদের কেউ বা পথচারী কেউ দেখেছে কিনা, ওদিককার বাড়ির কোনও দারোয়ান বা সিকিউরিটির লোক দেখেছে কিনা, কী ধরনের গাড়ি করে এসেছিল মেয়েটিকে নিয়ে, নাকি রিকশা নিয়ে এল, রাত কটার দিকে ফেলে গেল এসব খোঁজখবর করে আসল ঘটনা বের করা। তাছাড়া আপনাদের পুলিশি সূক্ষ্ম কায়দাও তো আছে। নানাভাবে আপনারা আসল ক্রিমিনাল আইডেনটিফাই করেন। ওসব না করে ভুল পথে আপনি এগোচ্ছেন। টাকা খাওয়ার ধান্দা করছেন। যদি এই মতলবই আপনার হয়ে থাকে তাহলে আমি পরিষ্কার বলছি, সুবিধা হবে না।
টাকা পয়সা খাওয়া যাবে না?
না।
খুবই হতাশ হলাম স্যার। তবে খুশি হলাম এই ভেবে যে পুলিশি ইনভেস্টিগেশনের পদ্ধতি আপনি ভালই জানেন। মুভি দেখেন কখন?
মানে?
একদম সিনেমার কায়দায় সাজিয়ে দিলেন কীভাবে এগোলে আসল ক্রিমিনাল আমি ধরতে পারব। সিনেমাতে এভাবেই হয়।
আপনি এখন আসুন।
হায়দার উঠলেন। হাসিমুখে বললেন, সকাল থেকে চারবার এই কেসটা নিয়ে কথা বললাম। দুবার কবি সাহেবের সঙ্গে, একবার রবি সাহেব জয়া ম্যাডাম আর এখন আপনি। এতটা সময় অপচয় ওইটুকু একটা হেজিপেজি মেয়ের ব্যাপারে করার সময় আমার মতো পুলিশ অফিসারের থাকে না। তারপরও করলাম। কাজের কাজ কিছুই হলো না। একটা পয়সাও ঘুষ খেতে পারলাম না। এমন ব্যর্থতা আমার জীবনে নেই স্যার।
হায়দার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কী আর করা। যাই স্যার। আমার জন্য একটু দোয়া করবেন, যেন ভাল রকম একটা ঘুষ আপনাদের কাছ থেকে খেতে পারি। পুলিশি চাকরিতে এখনও কোনও উন্নতি করতে পারিনি। আমার সঙ্গের অফিসাররা সবাই বউর নামে ফ্ল্যাট গাড়ি কিনে ফেলেছে, আমি স্যার একটা রিকশাও কিনতে পারিনি। বাচ্চা দুটো ভাল স্কুলে পড়ে তাদের যোগ্যতায়। দুজনই ভাল ছাত্র। আমার স্ত্রীরতœটি পণ্ডিত টাইপের। মাস্টার্স করেছে ম্যাথমেথিকসে। ছেলেমেয়ে দুটোকে সে-ই পড়ায়। কোনও টিচার, কোচিং কিচ্ছু নেই, তাও ভাল রেজাল্ট করে ওরা। আমার খরচের মধ্যে বড় খরচ সিগ্রেট। খারাপ সিগ্রেট খেতে পারি না। বেনসানটা খাই। দিনে এক প্যাকেট। মাসে পাঁচ সাড়ে পাঁচ হাজার যায়। বেতন পাই কটাকা বলুন! আজকালকার বাজারে ওই বেতনে চলা যায়? আপনিই বলুন স্যার।
রুনু সাহেব চরম বিরক্ত গলায় বললেন, ভাই, আপনার লাইফ স্টোরি শোনার টাইম নেই আমার। আপনি আসুন। খুব খুশি হবো আমাকে আর বিরক্ত না করলে।
কথা দিতে পারছি না স্যার। সরি।
হায়দার মন খারাপ ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন। তারপরই বন্ধুকে ফোন করলেন রুনু সাহেব। হ্যালো, রবি।
হ্যাঁ বল।
ঘটনা কী রে?
ওই ফাজিল পুলিশ অফিসারটা তোর কাছেও গিয়েছিল?
হ্যাঁ। এইমাত্র বিদায় হলো। মহাবিরক্তিকর জিনিস।
কী বলল?
তোদেরকে সন্দেহ করছে।
তা জানি। নাটক কীভাবে সাজিয়েছে বলেছে?
হ্যাঁ।
টাকা পয়সার ধান্দা।
তা বুঝেছি। পুলিশ তো দেখি মানুষের উপকারও করতে দেবে না! যে উপকার করবে উলটো তাকে ফাঁসাবে!
কবির ওপর আমার খুব বিরক্ত লাগছে।
কেন?
কী দরকার ছিল এই ঝামেলার?
অদ্ভুত কথা বলছিস! তুই একটা হাসপাতালের ডিরেক্টর। মানুষ বাঁচাবার জন্যই হাসপাতাল করেছি আমরা। সেখানে চোখের সামনে মৃতপ্রায় একটা মানুষকে দেখেও বাঁচাবার চেষ্টা করবো না! কবি তো ঠিক কাজটাই করেছে।
রবি হাসলো। কিন্তু বন্ধু আমাদের হাসপাতালটা সব ধরনের রোগীর চিকিৎসার জন্য না। যে মেয়েটিকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে আমার গুণধর ভাই, সেই মেয়েকে এত দামি হাসপাতালে না তুললেও পারতো। কোনও সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলেই হতো।
এটা অন্য কথা। নিয়ে যখন এসেছেই, প্রপার ট্রিটম্যান্ট আমরা করবো। তাছাড়া একজন ডিরেক্টরের পেসেন্ট, সে তার হাসপাতালেই আনবে।
কী বোকার মতো কথা বলছিস! আমার পেসেন্ট কোথায় দেখলি! কবির পাগলামো।
রুনু সাহেব হাসলেন। কবিও এই হাসপাতালের ডিরেক্টর।
মানে?
তোর ইনভেস্টম্যান্টের অর্ধেকের মালিক সে।
রবি হাসল। ও সেই অর্থে!
তো?
যাহোক পাগলটা যা নিয়ে থাকে থাক। রোগীর অবস্থা কী?
এখনও বুঝতে পারছি না। আচ্ছা শোন, ওই ফাজিল পুলিশ অফিসারটিকে তো থামাতে হয়।
হ্যাঁ। ভাব দেখে মনে হচ্ছে জ্বালাবে।
মোরশেদের সঙ্গে কথা বলবি?
বলা উচিত। চল দুজনেই বলি। তুই তোর মতো বল, আমি আমার মতো বলছি।
ঠিক আছে এখনই ফোন কর। আমি রাউন্ড সেরে আসি, তারপর আমি করবো।
রুনু সাহেব ফোন অফ করলেন।
তিন
এটা কি নয়ন সাহেবের নাম্বার?
ওপাশ থেকে নয়ন বলল, জ্বি। কে বলছেন?
আমি আপনার পুরনো দিনের একজন বন্ধু।
কী নাম?
কবিরুল হাসান।
আপনার কি কোনও ডাকনাম আছে?
জ্বি আছে।
দয়া করে বলবেন?
কবি নির্বিকার গলায় বলল, পাছায় লাথি মারবো শালা।
নয়ন হা হা করে উঠল। ছি ছি, এ কী ভাষা!
আমার সঙ্গে ভাষা মারাচ্ছ!
আপনি ভাই বাংলা সাহিত্য পড়া মানুষ, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কথা বলেন না, একবার ভাবুন তো, এই ভাষা আপনাকে মানায়! আমরা জার্নালিজম পড়া মানুষ, পেশায় জার্নালিস্ট, হাজার রকমের মানুষ হ্যান্ডেল করে অভ্যস্ত, কত খারাপ ভাষা কত মানুষের মুখে শুনি, কিন্তু আপনার মতো এত খারাপ ভাষা বাপের জনমে শুনিনি।
বাপের জনমে শুনিসনি, বন্ধুর জনমে শোন।
আশ্চর্য ব্যাপার, আমি আপনাকে আপনি আপনি করে বলছি আর আপনি তুই তোকারি করছেন! আপনাকে ভদ্র পরিবারের সন্তান হিসাবে জানি, হঠাৎ এরকম অসভ্য হয়ে গেছেন কেন? গুঁড়া কৃমি হয়েছে?
তোর পাছায় সত্যি লাথি মারব।
শরীরের এত জায়গা থাকতে ওই জায়গাটিই আপনি লাথি মারার জন্য বেছে নিচ্ছেন কেন?
তোর ওখানে গোস্ত বেশি। লাথি মারলে পায়ে আরাম হবে।
পায়ের আরামের জন্য বন্ধুর ওখানে কেউ লাথি মারে আজকের আগে কখনও শুনিনি।
এক মুহূর্ত থামলো নয়ন তারপর বলল, এতদিন পর হঠাৎ ফোন। ঘটনা কী বস?
আছে বড় ঘটনা আছে।
তা জানি।
কী করে জানলি?
ঘটনা না থাকলে তুই আমাকে ফোন করতি না।
না বন্ধু এটা একদম ঠিক না।
এটাই ঠিক। আমার মনে পড়ে না তুই কোনও দিন আমাকে ফোন করেছিস। সব সময় আমিই ফোন করে তোর খবর নেই।
জানিসই তো ফোন করার অভ্যাস আমার নেই। কিন্তু তুইও অনেকদিন ফোন করিসনি।
ইচ্ছা করে করিনি।
হঠাৎ এরকম ইচ্ছা কেন হলো বন্ধু?
অভিমান।
বলিস কী! তোর আবার অভিমানও আছে?
না আমি তো মানুষ না, অভিমান আমার থাকতে পারে না!
কেন বন্ধু, অভিমান কেন? কী করলাম আমি?
কতদিন তোর সঙ্গে কথা হয় না জানিস?
মনে হয় মাস তিনেক হবে।
আরে না ব্যাটা, চার মাসের বেশি।
এতদিন তুই আমাকে ফোন না করে পারলি?
উলটো আমার দোষ দিও না চান্দু। আমি এবার দেখলাম আমি ফোন না করলে তুই করিস কি না। দিনের পর দিন বোনের বাড়িতে শুয়ে অপেক্ষা করেছি, আমার সেই অপেক্ষা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
আরে বাপরে! বাংলা সাহিত্য পড়লাম আমি আর পর্যবসিত মারাচ্ছ তুমি! কিন্তু বন্ধু, বোনের বাড়িতে শুয়েছিলে কেন?
অ্যাকসিডেন্ট করেছিলাম।
বলিস কী?
হ্যাঁ।
এবার আবার কি ভাঙলি?
কলার বোন।
রিয়েলি?
রিয়েলি।
কী করে?
শোনার সময় আছে তোর?
কী আশ্চর্য, জীবনে এই প্রথমবার আমি তোকে ফোন করেছি। সময় আছে বলেই তো করেছি।
বুঝলাম।
তুই এখন কোথায়?
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়।
ওখানে কী করিস?
এ্যাপোলো হসপিটালসের পেছনে আমার মতো গরিব-দুঃখিদের জন্য একটা চায়ের দোকান আছে। ওখানে বসে এককাপ চা মেরেছি। এখন সিগ্রেট টানছি। সঙ্গে দুজন কলিগ আছে।
কোথাকার কলিগ? কালের কণ্ঠ?
হ্যাঁ।
তার মানে তুই এখনও কালের কণ্ঠে আছিস?
তোর কী মনে হয়?
আমি ভেবেছি তুই এখন আর কালের কণ্ঠে নেই। এক জায়গায় মাস ছয়েকের বেশি চাকরি করার অভ্যাস তোর নেই।
আছে। কালের কণ্ঠে প্রায় চার বছর হয়ে গেল।
শুনে মন খারাপ হলো।
কেন?
তোর চরিত্র বদলে গেছে। ঘন ঘন চাকরি না বদলালে তোকে মানায় না।
না বন্ধু, কালের কণ্ঠের পরিবেশ খুবই ভাল। তাছাড়া বসুন্ধরা গ্র“পের পত্রিকা, দেখার মতো অফিস, বেতন বেশি, নানান সুবিধা। এই জায়গা ছেড়ে জীবনেও যাবো না। এই পরিবেশ ছেড়ে যাবো না। কিন্তু তুই এত খেজুড়ে আলাপ করছিস কেন? আছিস কোথায়?
হাসপাতালে।
নয়ন চমকালো। মানে?
হাসপাতালে আছি।
কেন? কী হয়েছে?
আমার কিছু হয়নি। হয়েছে দশ এগারো বছরের একটি মেয়ের। নাম জানি না। তার জন্য ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে বসে আছি।
কী ঘটনা বল তো?
ঘটনা বলার জন্যই তোকে ফোন করলাম। তুই কি এখন ফ্রি আছিস? কথা বলা যাবে?
হ্যাঁ আজকের মতো কাজ শেষ করে বেরিয়েছি। চা খেয়ে বাসায় যাবো।
সুবাস্তু নজর ভ্যালিতেই আছিস?
না বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় চলে এসেছি। চমৎকার খোলামেলা পরিবেশে থাকি। এরকম পরিবেশ ঢাকা শহরে নেই। মনে হয় আমেরিকার ছোট্ট সুন্দর ছবির মতো কোনও শহরে আছি। চারদিকে গাছপালা, পাখির ডাক, কাঁশবন। আহা। বেঁচে থাকা বড় আনন্দের।
আচ্ছা এক কাজ কর, আগে তোর অ্যাকসিডেন্টের ঘটনাটা বল। এবার আবার কী ঘটলো? তোর তো হাড় ভাঙাভাঙি ছাড়া কোনও কাজই নেই দেখছি।
ঠিকই বলেছিস। সাত বছর আগে ঈদের পরদিন মগবাজারে গেছি এক বড়ভাইর সঙ্গে দেখা করতে। খুবই ফুরফুরে মেজাজে দেখা করে বেরিয়েছি। চৌরাস্তার মোড়ে এসে দেখি ভেসপায় পাঁচ বাচ্চা নিয়ে হেলেদুলে চলেছেন এক মদন পাল। আমি একটু স্পিডে ছিলাম, ওই শালা ভেসপা ম্যানেজ করতে পারছিল না। শালা একা থাকলে ওর ওপর দিয়ে মোটরবাইক চালিয়ে দিতাম। বাচ্চাগুলো ছিল বলে হার্ডব্রেক করলাম। দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম ঠিকই, পেছন থেকে অটোরিকশা এসে মেরে দিল। কপাল খারাপ থাকলে যা হয় আর কি! বাইক নিয়ে উল্টে পড়লাম। বাঁ-হাতের বাহুর কাছ থেকে তিন জায়গায় ফ্রাকচার হলো। ট্রোমা সেন্টারে থাকলাম সতেরো দিন।
মনে আছে। আমি একদিন তোকে দেখতে গিয়েছিলাম। যেদিন গেলাম তার পরদিন তোর অপারেশন হল। রড স্ক্রু লাগিয়ে দিল। তোর বাঁ-হাত আয়রন হ্যান্ড হয়ে গেল।
কী দুর্ভাগ্য দেখ এবারও ঠিক বাঁ-দিকের কলার বোনই ভাঙল।
তুই বামপন্থি হয়ে গেছিস। কিছু করার নেই। এবার কাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে মারাটা খেলে বন্ধু?
এবার আর কাউকে বাঁচাতে যাইনি। ভাল একটা চক্করে পড়েছিলাম।
বল, শুনি।
দাঁড়া আরেক কাপ চায়ের কথা বলি।
কবি ফোনেই শুনতে পেল দোকানীকে চায়ের কথা বলল নয়ন। মামা, আরেক কাপ চা লাগান। তারপর কবির দিকে মন দিল। আমি গিয়েছিলাম বোনের বাসায়।
তার আগে একটা কথা বল। চায়ের দোকানদারকে মামা ডাকিস নাকি?
হ্যাঁ। আজকাল মামা ডাকটাই চলছে। কলেজ ইউনিভার্সিটি, স্কুলের ছেলেমেয়েরা মামা ডাক চালু করে দিয়েছে।
এই ধরনের লোককে আমি ডাকি চাচা।
এখন থেকে মামা ডাক।
ঠিক আছে ডাকলাম। আচ্ছা মামা বলো, তোমার অ্যাকসিডেন্টের কথা বলো।
আমাকে দিয়েই শুরু করলি?
হাতের কাছে এখন আর কেউ নেই। এই জন্য তোকে দিয়েই প্র্যাকটিস শুরু করলাম। বলো মামা।
তুই তো জানিস আমি আমার বোনটাকে খুবই ভালবাসি। বিয়ে হয়ে গেছে, দুটো বাচ্চা তবু বোনটা আমার কাছে বড় হয়নি। বরটা খুবই ভাল। ভাগ্নে ভাগ্নি দুটো আমার জন্য পাগল। মা বাবা বরিশালে, গ্রামের বাড়িতে। বড়ভাই বাড্ডায় তাঁর ফার্নিচারের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত, আমি আমার সাংবাদিকতা নিয়ে ব্যস্ত, বসুন্ধরা জি ব্লকে ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকি। বুয়া সকালবেলা এসে রান্না করে দেয় ওই দিয়ে তিনবেলা চালিয়ে দেই।
তোমার জীবন কাহিনী আমি জানি। অ্যাকসিডেন্টের কথা বল শালা।
নয়ন হাসল। যে কোনও ঘটনার একটা ভূমিকা থাকে ব্যাটা। ভূমিকা দিচ্ছি। তুই বিরক্ত হলে ফোন রেখে দিই। পরে বলবো।
এই হল তোর এক দোষ, কথায় কথায় সেন্টিম্যান্টাল হওয়া।
না দোস্ত, সেন্টিম্যান্টাল হইনি।
তাহলে বল।
আমার সেদিন ডেঅফ ছিল। বুয়াকে ছুটি দিয়েছি। কারণ ডেঅফের দিন আমি বোনের বাসায় চলে যাই। দুপুরে খেয়েদেয়ে ভাগ্নে ভাগ্নির সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি, টিভি দেখেছি। বিকেলবেলা চা ফা খেয়ে বেরিয়েছি ধানমণ্ডির দিকে যাবো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। আমার সঙ্গে কাজ করে আকাশ নামে একটা ছেলে। আমি একটা পাতা করি শুভসংঘ নামে, ওই পাতায় আমাকে এ্যাসিস্ট করে। মাত্র বাইক স্টার্ট দিয়েছি, আকাশ ফোন করলো। নয়ন ভাই, আপনি কোথায়? বললাম, মগবাজারে। আমি আছি ইস্কাটনে। আমাকে একটু নিয়ে যান। একা যেতে সাহস পাচ্ছি না। অবাক হলাম। সাহস পাচ্ছো না কেন? কী সমস্যা? সঙ্গে আড়াই লাখ টাকা আছে। হ্যাভারস্যাকে টাকা নিয়ে লেডিস ক্লাবের উল্টো দিককার ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছি। বাসায় যাবো। আপনি আমাকে একটু পৌঁছে দিন।
কবি বলল, ওই ছেলে এত টাকা পেল কোথায়?
পরে জানলাম ওর ছোটভাইয়ের মোটর বাইক বিক্রি করেছে।
আচ্ছা বল, তারপর?
গেলাম ইস্কাটনে। ওকে বাইকে বসিয়ে ভাবলাম আগে আড্ডা দেই তারপর আকাশকে পৌঁছে দেব। আকাশও আড্ডাবাজ ছেলে। সেও রাজি। বাইক আছে সঙ্গে, অসুবিধা কী! ওদের বাসা আগারগাঁও। একটানে পৌঁছে দিয়ে আমি চলে যাবো বসুন্ধরায়। ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর রোডের পেছন দিকে, আহসানউল্লাহ মিশনের গলিটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনের রাস্তা দুদিক থেকে বন্ধ দেখে ওই গলিতে ঢুকলাম। হঠাৎ দেখি পেছনে একটা বাইক, সামনে আরেকটা, পেছনের বাইকে তিনটি অল্প বয়সী ছেলে, সামনেরটায় দুজন। এইসব ছেলেপুলে এখন সব জায়গায়ই থাকে। ওই নিয়ে কে মাথা ঘামায়…
কবি আচমকা বলল, চা সিগ্রেট দুটোই চালাচ্ছো নাকি?
কী করে বুঝলি?
তোমাকে আমি চিনি না ভেবেছ? এক মিনিট ধর, আমি একটু গ্রীন টি বানাই।
হাসপাতালে গ্রীন টি!
আমি আছি ভিআইপি রুমে। এখানে সব ব্যবস্থা আছে। শুনে খুবই খুশি হবে, বন্ধুর গৌরবে গৌরবান্বিত হবে। ফ্রেন্ডশিপ হসপিটালের আমি একজন ছোটখাটো ডিরেক্টর। আমার ইনভেস্টম্যান্ট মাত্র বিশ কোটি!
নয়ন বোধহয় চা খেতে গিয়ে বিষম খেল। বলিস কী? চরিত্র বদলে ফেলেছিস নাকি! ভাদাইমাগিরি ছেড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন দিচ্ছিস!
আরে না ব্যাটা। আমার ভাই চল্লিশ কোটি ইনভেস্ট করেছে। তার সবকিছুর অর্ধেকের মালিক যেহেতু আমি…
নয়ন নিভে গেল। বুঝছি। গ্রীনটি রেডি।
প্রায়। ফ্লাস্ক থেকে মগে গরম পানি নিয়ে টিব্যাগ ভিজিয়েছি। তুই চালিয়ে যা।
তারপর হলো কী, পেছনের বাইকটা ডানদিক দিয়ে আমাকে কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে বাম্পারে লাগিয়ে দিল। এমনভাবে লাগলো, আমি উপুড় হয়ে পড়লাম রাস্তায়। বুকে এমন চাপ লাগলো, দেখি দম ছাড়তে পারছি না। আকাশ ছিল পেছনে, তারও লেগেছে, তবে সামান্য। ততক্ষণে সামনের মোটর বাইকের ছেলেগুলোও নেমেছে। আমার চারপাশে বেশ একটা ভিড়। আকাশ তার নিজের ইনজুরি নিয়ে ব্যস্ত। যে ছেলেটা আমাকে ধাক্কা দিয়েছে সে এসে বলল, ওঠেন ভাই ওঠেন। আমার হাত ধরেন। বলেই আমার হ্যাভারস্যাক ধরে আচমকা এমন একটা টান দিল, পটাস করে বাঁদিককার কলার বোন ভেঙে গেল।
তার মানে অ্যাকসিডেন্টে তোর কিছু হলো না, কলার বোন ভাঙলো ওই ছেলের হ্যাচকা টানে!
হ্যাঁ।
কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কী!
না রে, কপাল খারাপ না। হ্যাভারস্যাক ওভাবে টান দেয়ার অর্থ তুই বুঝিসনি।
কবি চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে চমকালো। তার মানে ওরা প্ল্যান করে… …
হ্যাঁ ছিনতাইকারী। বিরাট চক্র। ওই চক্রে মেয়েও আছে।
বলিস কী?
শোন। ওই অবস্থায়ও ঘটনা কিন্তু আমি বুঝে গেছি। বুঝেই পুলিশ পুলিশ বলে চিৎকার শুরু করেছি। আকাশ ফোন করলো আমার অফিসে। আমাদের এডিটর, অ্যাডভাইসারি এডিটর, এক্সিকিউটিভ এডিটর সবাই ব্যাপারটাকে খুবই সিরিয়াসলি নিলেন। ক্রাইম সেকশানের হেড ধানমন্ডি থানায় ফোন করে দিলেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পুলিশ এলো। তখন ওই গ্র“পের প্রায় তিরিশ-পঁয়ত্রিশজন ছেলেমেয়ে আমার পাশে। প্রত্যেকের পরনে টি-শার্ট জিন্স, মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি কারও কারও। অল আর ভেরি স্মার্ট। পুলিশ আসার পরও তারা নড়লো না। অর্থাৎ ওরা যে ভাল ছেলে সেটা প্রমাণের চেষ্টা। দুজনকে পুলিশ ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে অন্যরা বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে লাগলো। বড় বড় লোকজনের তদবির আসতে লাগলো পুলিশের কাছে। পুলিশ অফিসার কঠিন টাইপের লোক। কারও কথাই শুনলেন না। দুটোকে থানায় নিয়ে গেলেন। আমাকে পৌঁছে দিলেন ট্রোমা সেন্টারে। কলার বোন ভাঙার ট্রিটম্যান্ট সেই অর্থে নেই। অর্থাৎ প্লাস্টার করা যায় না। অপারেশান খুবই জটিল। সহজ চিকিৎসা হচ্ছে যেদিককার বোন ভেঙেছে সেই দিককার হাত ব্যাগের মতো একটা জিনিস দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়া। মাস তিনেক লাগে ভাল হতে। তবে থাকতে হয় খুব সাবধানে। নড়াচড়া তেমন করা যাবে না। ধরে শুইয়ে দিতে হবে, ধরে ওঠাতে হবে। টয়লেট ফয়লেটে মহাযন্ত্রণা। আর একটু নড়াচড়া হলেই ভাঙা হাড় একটার সঙ্গে আরেকটা খট করে লাগে। ব্যথায় জান বেরিয়ে যায় দোস্ত।
কবি চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, তোরও ব্যথা লেগেছে?
লাগবে না!
না-ও লাগতে পারে।
কেন?
তুই তো হাড় ভাঙায় অভ্যস্ত।
নয়ন হাসল। ফান করো না। হাড় তো কখনও ভাঙেনি, ভাঙলে টের পেতে কত ধানে কত চাল।
কবি নির্বিকার গলায় বলল, বেশ লম্বা কাহিনী। আরও আছে, না শেষ?
একটু আছে।
তাড়াতাড়ি শেষ কর।
আসল ঘটনা হয়েছে আমাদেরকে ওরা ইস্কাটন থেকেই ফলো করছিল। আকাশ যখন ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলছিল তখন ওদের দলের কেউ ওখানে ছিল। সে ফোনে ইনফর্ম করেছে।
তাহলে আকাশের ব্যাগ ধরে টান দিল না কেন?
এখানেই গণ্ডগোলটা হয়েছে। যেহেতু আমি বাইক চালাচ্ছি, আমার চেহারা সুরৎ ভাবভঙ্গি ভাল, ভেবেছে টাকা আমার ব্যাগে।
তাই বল। যে দুজন ধরা পড়লো ওরা স্বীকার করেছে?
আরে না। ওদের পেছনে পাওয়ারফুল লোকজন আছে। তাঁরা থানায় বলে দিয়েছেন কম্প্রোমাইজ করতে। সেকেন্ড অফিসার বিশ হাজার টাকায় কম্প্রোমাইজ করিয়ে দিলেন। আমাকে বোঝালেন কেসটেসের ঝামেলায় গিয়ে লাভ নেই ভাই। কম্প্রোমাইজ করে ফেলেন। আপনি সাংবাদিক মানুষ, নিজের পেশা বাদ দিয়ে দেখা গেল থানায় দৌড়াচ্ছেন, কোর্টে দৌড়াচ্ছেন। দিনের পর দিন ডেট পড়ছে। বিরাট ঝামেলা। ঝামেলায় না জড়িয়ে মিটিয়ে ফেলেন।
ধানমন্ডি থানার সেকেন্ড অফিসার হায়দার হোসেন না?
হ্যাঁ। চিনিস নাকি?
তাঁর সঙ্গে আজ আমার দুবার দেখা হয়েছে।
তাই নাকি? ভাল লোক। সুন্দর করে কথা বলেন।
হ্যাঁ। মাল তো আমার জান খেয়ে ফেলল। মেয়েটিকে নিয়ে নিজে নিজেই ভাল নাটক সাজিয়েছে। আমাদেরকে ফাঁসাবার চেষ্টা।
আচ্ছা। বল তো আমাকে?
পুরো ঘটনা নয়নকে বলল কবি। হায়দারের কথা শুনে খুবই অবাক হলো সে। এই লোক সম্পর্কে আমার ধারণা হয়েছে উলটো। সুন্দর করে কথা বলেন। মুখটা হাসি হাসি।
তা ঠিক, কিন্তু কথায় কথায় বলে ঘুষই আমার প্রধান খাদ্য। তোর ওই কেস থেকে কত খেয়েছে দেখ গিয়ে। এক দুই লাখে রফা করে তোকে বিশ হাজার ধরিয়ে দিয়েছে।
অবিশ্বাস্য লাগছে। আমি সাংবাদিক মানুষ, আমার সঙ্গেও এমন করবে! পুলিশ চেনা মুশকিল বন্ধু। সোনারুদের সম্পর্কে শুনেছি চান্স পেলে মায়ের গহনা থেকেও দুএক ভড়ি মেরে দেয়। দর্জিদের স্বভাবও একই রকম। পুলিশও একই রকম।
কবি আবার চায়ে চুমুক দিল। হইছে, বুঝছি। পুলিশ নিয়ে আলোচনার দরকার নেই। তোর কলার বোনের দাম বিশ হাজার টাকা, না?
নয়ন হাসলো। তাই।
আমি তোকে চল্লিশ হাজার দেবো। কাল সকালে আয়।
ডানদিককার কলার বোন ভেঙে দিবি?
হ্যাঁ।
আসবো। টাকা পয়সার দরকার আছে।
কবি আবার চায়ে চুমুক দিল। আমি এখন সিরিয়াস। মন দিয়ে আমার কথা শোন। মেয়েটিকে নিয়ে খুবই বিব্রতকর অবস্থায় আছি। একদিকে তাকে বাঁচাতে পারবো কি না ওই নিয়ে টেনশন অন্যদিকে হায়দার হোসেনের যন্ত্রণা। কারা মেয়েটির এই অবস্থা করেছে, বাড়িঘর কোথায়, মা বাবা কোথায় এসব না বের করতে পারলে ভাল ঝামেলা হবে। তোর হেল্প দরকার।
নয়ন বলল, কী করতে হবে বুঝে গেছি। তুই টেনশান নিস না। আমি দেখছি।
কবি কথা বলার আগেই দরজায় টুকটুক করে শব্দ হল। ফোন কানে রেখেই সে বলল, কাম ইন। সঙ্গে সঙ্গে রুমে ঢুকলেন জয়া। ভাবীকে দেখেই উঠে দাঁড়াল সে। নয়নকে বলল, আমার মা জননী এসে গেছেন। রাখছি। তুই কাল সকালে আয়। মিস করিস না কিন্তু। বাই।
ফোন রেখে হাসিমুখে জয়ার দিকে তাকাল কবি।
জয়ার হাতে দুটো শপিংব্যাগ। রাইফেল স্কোয়ারের বেশ দামি দোকানের শপিংব্যাগ। কবি একবার ব্যাগ দুটোর দিকে তাকাল। কথা বলতে যাবে তার আগেই জয়া বললেন, কার সঙ্গে কথা বলছিস?
কবি লাজুক মুখ করে বলল, আমার গার্লফ্রেন্ড।
কী নাম?
নয়ন।
ও নয়ন! বুঝেছি। আজকাল ছেলেরাও তোমার গার্লফ্রেন্ড হচ্ছে।
আমার কপালে তো মেয়ে জুটলো না, কী আর করার, ছেলেবেলার বন্ধুদেরকেই গার্লফ্রেন্ড বলে আনন্দ পাচ্ছি। ব্যাগে কী?
ব্যাগ দুটো কেবিনেটে রাখলেন জয়া। জামাকাপড়। ভাবলাম মেয়েটির জামা কাপড় নিশ্চয় আর পরার উপযোগী নেই, এ জন্য ফ্রক প্যান্ট নিয়ে এলাম।
কবি মুগ্ধ হল। এই না হলে আমার ভাবীমা।
জয়া চেয়ারে বসলেন। তোমার মুখ শুকিয়ে গেছে।
ধকল, বুঝলে না! তার ওপর বিরক্ত।
বিরক্ত কেন? বুঝেছি, ওই পুলিশ অফিসারের কারণে?
হ্যাঁ। অদ্ভুত টাইপের লোক।
বাড়িতে গিয়ে আমাদেরকেও ভাল রকম বিরক্ত করেছে।
শুনলাম।
বলল তোমাকে?
বিরক্ত করার কথা কি আর বলবে! বলল বাড়িতে গিয়েছিল। এই জয়া, তোর বর কি আমার ওপর রাগ করেছে?
নাম ধরে ডাকলে আর তুই তোকারি করলে থাপ্পড় মারবো। জুতা পেটা, না না স্যান্ডেল পেটাও করতে পারি।
আজ আমার ভাগ্যটা খুব খারাপ বুঝলি। তুই থাপ্পড় মারতে চাস, সকালবেলা রুনুভাই চাইলেন। অবশ্য তুই থাপ্পড়ের সঙ্গে জুতা স্যান্ডেলও মারতে চাচ্ছিস! না না, আমি সিরিয়াস ভাবী, ভাইয়া রাগ করেনি তো?
করতে চেয়েছিল আমি ধমক দিয়েছি।
আরে তুমি আছ বলেই তো আমি আছি। শোন খালাম্মা, নয়ন আবার ওই পুলিশ অফিসার সম্পর্কে অন্যরকম কথা বলল।
কী রকম?
লোকটাকে নাকি ভালই মনে হয়েছে ওর কাছে।
বলো কী? ওই লোককে নয়ন চেনে কী করে?
ঘটনা বলল কবি। শুনে জয়া বললেন, নয়ন সাংবাদিক, এজন্য হয়তো ওর সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথার পর অন্যদিকে আর এগোয়নি। সাংবাদিকদের পুলিশরাও ভয় পায়।
আমি মোরশেদ ভাইয়ের আওয়াজ দিয়ে দিয়েছি। খাগড়াছড়ি ট্রান্সফার করে দেব বলেছি।
তোর ভাইয়াও বলেছে। অবশ্য বদলি টদলির কথা বলেনি। মোরশেদ ভাই যে তার বন্ধু এটা বলেছে।
জয়া উঠলেন। চল তোর পেসেন্ট দেখি।
রবিও উঠল। মুখটা করুণ হল তার। পেসেন্টের অবস্থা একই রকম। কিছুই বুঝতে পারছি না ভাবী।
নার্ভাস হবি না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
তুমি দোয়া করেছ তো?
কবিকে আলতো করে ধাক্কা দিলেন জয়া। কথা বলিস না, চল।
ওরা গিয়ে আইসিইউতে ঢুকল।
মেয়েটির অবস্থা একই রকম। একই ভঙ্গিতে পড়ে আছে, একই ভাবে চলছে স্যালাইন। ওরা ঢুকে দেখল একজন নার্স মুহূর্তের জন্য ক্যানোলা খুলে ইনজেকশান পুশ করলো। তারপর স্যালাইন লাগিয়ে বেরিয়ে গেল। সেই ভদ্রলোকের বেডের পাশে তাঁর দুই মেয়ে আছে, তুহিন আছে তার মামার বেডের পাশে। শুধু ভদ্রমহিলার অ্যাটেনডেন্ট নেই। সেই মহিলা যথারীতি বারান্দার চেয়ারে বসে আছে।
মেয়েটির বেডের সামনে দাঁড়িয়ে অপলক চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন জয়া। কবিও তাকিয়ে আছে। দুজনের কারও মুখে কথা নেই। কবি একসময় জয়ার দিকে তাকিয়েছে, দেখে বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছেন জয়া। এরকম একটি মেয়ের জন্য হাসপাতালে এসেছেন জয়ার মতো মানুষ, জামা প্যান্ট কিনে এনেছেন, এখন সেই মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে তার মঙ্গল কামনায় দোয়া পড়ছেন দেখে কবির চোখ ছলছল করে উঠল। ডান হাত বাড়িয়ে জয়ার একটা হাত শক্ত করে ধরে রাখল সে, কান্না সামলালো।
আইসিইউ থেকে মাত্র বেরিয়েছে ওরা, সঙ্গে একজন জুনিয়র আর দুজন নার্স নিয়ে রুনু সাহেব আসছেন এদিকে। জয়াকে দেখে উচ্ছ্বসিত হলেন। আরে জয়া, তুমি কখন এলে? আমাকে ফোন করনি কেন?
জয়া হাসলেন। এতবড় ডাক্তারকে যখন তখন বিরক্ত করা ঠিক না!
কী আশ্চর্র্য কথা। চলো আমার রুমে চলো। কফি খাও।
না রুনুভাই এখন আর কফি খাবো না। আমার দেবরটি একা এখানে পড়ে আছে, ওকে তো আমি চিনি, মেয়েটির জন্য খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেবে, ঘুমাবে না, মগের পর মগ চা খাবে, এ জন্য এলাম।
কবির মাথায় ছোট্ট বাচ্চাকে আদর করার ভঙ্গিতে একবার হাত বুলালেন রুনু সাহেব। পাগলটা মানুষ হিসাবে অসাধারণ। আজকাল এমন দেখা যায় না।
মেয়েটির অবস্থা কী?
সামান্য ডেভলাপ করেছে। আমি রিপোর্টগুলো দেখেছি। ইন্টারনাল ইনজুরি আছে। এন্টিবায়োটিকে কাজ হবে। জ্ঞান ফিরলে, মুখে খেতে পারলে আশা করি ধাক্কা সামলে উঠবে। চিন্তা করো না। বেস্ট ট্রিটম্যান্ট দেয়া হচ্ছে।
ঠিক আছে রুনু ভাই। আমি তাহলে এখন…
ওকে। এরপর আমাকে ফোন করে আসবে।
রুনু সাহেব দলবল নিয়ে আইসিইউতে ঢুকলেন।
জয়া বললেন, আমাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আয়।
চলো।
লিফটে চড়ে কবি বলল, সকালবেলা মতিনকে দিয়ে আমার কিছু কাপড় চোপড় পাঠিয়ে দিও।
তুই নিজে এলেই তো পারিস। বাড়ি থেকে ফ্রেশ হয়ে পছন্দ মতো জামা কাপড় নিয়ে এলি!
না ভাবী। আমি এখন নিশ্চিত যখন তখন জ্ঞান ফিরবে মেয়েটির। তুমি যেহেতু ওর পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া পড়েছ, আল্লাহ নিশ্চয় ওকে দয়া করবেন। আমি চাই জ্ঞান ফেরার সঙ্গে সঙ্গে ওর পাশে গিয়ে যেন দাঁড়াতে পারি।
গাড়িতে ওঠার আগে ব্যাগ খুললেন জয়া। পাঁচশো টাকার একটা নতুন নোটের বান্ডিল বের করে কবির হাতে দিলেন। এই পঞ্চাশ হাজার রাখ।
কবি অবাক। এত টাকা দিয়ে কী করবো?
পকেটে আছে মাত্র আটশো, শুনে আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়েছে। এ জন্য নিজের নতুন টাকার বান্ডিল থেকে একটা নিয়ে এলাম।
ইউ আর সিম্পলি গ্রেট জয়া আন্টি। যাও বাড়ি যাও।
জয়া হাসিমুখে গাড়িতে চড়লেন।
চার
নাশতা শেষ করে রুমের ভেতর মিনিট দশেক পায়চারি করেছে কবি। এটা তার স্বভাব। তিনবেলা খাওয়ার পরই দশ পনেরো মিনিট পায়চারি করে, তারপর বসে একমগ গ্রীন টি নিয়ে। আজও তাই করেছে। গ্রীন টির মগে মাত্র চুমুক দিয়েছে, দরজা ঠেলে ঢুকল নয়ন। গুড মর্নিং।
ভেরি ব্যাড মর্নিং। আমার বন্ধু হয়ে তুই এত আনকালচারড কেন?
আনকালচারড মানে? কী করলাম বস?
এই যে নক না করে রুমে ঢুকলি?
তোর রুমে নক করে ঢুকতে হবে কেন? আমি জানি তুই কখনও ওসব কর্মে লিপ্ত থাকিস না। তাহলে অসুবিধা কী?
ইস সকালবেলা এসেই লিপ্ত ফিপ্ত কী সব শব্দ! রুমের পবিত্রতা নষ্ট করে দিলি।
নয়ন হাসিমুখে পিঠের হ্যাভারস্যাক নামালো, একপাশের দেওয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে রাখলো। তার পরনে নীল জিন্স আর গাঢ় সবুজ টি-শার্ট। হাতে দামি ঘড়ি, পায়ে নাইকের কেডস। সোফায় বসে দুহাতে মাথার ঝাঁকড়া চুল একটু পরিপাটি করলো তারপর একটা আরামের শব্দ করলো।
নয়নের গায়ের রং শ্যামলা। মাঝারি হাইটের স্বাস্থ্যবান যুবক। বেশ চঞ্চল, ছটফটে স্বভাবের। এক জায়গায় বেশিক্ষণ স্থির হয়ে বসতে পারে না। তবে ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। আগুনের মতো ইংরেজি বলে, কম্পিউটার এক্সপার্ট, লেখে ভাল, ছবি তোলে ভাল। সিনেমার পোকা। পৃথিবীর সর্বশেষ ভাল ছবিটা যত দ্রুত সম্ভব দেখে ফেলে। আড্ডাবাজ, প্রাণবন্ত এবং অমায়িক। চট করেই মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে। তুখোড় একেকটা রিপোর্ট করে। এই বয়সেই সাংবাদিক জগতে ভাল নাম। নানা পত্রিকা ঘুরে কালের কণ্ঠে থিতু হয়েছে।
চায়ে চুমুক দিয়ে কবি বলল, হেঁটে এসেছিস নাকি?
মানে?
বাইক কোথায়?
পার্কিংয়ে। তুই কি ভেবেছিস বাইক নিয়ে তিনতলার এই রুমে চলে আসবো!
না বাইক নিয়ে আসার নমুনা দেখছি না। মাথা কোথায় রেখে এলি!
নয়ন হাসলো। ও হ্যালমেট! কাউন্টারে রেখেছি। রাখতে চায়নি। তোর কথা বলায় খুবই তরিবতের সঙ্গে রাখলো। ওদের ভাবে বুঝলাম তুই সত্যি এই হাসপাতালের ডিরেক্টর।
কবি আবার চায়ে চুমুক দিল। তোর সাহস দেখে পাগল হয়ে যাচ্ছি।
কেন?
এই সাইজের একজন ডিরেক্টরের সামনে পায়ের ওপর পা তুলে বসেছিস! এটিকেট বলে কিচ্ছু নেই। পা আবার দোলাচ্ছিস!
এত প্যাকর প্যাকর করিস না। করলে…
করলে?
কালরাতে আমার যে জায়গায় লাথি হাঁকাতে চেয়েছিলি ঠিক ওই জায়গায় কেডস পরা পায়ে এখনই গাদাম করে একখানা হাঁকাবো।
আমি কি উঠে দাঁড়াবো? উঠে ঘুরে দাঁড়াবো বস?
দাঁড়ালে ভাল হয়। লাথি হাঁকাতে সুবিধা। ঠিক আছে, এত দিনকার পুরনো বন্ধু, পুরনো মাগুর টাইপের, যা মাফ করে দিলাম।
নাশতা খেয়েছ বন্ধু?
তোর এখানে ঢোকার আগে খেয়ে এলাম।
কোথায়?
এদিককার একটা গলির ভেতর গরিব ধরনের রেস্টুরেন্ট আছে। পরোটা আর গরুর মাংস অসাধারণ করে। ওই খেয়ে তারপর এককাপ ঘন দুধের চা মেরে দিলাম।
তোর লজ্জা করে না?
কেন?
আমার সাইজের বিশাল বড়লোক বন্ধুর সামনে বসে গরিব রেস্টুরেন্টের গল্প করছিস? তোর আর আমার ব্যবধান দেখেছিস! নহাজার আটশো টাকার রুমে বসে আছি। গ্রীন টি পান করছি। বাথরুমটা দেখে আয়। ওখানে বসে কর্ম সারতে চাইলেও পারবি না। বাথরুমের কেতায় ওই জিনিস বেরুতে চাইবে না, আটকে যাবে।
তোর গিয়েছিল?
তো! আজ সকালে হয়ই নি।
নয়ন হাসলো। শালা, বিতলামি করো। তোমাদের বাড়ির বাথরুম আমি দেখিনি! এটার বাথরুম কি তোদের বাড়ির চে ভাল?
মনে হয় একটু ভাল। আমরা কি অসভ্য দেখছিস! এতদিন পর দুই বন্ধুর দেখা, পৃথিবীর এত বিষয় থাকতে কথা বলছি বাথরুম নিয়ে। খানিক আগে লিপ্ত নিয়েও কথা হয়েছে। এসব বাদ দিয়ে আয় তোকে একটু ভালবাসি।
কবি উঠে দাঁড়াল। ওঠ।
কবির মতলব জানে নয়ন। সেও উঠে দাঁড়াল। দুহাতে বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরলো কবি। সে যেভাবে ধরলো নয়নও ধরলো সেইভাবে। কয়েক সেকেন্ড দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। কবি ফিসফিস করে বলল, আমি তোকে খুব ভালবাসি, নয়ন।
কবিকে ছাড়িয়ে দিল নয়ন। ছাড় ব্যাটা। কেউ দেখলে ভাববে আমরা ওই জিনিস।
হোমনার মোহন কুমার।
মানে?
বুঝিসনি! হোমনা উপজেলার বাসিন্দা মোহন কুমার। হোমনা থেকে নিবি প্রথম অক্ষর…
বুঝেছি বুঝেছি। মোহন কুমার থেকেও নিতে হবে প্রথম অক্ষর!
নয়ন হা হা করে হাসলো। তুমি বন্ধু মহাক্রিয়েটিভ। কোথায় হোমনা উপজেলা আর কোথায় মোহন কুমার! এই দুই জিনিসের প্রথম অক্ষর নিয়ে জোড়া দিলে… হা হা।
কবি বসে আবার চায়ে চুমুক দিল। চা খাবি?
না। তোর গ্রীন টি আমার কাছে বাচ্চা ঘোড়ার হিসির মতো লাগে।
ওই জিনিস কবে খেলি?
নয়ন হাসলো। এই তুই থাম।
আচ্ছা থামলাম। গ্রীনটি না খেলি, তোর ওই দুধ-চিনি দেয়া চা খা। আমি অর্ডার করে দিচ্ছি।
দরকার নেই। কাজের কথা বল।
তার আগে তুই বল, তুই যে কালরাতে বললি হায়দার লোক ভাল, কী করে বললি। তুই সাংবাদিক মানুষ, নানা রকমভাবে মানুষ সম্পর্কে তোরা ভাবিস। তার ওপর তুই হচ্ছিস অলওয়েজ সন্দেহপ্রবণ টাইপ, নেগিটিভ চিন্তা তোর মধ্যে প্রথম আসে। এই চরিত্র নিয়ে হায়দারকে বিচার করে সার্টিফিকেট দিয়ে ফেললি সে লোক ভাল।
আমি যেটুকু দেখেছি তাতে তাই মনে হয়েছে। তবে কথা আছে। একেকজন মানুষের চেহারা একেকজনের কাছে একেকরকম। আমি যে মানুষকে ভাল জানি আরেকজন হয়তো সেই মানুষটিকেই খারাপ জানে। আমি যার ভাল চেহারা দেখেছি আরেকজন হয়তো তার কুৎসিৎ চেহারা দেখেছে। কত সোবার, সফসটিকেটেড লোক ঘরে পরীর মতো বউ রেখে বাড়ির কাজের মেয়েতে উপগত হয়…
বাপরে! উপগত! বাংলার জাহাজ হয়ে গেছিস দেখি। হয়েছে, এইসব ফিলোসফিক্যাল লেকচার বন্ধ করো। আমার কাজটা করে দাও।
কী করতে হবে বল।
আগে আইসিইউতে চল। মেয়েটি দেখ। সঙ্গে ক্যামেরা আছে না?
আছে।
ওর কয়েকটা ছবি তোল। ছবিসহ তোর কাগজে একটা রিপোর্ট কর। হয়তো ওই রিপোর্ট ধরে ওর মা বাবা বা আÍীয়-স্বজন কেউ হাসপাতালে এলো। তাহলে মেয়েটি সম্পর্কে আমরা জানতে পারবো। হায়দার হোসেনও আসল তথ্য পেয়ে যাবে, আসল অপরাধীদের ধরতে পারবে, আমিও দায়মুক্ত হই।
এটা তুই না বললেও আমি করবো। এইসব অনাচার সহ্য করার লোক আমি না। কারা এই অবস্থা করেছে মেয়েটির তাদেরকে খুঁজে বের করা আমাদেরও দায়িত্ব। এতবড় অন্যায়ের শাস্তি তাদেরকে পেতেই হবে। সাংবাদিকদের বলা হয় সমাজের বিবেক। বিবেকের তাড়নায়ই কাজটা আমি করবো।
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে উঠল কবি। বিবেক বাবাজি, চল তাহলে আইসিইউতে যাই।
চল।
হ্যাভারস্যাক থেকে ক্যামেরা বের করলো নয়ন।
পাঁচ
দরজায় টুক টুক করে নক করল কেউ। সোফা কাম বেডে আধশোয়া হয়ে টিভি দেখছে কবি। দরজায় শব্দ শুনে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত দুটো বাজতে দশ মিনিট বাকি। এত রাতে কে নক করছে! বুকটা ধক করে উঠল। কোনও অশুভ সংবাদ নিয়ে এলো সিস্টার?
গা থেকে কাঁথা সরিয়ে উঠে দাঁড়াল কবি। আসুন।
দরজা ঠেলে উজ্জ্বল মুখে ঢুকলো সিস্টার নিপা। আপনার পেসেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।
থ্যাংকস গড।
দৌড়ে রুম থেকে বেরুল কবি। টিভি চলতে লাগল টিভির মতো, বন্ধ করার কথা মনেও হল না তার। ছুটে গেল আইসিইউর দিকে। গিয়েই ভাল রকম একটা ধাক্কা খেল। আইসিইউর সামনে অসহায় ভঙ্গিতে বসে কাঁদছে তুহিন। কাঁদতে কাঁদতে ফোনে কথা বলছে, মামা নেই। আমার মামা নেই। মামা চলে গেছে।
এই বয়সী যুবককে অনেক দিন এমন করে কাঁদতে দেখেনি কবি। মামাকে কী ভাল সে বাসত গত দুদিনে কবি তা বুঝেছে। তার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। তেমন অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়নি তুহিনের সঙ্গে তবু তার কান্না দেখে চোখে পানি এলো। আইসিইউতে ঢোকার আগে তুহিনের সামনে এসে দাঁড়াল। প্রিয়বন্ধুর ভঙ্গিতে তার কাঁধে হাত দিল। তুহিন এক পলক তার দিকে তাকালো, মোবাইল রেখে শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। কত আশায় ছিলাম, ধকল কাটিয়ে উঠবে মামা। সেন্স এলে এনজিওগ্রাম করাবো। তারপর স্ট্যানটিং করাতে হলে করাবো, বাইপাস দরকার হলে করাবো। আমার জন্য এত টাকা রেখে গেছে মামা, দরকার হলে ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে যাব তাকে। ডক্টর দেবী শেঠিকে দিয়ে অপারেশন করাবো। মামা আমাকে কিছুই করার সুযোগ দিল না। হাসপাতালে একজনের বেশি থাকা যায় না। দুদিন ধরে আমি আর মা আছি। অন্য ভাইবোনরাও এসেছে। মামা মামী চাচা ফুফু আত্মীয়স্বজন সবাই আসা যাওয়া করছে। আমার বোন বলেছিল, তুই দুদিন ধরে আছিস। দিন নেই রাত নেই, খাওয়া নেই গোসল নেই। তুই আজ বাড়ি যা। আমি থাকি মামার কাছে। তুই গিয়ে গোসল টোসল করে ফ্রেশ হ, খেয়েদেয়ে ঘুমা, আমি রাজি হইনি। মামাকে ছেড়ে যেতে আমার ইচ্ছা করেনি। মনে হয়েছে আমি কাছে থাকবো না, সেই ফাঁকে যদি মামার জ্ঞান ফেরে! জ্ঞান ফেরার পর মামা যদি আমাকে খোঁজে। আমার সেই আশা আর পূরণ হল না। আমার মামা ফিরে এলো না। মামাকে ছাড়া আমি থাকবো কী করে? মামাকে আমি ভুলবো কী করে? আমাকে এখন শাসন করবে কে, আমাকে এখন আদর করবে কে? মামা, মামা গো!
এ সময় কাঁদতে কাঁদতে এলেন তুহিনের মা, তুহিনের একভাই দুবোন। সবার চোখে পানি। বোন দুজন ওড়নায় মুখ চেপে কাঁদছে, ভাইটি কাঁদছে নিঃশব্দে। ভাইয়ের জন্য বিলাপ করে কাঁদছেন তুহিনের মা। আলতাফ, আলতাফ রে! আমার ভাই, আমার ভাই…
একজন সিস্টার তাঁকে জড়িয়ে ধরে অন্যদিকে সরিয়ে নিল। কবি বুঝলো, আইসিইউর সামনে শব্দ করে কান্নাকাটি করলে অন্য রোগীদের অসুবিধা হতে পারে, এ জন্য অতি যতেœ কাজটা করলো সিস্টার। তুহিনের ভাইবোনরাও মায়ের সঙ্গে সরে গেল। শুধু তুহিন বসে রইল আগের জায়গায়, তার কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়ানো কবি। যেন কবির হাত নিঃশব্দে সান্ত্বনা দিচ্ছে তুহিনকে। কেঁদো না, কেঁদো না। নিজেকে সংযত করো। মানুষের জীবন এরকমই, এই আছে, এই নেই।
আলতাফ সাহেবের লাশ তখনই বের করে আনা হল আইসিইউ থেকে। স্ট্রেচারের সামনে পেছনে সাদা এপ্রোন পরা দুজন বয়। তাদের এপ্রোনের মতো সাদা চাদরে পুরো শরীর ঢাকা আলতাফ সাহেবের। মামার লাশ দেখেই উঠে দাঁড়াল তুহিন। প্রায় ছুটে গিয়ে ধরলো স্ট্রেচার। বয়দের সঙ্গে দ্রুত ঠেলে নিয়ে চলল উত্তর দিকে। কবি দেখেছে ওখানটায় বেশ অনেকখানি খোলা জায়গা, মাঝখানের ভারী কাচের দরজা বন্ধ করে দিলে ওদিককার শব্দ এদিকে আসে না। কেউ মারা গেলে লাশ দ্রুত বের করে ওখানে রাখা হয় যাতে কান্নাকাটির শব্দ অন্য রোগীরা না শোনে, লাশ দেখে নার্ভাস না হয়।
কবি একবার সেইদিকে তাকালো। আলতাফ সাহেবের লাশ ওখানে পৌঁছাতে তাঁর মুখ থেকে চাদর সরালো তুহিন। তুহিনের মা বোনরা ঝুঁকে পড়ল সেই মুখের দিকে। তাদের কান্নার শব্দ এখান থেকে পাওয়া যাচ্ছে না, ভারী কাচের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে।
মানুষের কান্না সহ্য করতে পারে না কবি। সে টের পাচ্ছিল তার চোখও পানিতে ভরে আসছে। নিজেকে সামলাবার জন্য আইসিইউতে ঢুকল সে। নিজের রোগীর বেডের সামনে এসে দাঁড়াল, মেয়েটির মুখের দিকে তাকালো। তার মুখে এখন আর অক্সিজেন মাস্ক নেই। জ্ঞান ফেরার সঙ্গে সঙ্গে খুলে দেওয়া হয়েছে। মেয়েটির চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি। যেন অচেনা কোনও ভুবনে এসে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কবিকে দেখে তার মুখের দিকে তাকালো। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। মুখে শব্দ নেই, শুধু বোবা প্রাণীর মতো অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকা। সিস্টার নিপা ছিল বৃদ্ধা মহিলার বেডের ওখানে। কবিকে দেখে এগিয়ে এলো। নিচু গলায় বলল, ভাল আছে, আপনার পেসেন্ট ভাল আছে। এখন মনে হয় ভয়ের আর কিছু নেই।
কবি একবার নিপার দিকে তাকালো তারপর গভীর মমতায় মেয়েটির মাথায় হাত রাখলো। খানিক আগে আলতাফ সাহেবের লাশ বেরুল এই রুম থেকে, আর ঠিক তার পাশের বেডেই মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলো এই মেয়ে। জীবন-মৃত্যুর কী অদ্ভুত খেলা! এক জীবন যায়, এক জীবন ফিরে আসে। সাত আসমানের উপরে বসে কী খেলা খেলছেন সেজন!
কবির স্পর্শে কী রকম কেঁপে উঠল সেই মেয়ে। একটু যেন আড়ষ্ট হয়ে গেল, একটু যেন ভয়ার্ত দৃষ্টি খেলে গেল তার চোখে। কবি বুঝল ধীরে ধীরে স্মৃতি ফিরছে মেয়ের। তাকে যারা অত্যাচার করেছে, দিনের পর দিন উঠতে বসতে মেরেছে বীভৎস মার, কবিকে তাদের একজন ভেবেছে। আহা রে! আহা!
মেয়েটির মাথায় মায়াবি হাত বুলাতে বুলাতে কবি বলল, তুমি ভয় পেও না। একটুও ভয় পেও না। এখানে কেউ তোমাকে মারবে না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। এটা হাসপাতাল। তোমার চিকিৎসা চলছে। তুমি ভাল হয়ে যাবে, একদম ভাল হয়ে যাবে।
মেয়ে কথা বলে না, শব্দ করে না। তার দুচোখ বেয়ে নিঃশব্দে নামে কান্না। চোখ ভেসে যায়, গাল ভাসতে থাকে। তার কান্না দেখে কবির চোখ ছলছল করে ওঠে। ধরা গলায় বলে, তুমি পড়েছিলে লেকের ধারে। আমি তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। দুদিন ধরে তোমার চিকিৎসা চলছে। এইমাত্র জ্ঞান ফিরেছে তোমার। তুমি আমার সঙ্গে কথা বলো, একটু কথা বলো। নাম কী তোমার? বেশি কথা বলবার দরকার নেই। এখন শুধু নামটা বলো। শরীর আর একটু ভাল হলে ধীরে ধীরে আমাকে সব বলো। কোন বাড়িতে ছিলে তুমি? কারা তোমাকে এভাবে মেরেছে? কী নাম তাদের? সব আমাকে বলো, আমি পুলিশ অফিসারকে খবর দেব, তাঁকে বলো। তারপর সবগুলোকে আমরা ধরবো। জেল খাটাবো। একটাকেও ছাড়বো না। এখন তুমি শুধু তোমার নামটা আমাকে বলো।
সেই মেয়ে কথা বলে না, কাঁদে, শুধুই কাঁদে।
পাশের বেডের বৃদ্ধ ভদ্রলোকের পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর দুই মেয়ে। আলতাফ সাহেব মারা গেছেন শোনার পর থেকেই তারা বাবার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে। পাশের বেডের একজনের মৃত্যুতে বাবা যদি নার্ভাস হয়ে যান!
ভদ্রলোকের কি জ্ঞান আছে! তিনি কি দেখছেন সব, বুঝতে পারছেন সবকিছু! কই, তাঁর চোখ তো বোজা। মাথা একদিকে কাৎ করা। দেখে বোঝা যায় ঘুমাচ্ছেন। তবু মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে বাবার ভরসা হিসেবে।
এখন দুমেয়েই চোরাচোখে কবিকে দেখছে, কবির কথা শুনে নিজেরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। কবি তাদের দিকে ফিরেও তাকালো না। মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে লাগল, কথা বলতে লাগল। একটা কথা অন্তত আমার সঙ্গে বলো তুমি। শুধু একটা কথা। তোমার নাম বলো, নাম?
মেয়ে কথা বলে না। কবির মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদে। কবি দেখে মেয়ের চোখ দুটো বড় বড়, ডাগর। অপূর্ব মায়াবি চোখ। কী রকম অসহায়ত্ব খেলা করে চোখে। এরকম চোখের দিকে তাকিয়েও কি একটুখানি মায়া হয়নি মানুষ নামের সেই জন্তুগুলোর! শ্যামল বরণ মুখে কত দুঃখের ছায়া। এই মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন করে তারা মেরেছে মেয়েটিকে! ওরা কি মানুষ, না হিংস্র শূকর! ওরা কি মানুষ, না বুনো কুকুর! ওরা কি মানুষ, না ইবলিস শয়তানের বংশধর!
নিপা আস্তে করে ডাকলো। স্যার…
কবি নিপার দিকে তাকাল। বলুন।
আপনি বেশিক্ষণ এখানে থাকবেন না। ওর মনের ওপর চাপ পড়ছে। এতে রোগীর ক্ষতি হতে পারে।
মেয়ের মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিল কবি। আচ্ছা ঠিক আছে।
তারপর মেয়ের মুখের দিকে তাকালো। তুমি ঘুমাও। এখন কিছু বলতে হবে না। শরীর আর একটু ভাল হোক, তারপর বলো। ভয় পেও না, একটুও ভয় পেও না। আমি পাশের রুমেই আছি। কিছুক্ষণ পর পর তোমাকে এসে দেখে যাবো।
মেয়ে ভেজা চোখে কবির দিকে তাকিয়ে থাকে।
রুমে এসেই জয়াকে ফোন করলো কবি। তিনবার রিং হওয়ার পর ফোন ধরলেন জয়া। ঘুম ভাঙা গলায় বললেন, হ্যালো। কী রে কী খবর?
খবর ভাল। খুব ভাল। কিছুক্ষণ আগে জ্ঞান ফিরেছে। আই য়্যাম সরি ভাবী, এত রাতে তোমার ঘুম ভাঙালাম। কিন্তু তোমাকে খবরটা না জানিয়ে থাকতে পারছিলাম না।
ভাল করেছিস। আমি জানি তুই যখন তখন ফোন করতে পারিস। এ জন্য ফোন খোলা রেখেছি। রাতে আমি ফোন বন্ধ করে ঘুমাই। যাক মেয়েটির জ্ঞান ফেরার কথা শুনে ভাল লাগছে। আল্লাহ রহমত করেছেন। আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শোকর।
তোমার দোয়া কাজে লেগেছে।
মেয়েটি কথা বলেছে?
না। ভয় পাওয়া চোখে চারদিক তাকায় আর নিঃশব্দে কাঁদে। সেই কান্না দেখে আমার এত খারাপ লাগছে। বুক হু হু করে উঠছে।
কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল কবি।
জয়া বিব্রত হলেন, কাঁদছিস কেন পাগল! জ্ঞান ফিরেছে, এখন ধীরে ধীরে সেরে উঠবে, এটা তো আনন্দের সময়। যা উঠ, হাত মুখ ধুয়ে ঘুমা! নাকি আমি আসবো?
না না এত রাতে তোমার আসবার দরকার নেই।
সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে শাহজাহান ড্রাইভার আছে। আমি চাইলে আসতে পারি।
না।
তোর কান্না না থামলে তো আসতেই হবে।
না না আমি ঠিক আছি। তুমি ঘুমাও।
তুই না ঘুমালে আমার কি ঘুম আসবে!
আমি এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়বো। কালরাতে এক মিনিট ঘুম হয়নি, দিনে তো হয়ইনি। আজ এতটা রাত হয়েছে, ঘুমাবার চেষ্টা করেছি, কিছুতেই ঘুমাতে পারছিলাম না। শুধু মেয়েটির কথা মনে হয়, শুধু ওর মুখটা চোখের সামনে দেখি আর কেমন যে লাগে! মনে হয় আমি ঘুমিয়ে পড়বো আর সেই ফাঁকে হয়তো ঘটে যাবে দুর্ঘটনা, অথবা আমি ঘুমিয়ে থাকবো সেই ফাঁকে জ্ঞান ফিরবে মেয়েটির, আমি টেরও পাবো না।
তুই একটা অদ্ভুত ছেলে। আজকালকার দিনে মানুষের জন্য এত মায়া আমি কারও দেখি না। আল্লাহ তোকে একেবারেই অন্যরকম করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আমি দোয়া করি, প্রাণভরে দোয়া করি যেন সারাজীবন মানুষের জন্য এই মায়াটা তোর থাকে। এখন ঘুমা সোনা, ঘুমিয়ে পড়। মেয়েটির জ্ঞান ফিরেছে এখন দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।
কবি কান্না সামলে বলল, তুমিও ঘুমাও।
ছয়
আজকের সকালটাও প্রতিদিনকার মতোই শুরু করেছেন রবি। পৌনে ছটার দিকে উঠে একগ্লাস পানি আর দুটো সুগার ফ্রি বিসকুট খেয়েছেন। মিনিট দুতিনেক বারান্দায় হাঁটাহাঁটির পর টয়লেট সেরে ট্র্যাকস্যুট কেডস পরে হাঁটতে বেরিয়ে গেছেন। পাক্কা একঘণ্টা হাঁটেন। হাঁটা শেষ করে পাড়ার আফজাল সাহেব আরেফিন সাহেবের সঙ্গে গল্প করতে করতে বাড়ি ফেরেন। রতন রেডি থাকে পানি নিয়ে। আবার একগ্লাস পানি খেয়ে গোসলে ঢোকেন। ততক্ষণে রহিমা নূরজাহান ওরা নাশতা রেডি করে ফেলে। টেবিলে নাশতা সাজিয়ে ফেলে শিরি। জয়া একটু তদারক করেন। দুই মেয়েকে ডেকে তোলেন। কবি বাড়ি থাকলে কবিকেও তোলেন। তারপর একসঙ্গে নাশতা। নাশতার পর বছর চারেক ধরে প্রেসারের ওষুধ খেতে হয়। অ্যামডোকল-৫। রাতে খান রসুভা-৫। ওটা কলেস্টেরলের জন্য। প্রতি দুদিনে রাতেরবেলা একটা করে। এতে কলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
রবি নিয়ম মানা লোক। মদ সিগ্রেটের অভ্যাস নেই, রেডমিট এভয়েড করেন, মিষ্টি জাতীয় জিনিস এভয়েড করেন। সকালবেলা নাশতা খান রুটি সবজি, একটা সিদ্ধ ডিমের সাদা অংশ, একবাটি পাকা পেঁপে। পেঁপে আর সবজি আসে তাঁর ভালুকার খামারবাড়ি থেকে। চাল মুরগি ডিমও আসে। রবি ব্রয়লার মুরগি খেতে পারেন না। এ জন্য দেশি মুরগির ছোটখাটো একটা খামার করে দিয়েছেন ভালুকায়। সপ্তাহে সপ্তাহে কেয়ারটেকার বারেক এসে সবজি মুরগি মাছ দিয়ে যায়। আটাত্তোর বিঘা জমির ওপর খামার। ধান সবজি মাছ মুরগি ফল সবই চাষ করা হয়। নিজেদেরটা রেখে বাকিগুলো বিক্রি করে কিছু টাকাও আসে।
দেশে এখন আর ফ্রেশ কোনও কিছু পাওয়াই যায় না। প্রতিটি জিনিসে ভেজাল। ফরমালিন নামের একটা কেমিকেল প্রতিটি খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। ওই জিনিসের এমন গুণ, আপেল খোলা জায়গায় রেখে দিলে দশ-পনেরো দিনেও পচে না। শাক-সবজি ফ্রেশ থাকে দিনের পর দিন। মাছ ফ্রেশ থাকে। ফরমালিন দেওয়া মাছে মাছি বসে না। ইদানীং হোটেলের ভাতেও নাকি ফরমালিন ব্যবহার করা হচ্ছে। একদিনের ভাত চার-পাঁচ দিন রেখে বিক্রি করা হচ্ছে। মানুষ অসুস্থ হচ্ছে খেয়ে। রোগবালাই বেড়ে গেছে। দশ-পনেরো বছর পর নাকি দেশে ক্যান্সার রোগী ব্যাপক হারে বাড়বে খাদ্যে ভেজালের কারণে।
কিন্তু সাধারণ মানুষের উপায় কী? তাদের তো বাধ্য হয়ে খেতে হচ্ছে এসব! সরকার অবশ্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ঢাকায় গোটা দশেক বাজার ফরমালিন মুক্ত করা হয়েছে। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একেকটা টিম চলে যাচ্ছে একেক বাজারে। পরীক্ষা করে দেখছে ফরমালিন আছে কি না। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীকে এরেস্ট করা হয়েছে। তাতে কাজ কতটা হচ্ছে কে জানে। পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই লেখা হচ্ছে এসব নিয়ে, টেলিভিশনে নানা রকমের প্রতিবেদন দেখানো হচ্ছে। মানুষ সচেতন কিন্তু অসাধু কারবারিরা তাদের কারবার নানাভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। দুনম্বরি করার নতুন নতুন পথ আবিষ্কার করছেন নিয়মিত। আগে পাকাবার জন্য কাঁচা আমে কেমিক্যাল ব্যবহার করতেন, এখন অতদিন অপেক্ষাই করেন না। আমের বোল আসার সঙ্গে সঙ্গে বোলেই স্প্রে করেন কেমিক্যাল। কাজ যা করার আগেই সেরে ফেলেন। সময়ের অনেক আগেই পাকতে শুরু করে আম। আর কী রং সেই আমের, কী গন্ধ। মানুষ পাগল হয়ে কিনতে থাকে।
আরেক নতুন ধান্দা বেরিয়েছে, আমের সিজনে ঢাকার বেইলি রোড, ধানমন্ডি এইসব এলাকায় আমের মেলা হয়। সাত দিন দশ দিনের মেলা। ভাল প্রচার-প্রচারণা চলে। মূল বক্তব্য, কেমিক্যাল ছাড়া আম। ওইসব মেলায় ক্রেতার অভাব হয় না। তবে কতটা কেমিক্যালমুক্ত ওই নিয়ে কাউকে তেমন মাথা ঘামাতে দেখা যায় না। ভালই ব্যবসা করেন আম ব্যবসায়ীরা।
কিছু দোকানও হয়েছে কোনও কোনও এলাকায়। কেমিক্যালমুক্ত শাক-সবজি, ফলমূল, মাছ চাল বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করে। অর্থাৎ দুনম্বর আর এক নম্বরের ভাল একটা খেলা চলছে।
আজ সকালে নাশতা করতে বসে এইসব মনে পড়ছিল রবির। কারণ আজ তাকে নাশতা করতে হয়েছে একা একা। জয়ার ঘুম বোধহয় ভাল হয়নি রাতে। আটটা বেজে গেছে তখনও ওঠেননি। আর তিনি না উঠলে তাঁর কন্যারাও উঠবেন না। শিরি অবশ্য ডাকতে চেয়েছিল, রবি মানা করেছেন। না, ডাকবার দরকার নেই। ঘুমাক।
কুহু কেকাকে ডাকবো?
না, ওরা জয়ার সঙ্গে নাশতা করবে।
নাশতা সেরে চা নিয়ে বারান্দায় বসেছেন রবি। তাঁর প্রিয় বাংলা দৈনিক কালের কণ্ঠ আর ইংরেজি ডেইলি স্টার। আগে ইংরেজি কাগজটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন, দু একটা নিউজ বা আর্টিক্যাল পড়েন তারপর ধরেন কালের কণ্ঠ। সেই ফাঁকে প্রথম কাপ চা শেষ, দ্বিতীয় কাপ নিয়েছেন।
আজও একই কায়দায় দ্বিতীয় কাপে চুমুক দিয়েছেন আর কালের কণ্ঠ হাতে নিয়েছেন। আনমনা ভঙ্গিতে প্রথম পৃষ্ঠায় তাকিয়েছেন, তাকিয়ে দেখেন নিচের দিকে একটি ন্যাড়া মাথার কঙ্কালের মতো দশ এগারো বছরের মেয়ের ছবি ছাপা হয়েছে। অচেতন হয়ে হাসপাতালের বেডে পড়ে আছে। চোখ বন্ধ। একটু চমকালেন রবি। নিউজটা পড়তে লাগলেন। পড়তে পড়তে উত্তেজিত হলেন। আরে, এই তো সেই মেয়ে, কবি যাকে উদ্ধার করে তাদের হাসপাতালে নিয়ে গেছে! এই তো ফ্রেন্ডশিপ হসপিটালের নাম লেখা হয়েছে, কবির কথা লেখা হয়েছে! কবির খুবই প্রশংসা করা হয়েছে, হাসপাতালের চিকিৎসার প্রশংসা করা হয়েছে।
রবি উত্তেজিত গলায় জয়াকে ডাকলেন, জয়া, জয়া।
মাত্র ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়েছেন জয়া, স্বামীর চিৎকারে সামনে এসে দাঁড়ালেন। চিৎকার করছো কেন? কী হয়েছে?
আরে তোমার দেবর তো হিরো হয়ে গেছে!
মানে?
এই যে কালের কণ্ঠে সেই মেয়ের ছবি দিয়ে নিউজ বেরিয়েছে, কবির প্রশংসা করা হয়েছে, আমাদের হাসপাতালের প্রশংসা করা হয়েছে।
জয়াও স্বামীর মতো উত্তেজিত হলেন। দেখি দেখি।
রবির পাশের চেয়ারে বসে কাগজটা টেনে নিলেন তিনি, মন দিয়ে পড়তে লাগলেন। পড়তে পড়তে মুখ উজ্জ্বল হল তাঁর। বাহ্, কী সুন্দর লিখেছে! নয়ন ছেলেটা খুব ভাল লেখে। এখন যদি মেয়েটির আসল পরিচয় বেরোয়।
তা বেরুবে। আমি খুশি অন্য কারণে।
ভাইয়ের গৌরব আর হাসপাতালের প্রশংসা?
তা তো আছেই। আর ওই পুলিশ অফিসারটা এই নিউজ পড়ে সাইজ হয়ে যাবে।
জয়া হাসলেন। তুমিও দেখি এই জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের মতো কথা বলো। সাইজ, হেব্বি, জোস, বস।
শব্দগুলো ভালই। বাংলা ভাষায় নতুন নতুন শব্দ কিছু দিন পরপরই যুক্ত হয়। আমাদের ছেলেবেলায় একটা কথা ছিল গান্ধি মারে কিরি কিরি। বেশ মজা করে বলতাম আমরা।
অর্থ কী?
তা জানি না। আর সিনেমার নায়কদের নায়ক বা হিরো বলতাম না, বলতাম বাহাদূর।
কেন?
তখনকার ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানের মারদাঙ্গা সিনেমাগুলো চলতো হলে, হলিউডের যুদ্ধের ছবিগুলো চলতো। ওইসব সিনেমায় নায়করা এমন মারপিট করতো, একাই ধরাশায়ী করতো শত শত লোককে। এ জন্যই হয়তো বাহাদুর বলা হতো তাদের। এটা ঢাকাইয়ারা বেশি বলতো।
সিনেমার নায়করা এখনও একাই কুপোকাত করে বহু গুণ্ডাপাণ্ডাকে। সালমান খান, অক্ষয় কুমার, অজয় দেবগন এরা মারপিটের জন্যই বিখ্যাত।
আর ওদের গুরুর নাম বললে না! অমিতাভ বচ্চন। তাঁকে বলা হতো এংরি ইয়াংম্যান। মকবুল ফিদা হুসেন তাঁর পোস্টার এঁকেছিলেন। সেই পোস্টারে লেখা হয়েছিল স্পিরিট অব ইন্ডিয়া।
বাব্বা! তুমি দেখি সিনেমার খবরও রাখো।
তুমি আনন্দলোক পড়ো দেখে আমিও পড়ি।
আমি সানন্দাও পড়ি। মেয়েদের জন্য সবচাইতে ভাল কাগজ।
আচ্ছা গিয়াস নামে একটা লোক তোমাকে কলকাতার পত্রিকাগুলো দেয়, ওই লোকটাকে এখন আর দেখি না। পত্রিকা দেয় না? ঘটনা কী!
অবশ্যই দেয়। আনন্দবাজার গ্র“পের সবগুলো পত্রিকাই দেয়। আমি পড়ি সানন্দা আর আনন্দলোক। কবি পড়ে দেশ। তোমার মেয়েরা পড়ে আনন্দমেলা আর উনিশ কুড়ি।
এটা তুমি একটা ভাল অভ্যাস করিয়েছ। ইংলিশ মিডিয়ামে লেখাপড়া করা ছেলেমেয়েরা বাংলা পড়তেই চায় না। ওইসব পত্রিকা পড়লে বাচ্চারা সার্ফ হবে।
তুমি কি জানো তোমার মেয়েরা কলকাতার বাংলা ছবি নিয়মিত দেখে। হিন্দি তো দেখেই। দুবোন ইংরেজি রেখে অনেক সময় হিন্দিতে কথা বলে। খুব ভাল হিন্দি বলতে পারে দুজনে। সিনেমা আর টিভি সিরিয়াল দেখে শিখেছে।
জয়া তারপর তীক্ষè চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন। ভাল খোশ গল্প জুড়েছ আজ! অফিসে যাবে না?
না।
বলো কী?
হ্যাঁ। একদিন অফিসে না গেলে কী হয়?
তার মানে সারাদিন আমাকে জ্বালাবে!
তোমাকে একা না, মেয়ে দুটোকেও।
মেয়েদের কথা বলতেই কুহু কেকা সামনে এসে দাঁড়াল। মর্নিং ড্যাড।
মর্নিং। মার সামনে ড্যাট ফেড বলিস না।
কুহু বলল, সরি বাবা।
রবি মেয়েদের দিকে তাকালেন। ক্যায়সা হায় বেটি?
কুহু কেকা খিলখিল করে হেসে উঠল।
কেকা বলল, বাবা, তুমি দেখি খুব ভাল হিন্দি বলো?
জয়া বললেন, বাবাকে ফুলাবার দরকার নেই। এটা কোনও হিন্দিই না, যে কেউ বলতে পারে। আমাদের শিরি রতন ওরা তোর বাবার চে ভাল হিন্দি জানে।
ওরা রেগুলার সাস ভি কাভি বহু থি দেখে।
কেকা বলল, হোয়াট হ্যাপেন ড্যাড? ইউ আর নট গোয়িং অফিস?
না। আজ তোদেরও ছুটি। স্কুল নেই।
হোয়াট?
আজ তোর মারও ছুটি।
জয়া বললেন, মানে কী?
মানে হলো আমরা সবাই এগারোটার দিকে বেরুবো। বেরিয়ে প্রথমে যাবো হাসপাতালে, কবির ওই মেয়েকে দেখে কবিকে নিয়ে বেরুবো। ওয়েস্টইনে লাঞ্চ করবো। ভাইয়ের এতবড় কৃতিত্ব, আমাদের হাসপাতালের এত প্রশংসা, এটা সেলিব্রেট করতে হবে না?
কুহু কেকা আনন্দে লাফিয়ে উঠল।
সাত
তিনবার রিং হওয়ার পর ফোন ধরলো নয়ন। ভয়েস বদলে যতটা সম্ভব মোটা করলো কবি। এটা কি নয়ন সাহেবের নাম্বার?
নয়ন ঘুমভাঙা গলায় বলল, জ্বি, কে বলছেন?
আমি কি আপনার ঘুম ভাঙালাম?
না ঠিক আছে। আপনি কে?
তোর বাপ শালা!
ছি ছি! একী ভাষা। বন্ধু বন্ধুর বাপ হয় কী করে?
সেসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পরে হবে। আগে বল এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছিস কেন?
রাতে শুয়েছি অনেক দেরি করে। তিনটার দিকে।
এত রাত পর্যন্ত কী করেছিস? চুরি!
না বন্ধু, সিনেমা দেখেছি।
কবির সামনে গ্রীন টির মগ। নাশতা শেষ করে চা নিয়ে বসেছে। কাল মধ্যরাত থেকে খুবই আনন্দে আছে সে। মেয়েটির জ্ঞান ফিরে আসার পর দুদিনের মানসিক চাপ কমে গেছে। যদিও মেয়েটি এখনও পর্যন্ত কথা বলছে না, নিঃশব্দে শুধু চোখের পানি ফেলে, তবু বেঁচে যে উঠেছে এতেই খুশি কবি। এখন ধীরে ধীরে নিশ্চয় সেরে উঠবে।
চায়ে চুমুক দিয়ে কবি বলল, তুই তিনটায় ঘুমিয়েছিস, আমি ঘুমাইইনি।
কেন?
আমার মেয়েটির জ্ঞান ফিরেছে।
দ্যাটস এ ভেরিগুড নিউজ। তোর মেয়ে নাকি?
ওই তো আমার পেসেন্ট। রাত দুটোর দিকে জ্ঞান ফিরলো। আমি তখনও জেগে। টিভি দেখছিলাম। ছুটে গেলাম আইসিইউতে। দেখি এক রোগী মারা গেছেন আর আমার রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। তারপর কি আর ঘুম আসে বল! বার বার ছুটে যাই আইসিইউতে। মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে আর নিঃশব্দে কাঁদে। ওরকম কান্না, ওরকম দুঃখী করুণ মুখ দেখলে ঘুম আসে, বল।
তুমি ধীরে ধীরে মহামানব হয়ে উঠছো বন্ধু। মাদার টেরিজা পুং।
বিতলামি করো না। শোন বন্ধু, তুমি ফাটিয়ে ফেলছো।
কীভাবে ফাটালাম?
রিপোর্ট লিখে। সকালবেলা তোর রিপোর্ট পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ভালই লিখতে শিখেছিস। পড়ে বুঝলাম, তোর হবে।
তার মানে এখনও হয়নি?
আরে না ব্যাটা, কিছুটা হয়েছে। পুরোপুরি হতে সময় লাগবে।
কতদিন লাগতে পারে বল তো?
এই ধর আশি নব্বই বছর।
নয়ন হা হা করে হাসলো। একশো বিশ বাইশ বছর আয়ু হবে, ভাল।
কবি আবার চায়ে চুমুক দিল। আই য়্যাম সিরিয়াস ফ্রেন্ড। ফ্যান্টাস্টিক লিখেছো। সত্যি সত্যি মুগ্ধ হয়ে গেছি। তোমাকে একদিন ওয়েস্টইনে খাওয়াবো।
কবে?
মেয়েটি পুরোপুরি ভাল হোক। তাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দেই, মা বাবার কাছে। আর কোন বাড়িতে সে কাজে এসেছিল, কারা তাকে ওভাবে টর্চার করেছে, সেই বদমাসগুলোকে ধরি, তারপর।
সে অনেকদিনের কেস বন্ধু! ওয়েস্টইনের খাবার যা ফাটাফাটি, এখনই ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে।
ইচ্ছে করলে যা, খেয়ে আয়।
আমি ওখানে খাওয়ার টাকা পাবো কোথায়?
আমার সঙ্গে খেতে হলে ওয়েট করতে হবে।
ওকে বস। ওয়েট করলাম। শোন, রিপোর্ট কিন্তু আমাদের গ্র“পের তিনটি কাগজ আর নিউজ পোর্টালেও আছে। শুধু কালের কণ্ঠে না।
তারপরই কথার ধরন বদলালো নয়ন। যাক সকালবেলা খুবই ভাল খবর দিলি। আমার রিপোর্টও বেরুলো মেয়েটিরও জ্ঞান ফিরলো। আমিও ব্যাপারটা খুবই সিরিয়াসলি নিয়েছি। আছি তোর সঙ্গে। ওই শ্যালক শ্যালিকাদের খুঁজে বের করবোই। তারপর দেখবি আর একটা রিপোর্ট করবো…।
ওটা করতেই হবে দোস্ত। কোনওভাবেই ওদেরকে ছাড়া যাবে না।
আরে না। প্রশ্নই ওঠে না। আচ্ছা শোন, আমি কি আজ আসবো?
মেয়েটিকে দেখতে চাইলে আসতে পারিস। কাজ থাকলে দুএকদিন পরে এলেও হবে। তেমন দরকার হলে আমি তোকে ফোন করবো।
ওকে বস। রাখি এখন।
রাখো বাপ।
ফোন শেষ করে আনমনা চোখে দরজার দিকে তাকিয়েছে, তাকিয়ে থতমত খেল কবি। ডক্টর রিমি আর একজন নার্স দাঁড়িয়ে আছে। রিমির পরনে আজ ফিরোজা রংয়ের বেশ কারুকাজ করা দামি পোশাক। তার ওপর এপ্রন। গতকালের তুলনায় আজ যেন আরও বেশি সুন্দর লাগছে তাকে।
কবি তাকাতেই বলল, ফোনে কথা বলার সময় অন্য কোনও দিকে তাকান না আপনি?
আপনি এসে দাঁড়িয়ে আছেন জানলে শুধু আপনার দিকেই তাকিয়ে থাকতাম।
কবির কথা শুনে নার্স মেয়েটি ঠোঁট টিপে হাসলো। রিমি হাসলো না। বলল, কথা বেশ ভাল বলেন আপনি।
আমি দেখতেও ভাল।
ওটা আপনার ধারণা। ধারণাটা ভুল।
আপনি যখন বলছেন তখন অবশ্যই ভুল। ডক্টর, আমার পেসেন্টের কী অবস্থা?
এখন আপনাকে নিশ্চিন্ত করতে পারি। সি ইজ ফাইন। ভাল হয়ে যাবে। ক্রাইসিস কেটে গেছে।
ওহ্! থ্যাংকস গড। আপনার মুখে ফুল চন্দন পড়–ক। সে কি আইসিইউতেই থাকবে?
না, ওসব বলতেই আপনার এখানে এলাম। ওকে আমরা এই রুমে দিয়ে দেব।
ভেরিগুড। সারাক্ষণ আমার চোখের সামনে থাকবে। ভাবী ওর জন্য নতুন ফ্রক প্যান্ট কিনে দিয়ে গেছেন। ওগুলো দেব?
না বাড়ি নেয়ার সময় পরিয়ে নিয়ে যাবেন। হসপিটালে যতদিন আছে আমরা এখান থেকে যে ড্রেস দিচ্ছি ওই পরতে হবে।
ওকে ম্যাম, ওকে।
তাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই রোগী এখানে পাঠাই!
নো প্রবলেম।
রিমি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে, কবি ঠিক গতকালের ভঙ্গিতে বলল, আপনার সঙ্গে কথা আছে।
বুঝেও না বোঝার ভান করলো রিমি। বলুন।
সিস্টারের সামনে বলতে চাচ্ছি না।
বুঝেছি। সিস্টার…
সিস্টার চটপটে গলায় বলল, ওকে ম্যাম, আমি যাচ্ছি।
সে বেরিয়ে যেতেই কবি রিমির চোখের দিকে তাকাল। আপনাকে হঠাৎ করে দেখে আমার কী মনে হলো জানেন?
কী?
আপনি রবীন্দ্রনাথের গানের মতো। ডট ডট এসেছিল নিঃশব্দ চরণে, তাই স্বপ্ন মনে হল তারে। সত্যি চোখ তুলে আপনাকে দেখে বাস্তব মনে হয়নি। মনে হয়েছে স্বপ্ন।
কবির কথা একদমই পাত্তা দিল না রিমি। অতি স্বাভাবিক গলায় বলল, আপনি থাকুন আপনার স্বপ্ন নিয়ে। আমি যাই।
আর একটু কথা ছিল যে।
ওই কথাটা আমি জানি।
না আপনি জানেন না।
বললাম তো জানি।
জানলে বলুন না!
রবীন্দ্রনাথের গানের যে শব্দটা আপনি বাদ দিয়ে গেছেন, ডট ডট দিয়ে চালিয়ে দিয়েছেন ওই শব্দটা বলবেন।
আরে না, অত সাহস আমার নেই। আমি বলতে চাই অন্যকথা।
বলুন।
অপলক চোখে রিমির চোখের দিকে তাকালো কবি। আপনি খুব সুন্দর।
রিমি তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, লাভ নেই।
কবি অবাক। এতে লাভ-লোকসানের কী আছে?
কী আছে তা আপনিও জানেন, আমিও জানি।
আমি জানি না। মানে বুঝতে পারছি না। একটু ব্যাখ্যা করবেন?
আমার একটা ছেলে আছে।
কথাটা যেন গায়েই লাগলো না কবির এমন ভঙ্গিতে বলল, ছেলের সঙ্গে সৌন্দর্যের সম্পর্ক কী?
তা জানি না। আমার ছেলের বয়স সাড়ে তিন বছর। প্লে-গ্র“পে স্কলাসটিকায় এবার ভর্তি করিয়েছি। নাম সংযুক্ত। আমি ডাকি সনজুবাবা।
এই নামে সঞ্জয় দত্তকে ডাকে অনেকে।
আমি সঞ্জয় দত্তর ফ্যান। এ জন্যই ছেলেকে সনজুবাবা ডাকি।
ছেলে নিয়ে একটা গল্প শুনবেন?
গল্প শোনার টাইম নেই।
অতি সংক্ষিপ্ত গল্প। মিনিট খানেক লাগবে।
আচ্ছা বলুন।
এক যুবকের অভ্যাস হচ্ছে যেখানে সুন্দরী মেয়েরা বেশি যায় সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়ে দেখে। তখনও ঢাকায় এত আধুনিক শপিংমল হয়নি। নিউমার্কেট সবচাইতে আধুনিক মার্কেট। শুক্রবার প্রচুর মানুষ হয়। ইয়াং মেয়েরা আসে দলবেঁধে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির মেয়েরা, ইডেন গার্লস কলেজের মেয়েরা। যুবক দক্ষিণ দিককার গেটের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েদের দেখে। একদিন একটা গাড়ি থেমে আছে গেটের সামনের পার্কিংয়ে। যুবক আনমনা চোখে গাড়ির দিকে তাকিয়েছে…
গল্প লম্বা হয়ে যাচ্ছে।
না না এই শেষ হয়ে এলো।
আচ্ছা বলুন। তাড়াতাড়ি শেষ করুন।
যুবক গাড়ির দিকে তাকিয়েছে, দেখে অসাধারণ সুন্দরী একমেয়ে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসে আছে। যুবক তার দিক থেকে আর চোখ সরাতে পারে না। মেয়েটিও তাকে দেখছে। যুবক দেখতে মন্দ না। সে তাকিয়ে আছে তো তাকিয়েই আছে, চোখ ফেরায়ই না। মেয়েটি তারপর অদ্ভুত একটা কাজ করলো। কোলের কাছ থেকে মাস সাতেকের একটা বাচ্চা তুলে মুখের সামনে ধরে রাখলো। অর্থাৎ আমার বাচ্চা আছে, লাভ নেই। ঘটনা বুঝলো যুবক। এগিয়ে গিয়ে গাড়ির জানালার সামনে দাঁড়ালো। বাচ্চাটা বুঝি আপনার? খুব ভাল! আমাকে বিয়ে করে ফেলুন, তাহলে আর বাচ্চার কমতি হবে না। প্রতি ছমাসে একটা করে হবে।
গল্প শুনে একটুও হাসলো না রিমি। গম্ভীর গলায় বলল, ওই যুবকটা নিশ্চয় আপনি। আপনার মতো ফাজিলের পক্ষেই এটা সম্ভব।
চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে রিমি, কবি বলল, শুনুন।
এখনও শেষ হয়নি।
না একটু বাকি আছে।
বলে ফেলুন।
আপনি খুব সুন্দর।
ঠিক তখনই স্ট্রেচারে করে মেয়েটিকে নিয়ে আশা হল এই রুমে। একজন ওয়ার্ডবয় স্ট্রেচার ঠেলছে, স্ট্রেচারের পাশে দুজন নার্স।
মেয়েটিকে দেখে রিমির কথা একদমই ভুলে গেল কবি। ব্যস্ত ভঙ্গিতে স্ট্রেচার ধরলো। ওয়ার্ডবয় বেডের সামনে স্ট্রেচার দাঁড় করালো। একজন সিস্টার বলল, বজলু, বেডে শুইয়ে দাও।
শুনে হা হা করে উঠলো কবি। না না আমি করছি।
গভীর মমতায় মেয়েটিকে পাঁজা কোলে নিল কবি, অতি যত্নে, অতিসাবধানে বেডে শুইয়ে দিল। এমন আলতো করে শোয়াল যেন শরীরের কোথাও একটুও না লাগে। শুইয়ে দেওয়ার পর তার মাথায় হাত রাখলো। এই তো তুমি অনেকখানি ভাল হয়ে গেছ। এখন আর কোনও ভয় নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। একদম ভাল হয়ে যাবে তুমি।
মেয়েটি ভেজা চোখে কবির দিকে তাকিয়ে রইল। তার ঠোঁট দুটো একটু একটু কাঁপছে। কবি হাত রাখলো তার গালে। তুমি কেঁদো না, কেঁদো না সোনা। ভাল হয়ে যাবে, একদম ভাল হয়ে যাবে। ভাল হয়ে আমাকে সব বলবে। তোমার নাম বলবে, বাবা মার নাম বলবে, ঠিকানা বলবে, আমি তাদেরকে খবর দেব। তারা এসে তোমাকে নিয়ে যাবে। আর কোন বাড়িতে ছিলে তুমি, কারা তোমাকে এভাবে মেরেছে তাদের নাম ঠিকানা বলবে, ওদেরকে আমি জেলে ঢুকাবো।
মেয়েটি নিঃশব্দে কাঁদে, শুধু কাঁদে।
রিমি তখন অপলক চোখে তাকিয়ে আছে কবির দিকে। কবি ভুলেও তাকায় না তার দিকে। এ যেন আগের সেই মানুষটি না, এ যেন একেবারেই অন্য এক মানুষ।
আট
রুনু এগিয়ে এসে বললেন, একেবারে সপরিবারে! খবর কী রে রবি, আমাদের এই গরিব হাসপাতালে এতবড় হাতির পাড়া!
রবি কথা বলবার আগেই কুহু কেকা একসঙ্গে সালাম দিল রুনুকে। স্লামালেকুম চাচ্চু।
দুই মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন রুনু। ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছ তোমরা?
জ্বি ভাল।
জয়াকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। ওর সঙ্গে পরশুই দেখা হল।
গাড়ি থেমেছিল হাসপাতালের গেটে। নেমেই রুনুকে দেখতে পেয়েছেন রবি। বন্ধুর জন্য দাঁড়িয়ে আছেন।
রুনুর হাত ধরে রবি বললেন, তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
তোরা আসবি, আমি দাঁড়াবো না!
কোনও মানে আছে! ওই এত ব্যস্ত মানুষ!
বন্ধুর জন্য ব্যস্ততা ফেলে দিয়েছি।
তুই একটু বেশি ভদ্র।
হয়েছে, চল।
চেয়ারম্যান সাহেব এসে দাঁড়িয়ে আছেন দেখার পর থেকে কাউন্টারে শিলা লিজা স্বপন একটু যেন আড়ষ্ট হয়ে আছে। ওয়ার্ডবয় নার্স ক্লিনার ডাক্তারদেরও একই অবস্থা। হাসপাতালের নিজস্ব ফার্মেসি কাউন্টারের উল্টোদিকে। বেশ একটা ভিড় লেগে আছে সেখানে। একজন ম্যানেজার আর তিনজন সেলসম্যান সমানে ওষুধ নামাচ্ছে, প্যাকেট করে কাস্টমারদের দিচ্ছে। ম্যানেজার দ্রুত টাকা নিয়ে ক্যাশে রাখছে। এত ব্যস্ততার মধ্যেও আড়চোখে চেয়ারম্যান সাহেবকে দেখছিল তারা। হাসপাতালে ভিআইপি কেউ এলে তিনি এসে গেটের সামনে অপেক্ষা করেন।
কে আসবে আজ!
সপরিবারে রবিকে দেখে অনেকে বুঝতেই পারল না, এরা কারা? রবি হাসপাতালের একজন ডিরেক্টর হওয়ার পরও তেমন আসেন না এখানে। কোনও জরুরি সিদ্ধান্তের ব্যাপার হলে টেলিফোনেই সেরে ফেলেন। আর রুনুর ওপর বিশাল ভরসা। রুনুর সিদ্ধান্তই সিদ্ধান্ত রবির কাছে। বন্ধুকে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, হাসপাতাল চালাবি তুই, ভাল মন্দ বুঝবি তুই। অন্য ডিরেক্টরদের সঙ্গে দরকার হলে কথা বলবি, আমার সঙ্গে কথা বলবার দরকার নেই। তোর ইয়েস আমার ইয়েস, তোর নো আমার নো। তারপরও যে কোনও সিদ্ধান্ত রবিকে রুনু জানাবেনই। অসম্ভব ভদ্র বিনয়ী এবং দায়িত্ববান মানুষ। এতটা তাঁর না করলেও চলে। কারণ হাসপাতালের বড় ইনভেস্টম্যান্ট তাঁরই। বিশাল বড়লোকের ছেলে। ঢাকায় প্রচুর জায়গা সম্পত্তি রেখে গেছেন বাবা। ধানমন্ডিতে চারটা বাড়ি। প্রতিটাই দেড় বিঘা করে। গুলশানে বাড়ি আছে, পুরান ঢাকার ওয়ারিতে আছে। রুনু একমাত্র ছেলে বাবার। দুই বোন আছে, তাদের বিয়ে হয়েছে বড়লোক বাড়িতে। একজন গুলশানে থাকে, আরেকজন বনানীতে।
বাবা বেঁচে থাকতেই জায়গা সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে গেছেন। ধানমন্ডিতে একটা করে বাড়ি পেয়েছে বোনরা। গুলশান ওয়ারিতে ফ্ল্যাট পেয়েছে। সেগুলো ভাড়া দেওয়া। রুনু পেয়েছেন ধানমন্ডির দুই বাড়ি, গুলশানে তিনটা ফ্ল্যাট, ওয়ারিতে দুটো। ধানমন্ডির দুই বাড়ির একটি এই হাসপাতাল। আর একটিতে রুনু থাকেন। রবিদের বাড়ির মতো পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি। সামনে পেছনে অনেক জায়গা। দেড় বিঘার দাম হবে এখন প্রায় আড়াইশো কোটি টাকা। সুতরাং ফ্রেন্ডশিপ হসপিটালে রুনুর ইনভেস্টম্যান্ট বিশাল। ক্যাশ টাকা সে দিতে পারেনি, দেড় বিঘা জমি দিয়েছে। সেই জমিতে ব্যাংক লোন নিয়ে ছতলা বিশাল বিল্ডিং করা হয়েছে। রবিরা চার বন্ধু ক্যাশ দিয়েছিল একশো ষাট কোটি। দেখতে দেখতে এমন জমা জমলো হাসপাতাল, কেবিন খালিই থাকে না। বছরে টার্নওভার তিনশো কোটির মতো।
রুনুর সঙ্গে রবির বন্ধুত্ব কিশোর বয়স থেকে। গভম্যান্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে একসঙ্গে পড়তো, তারপর ঢাকা কলেজে। কলেজ শেষ করে রুনু ভর্তি হলেন ঢাকা মেডিকেলে আর রবি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। তাঁর সাবজেক্ট বিজনেস অ্যাডমিনিসট্রেশন।
রুনু বললেন, যে উদ্দেশ্যে এলি আগে সেই কাজটা সার।
রবি মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ, আগে পাগলটার সঙ্গে দেখা করি, ওর পেসেন্ট দেখি তারপর তোর ওখানে বসবো।
সিওর।
মেয়েটা আছে কেমন?
ভাল। বেঁচে গেছে।
এই আনন্দেই আমি আজ অফিসে গেলাম না জানিস। মেয়েটার যদি কিছু হয়ে যেত তাহলে আমার ভাইটাকে নিয়ে বিপদে পড়তাম। খুবই আপসেট হয়ে যেত। গোপনে কান্নাকাটি করতো…
জয়া বললেন, গোপনে না, প্রকাশ্যেই কাঁদতো। কালরাতে মেয়েটির জ্ঞান ফেরার পর আমাকে ফোন করে কাঁদতে লাগল। অদ্ভুত ছেলে। মানুষের জন্য এত মায়া!
রবি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই মায়া যে ওকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে!
রুনু বললেন, তুই এত ভাবিস না? ওর জীবন ভালই চলবে। তুই আছিস না, আমি আছি না! ও আমারও ভাই।
এইসব জনসেবা করে জীবন কাটিয়ে দেবে?
জয়া বললেন, কাটাক না। তোমার অসুবিধা কী? তুমি বিজনেস করবে, কবি জনসেবা করবে।
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন রবি। আর আমার টাকা ধ্বংস করবে।
এবার জয়া না, কুহু বলল, নো ড্যাড, টাকা তোমার একা না। চাচ্চুরও। আমরা সবাই চাচ্চুর পক্ষে।
তা তো জানিই। আমি একা আর তোরা তিনজন কবির সঙ্গে।
কথার ফাঁকেই লিফটে চড়েছেন ওঁরা, কবির রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তারপর রুমে ঢুকে দেখলেন এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। মেয়েটির বেডের পাশে চেয়ার টেনে বসেছে কবি। বসে মেয়েটির মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর কথা বলছে। মেয়েটি অপলক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখের কোণ ভেজা।
ওঁরা এগিয়ে এলেন বেডের কাছে। কুহু কেকা মেয়েটিকে দেখে আতংকিত হল। দুজন প্রায় একসঙ্গে বলল, ওহ্ মাই গড।
রুনু বললেন, এখন ভালই দেখছ। যখন নিয়ে এসেছিল, ভেবেছিলাম বাঁচানোই যাবে না।
রবি কয়েক পলক মেয়েটিকে দেখলেন তারপর কবির দিকে তাকালেন। ওদেরকে দেখে উঠে দাঁড়িয়েছে কবি। রবির দিকে তাকিয়ে বলল, কী রে রবি, তুই হঠাৎ এখানে?
রবি চোখ পাকিয়ে বলল, বড়ভাইকে তুই তোকারি করলে থাপ্পড় মারবো।
আমি পরশু থেকে শুধু মারই খাচ্ছি। রুনুভাই মারেন, ভাবী মারে, এখন একমাত্র ভাইও মারছে। আমার অবস্থা দেখছি এই মেয়েটির মতো।
অনেক হয়েছে, এখন চল।
কোথায়?
ওয়েস্টইনে। আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ করবো। রুনুও যাবে।
রুনু বললেন, না রে, আমি যেতে পারবো না।
জয়া বললেন, কেন?
কুহু কেকা বলল, চলো না চাচ্চু।
যেতে পারলে ভাল লাগতো কিন্তু আমার একটা মিটিং আছে। ব্যাংকের ডিরেক্টররা থাকবেন। জরুরি মিটিং। নাহলে যেতাম। একসঙ্গে বহুদিন খাওয়া-দাওয়া হয় না।
কবি বলল, আমারও একই অবস্থা। আমিও যেতে পারছি না।
জয়া বললেন, তোর আবার কিসের মিটিং?
এই যে মেয়েটির সঙ্গে মিটিং করছি। কিন্তু বুঝলি জয়া… …
তুই তোকারি করলে জুতা মারবো।
তা মার কিন্তু কথা হচ্ছে মেয়েটি শুধু কাঁদে, কথা বলে না। কাল রাত থেকেই চেষ্টা করছি। কথাই বলে না। কথা না বললে ওর সমস্যাটা বুঝবো কী করে বলো? নাম পরিচয় জানতে হবে না! কারা এই অবস্থা করলো, জানতে হবে না!
রবি বললেন, ধকল কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। নিশ্চয় কথা বলবে।
কেকা বলল, বোবা না তো?
কবি বলল, না।
কুহু বলল, হাউ ডু ইউ নো?
আমি কথা বললে মন দিয়ে শোনে। বোবারা কালা হয়। শুনতে পায় না।
জয়া বললেন, জামা প্যান্ট লেগেছে?
এখনও বের করা হয়নি মা। যতদিন হাসপাতালে থাকবে এখানকার ড্রেস পরতে হবে।
রুনু বললেন, এটাই নিয়ম।
রবি বললেন, আজকের রিপোর্টটা খুব ভাল হয়েছে।
রুনু বললেন, ডেইলি সানেরটা?
ডেইলি সানেও উঠেছে নাকি?
হ্যাঁ, বসুন্ধরা গ্র“পের তিনটি কাগজেই উঠেছে। কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ডেইলি সান। ওদের নিউজ পোর্টালেও আছে। বাংলা নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম। আমার সেক্রেটারি বলল। আমি দেখেছি বাংলাদেশ প্রতিদিন আর ডেইলি সানে।
আমি দেখেছি কালের কণ্ঠে।
কবি বলল, তার মানে মেয়েটির সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের হাসপাতালও বিখ্যাত হয়ে গেল!
রবি বললেন, আমাদের হাসপাতাল এমনিতেই বিখ্যাত। তবে রিপোর্টটা খুবই ভাল হয়েছে।
একই রিপোর্ট সব জায়গায় বেরিয়েছে ভাইয়া। নয়ন বলার পর আমি সবগুলো পত্রিকা আনিয়েছি। এখন দেখবে ঘটনাটা নিয়ে সাড়া পড়বে। কালের কণ্ঠ, ডেইলি সান তো আছেই, বাংলাদেশ প্রতিদিন দেশের সবচাইতে জনপ্রিয় কাগজ। ছসাত লক্ষ চলে। ওই এককাগজে নিউজ হলেই খবর হয়ে যায়।
কবি রুনুুর দিকে তাকাল। রুনুভাই, বিজ্ঞাপনের বিলটা দিয়ে দিও।
রুনু হাসলেন। আমাদের বিজ্ঞাপন লাগে না। ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল এমনিতেই ভাল চলে।
মেয়েটি অসহায় করুণ চোখে ওদেরকে দেখছিল। এইসব মানুষের মধ্যে তাকে লাগছিল অন্য গ্রহের মানুষের মতো। ন্যাড়া মাথা, শরীরে বেদম মারের চিহ্ন, আহা রে! আহা!
রবি আনমনা ভঙ্গিতে মেয়েটির দিকে তাকালেন, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর কবিকে ডাকলেন, আমার কাছে আয়।
কবি চমকালো। কেন ভাইয়া? মারবে নাকি?
আয় না।
কবি ভাইয়ের সামনে এসে দাঁড়াল। বলো।
গভীর মমতায় ভাইকে বুকের কাছে টেনে আনলেন রবি। তোর জীবন তুই তোর মতো চালাবি। যতটা সম্ভব মানুষের জন্য করবি। বাবা অনেকটাই ছিলেন তোর মতো। বড় বিজনেসম্যান ছিলেন ঠিকই কিন্তু মানুষের জন্য করতেন অনেক। গরিব অসহায় মানুষ সাহায্যের জন্য এসে শূন্য হাতে বাবার কাছ থেকে ফিরে গেছে, এমন কখনও হয়নি। পুরনো গরিব বন্ধুদের মাসে মাসে টাকা পাঠাতেন। তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াতেন। গরিব আÍীয়স্বজনের মেয়েদের বিয়ের পুরো দায়িত্ব নিতেন। মা ছিলেন অনেকটাই জয়ার মতো। তিনিও তাঁর মতো করে মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। আমরা মানুষ হিসেবে খারাপ হয়ে গেছি, অন্ধ স্বার্থপর হয়ে গেছি। নিজেকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝি না। শুধু নিজেকে বুঝলে মানুষ হওয়া যায় না। আমরা অনেকেই মানুষ হইনি, তুই হয়েছিস। আমি তোর জন্য গৌরববোধ করি।
ভাইয়ের কাছ থেকে সরে গিয়ে হাসলো কবি। লেকচার খুবই ভাল হয়েছে ভাইয়া।
রবিও হাসলেন। আমি লেকচার ভালই দেই।
হয়েছে, এখন লাঞ্চে যাও। এখানে গ্যাঞ্জাম করো না।
জয়া বললেন, তোর ভাইয়ের আজ এত আবেগ কেন হয়েছে জানিস? কাগজে তোর এত প্রশংসা লিখেছে, তাদের হাসপাতালের প্রশংসা লিখেছে এতেই সে মুগ্ধ।
রুনু বললেন, না জয়া। রবিকে আমি চিনি! আমরা এতদিনকার বন্ধু। কবিকে যে সে কী ভালবাসে আমি জানি। কবি ওর জান। এমনিতে যত কথাই বলুক, কবি যদি চায়, আমি নিশ্চিত রবি এক কথায় বাড়িঘর জায়গা সম্পত্তি টাকা পয়সা সব ভাইকে দিয়ে দেবে।
জয়া বললেন, সেটা কবিও দেবে।
হ্যাঁ দুভাইয়ের মানসিকতা একই রকম।
কবি আবার গিয়ে দাঁড়িয়েছে মেয়েটির সামনে। তার মাথায় হাত বুলাচ্ছে। কুহু কেকা দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে। জয়া এসে দাঁড়ালেন। কবি বলল, কাগজে ছাপা হওয়া ছবি ওকে দেখালাম। নিজের ছবি একপলক দেখে চোখ সরিয়ে নিল, নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। এমন করুণ কান্না, দেখলে বুক ফেটে যায় ভাবী।
জয়া মেয়েটির দিকে ঝুঁকে গেলেন। তুমি এত কেঁদো না। এই তো আর কয়েক দিনের মধ্যেই ভাল হয়ে যাবে। ভাল হয়ে আমাদেরকে সব বলবে। পুলিশ ওই শয়তানগুলোকে ধরবে, জেলে দেবে। তোমাকেও তোমার মা বাবার কাছে পাঠিয়ে দেব। কোনও অসুবিধা হবে না।
রবিও এগিয়ে এসে মেয়েটির মাথায় হাত দিলেন। আমরা সবাই তোমার পাশে আছি। তোমার দায়িত্ব আমাদের। ভাল হও, তাড়াতাড়ি ভাল হও।
কবির দিকে তাকালেন রবি। তাহলে তুই যাবি না?
না ভাইয়া। আমি এখানেই থাকি।
আচ্ছা ঠিক আছে থাক। চলো জয়া, আমরা বেরোই।
চলো।
ওরা মাত্র দরজার দিকে পা বাড়িয়েছে, রবিকে ডাকল কবি। ভাইয়া।
রবি ঘুরে দাঁড়ালেন। বল।
তোমার বাজেট কত?
কিসের?
লাঞ্চের?
লাঞ্চের আবার বাজেট কী! যে যা খাবে। খাওয়ার সময় বাজেট হিসাব করবো নাকি?
তারপরও, পার হেড কত করে পড়বে?
পাঁচ সাত হাজার।
আমারটা তাহলে ক্যাশ দিয়ে দাও।
সবাই হেসে ফেলল।
রবি বললেন, ক্যাশ একটা থাপ্পড় খাবি?
রুনু বললেন, শোন কবি, মেয়েটির জন্য আমরা ডক্টর রিমিকে ফিক্সড করে দিয়েছি। সি ইজ এ ভেরি গুড ডক্টর। সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত হসপিটালে থাকবে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় এসে দেখে যাবে। বাড়ি চলে গেলেও সিস্টাররাও তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। কোনও সাজেশন থাকলে ফোনে সে দিয়ে দেবে। তুই নিজেও দরকার হলে কথা বলবি।
কবি বলল, ঠিক আছে।
মনে মনে বলল, একটু বেশিই ঠিক আছে রুনু ভাই। তুমি আমার মন বুঝে গেছ। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।