নতুন বছরে আমরা সুখবর পেতে চাই।
পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় উজ্জ্বল আখরে দেখতে চাই, সব নেতা–নেত্রীর হাসিমুখ, তাঁরা পরস্পর মোলাকাত করে বলছেন, আজ থেকে এই দেশে আর কোনো হরতাল ডাকা হবে না।
বিরোধী দল যদি বলে কাজটা ভালো হয়নি, তাতেই সরকারি দল বিচলিত বোধ করবে, তাড়াতাড়ি দৌড়ে যাবেন সরকারি নেতারা, বিরোধী নেতাদের কাছে, কেন এ রকম ভাবছেন যে কাজটা ভালো হয়নি।
আর দেশে যখন সংকট দেখা দেবে, বিরোধী দলের নেতারা উদ্বিগ্ন মুখে যাবেন সরকারি দলের নেতার বৈঠকখানায়, ‘বলুন, আপনার কী সহযোগিতা লাগবে।’ সরকারি নেতারা তাঁদের পরামর্শ নেবেন, সহযোগিতা নেবেন। সবার সহযোগিতায় দেশ এগিয়ে যেতে থাকবে, তরতরিয়ে।
নতুন বছরে আমরা সুখবর পেতে চাই।
দুঃসংবাদ শুনতে শুনতে আমাদের সংবাদ-আতঙ্ক হয়ে গেছে। নিউজ-ফোবিয়া।
আমাদের মনে সদাভয়, আকাশে উড়বে বিমান, তা আর কোনো দিন নিরাপদে নামবে না রানওয়েতে।
আমাদের ভয় হচ্ছে, ঘরের বাইরে যাবে সন্তান, সে আর ফিরে আসবে না মায়ের কোলে।
বাবা বের হন সকালে, কাজে, তিনি হয়তো পেট্রলদগ্ধ পড়ে রইবেন কোনো বার্ন ইউনিটে।
পথে বেরোলে ভয় লাগে, কালো পোশাকের লোকেরা কাউকে ধরতে গিয়েছে, সেই দৃশ্য দেখে ফেলার অপরাধে পেটে বাঁধা হবে পাথরের বস্তা, ডুবে রইব বুড়িগঙ্গায় কিংবা শীতলক্ষ্যায়।
না, এ ধরনের খবর আর শুনতে চাই না।
বরং শুনতে চাই, মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের নিখোঁজ বিমানটি নিরাপদে নেমেছে এক দূরতম দ্বীপে। সেখানে যাত্রীরা পিকনিক করছে। আজই তারা সবাই ভিডিও-বার্তাায় পৃথিবীবাসীকে জানাচ্ছে, শিগগির ফিরছি। শুভ ২০১৫।
শুনতে চাই, হারিয়ে যাওয়া শিশুটি ফিরে এসেছে মায়ের কোলে।
কোনো পাইপ কোনো ম্যানহোল ঢাকনাছাড়া নেই।
কোনো শিশু কোনো গর্তে পড়বে না।
আমাদের নতুন খবর দিন। জানান যে মন্ত্রী স্বীকার করেছেন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, তাই তিনি পরামর্শ করছেন শিক্ষাবিদদের সঙ্গে, ব্যবস্থা নিচ্ছেন, এরপর দেশে আর কোনো দিনও প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে না।
আমাদের সুখবর জানান। জানান যে, রাষ্ট্র মানবাধিকার হরণ করবে না, কেউ গুম হবে না, কেউ ক্রসফায়ারে পড়বে না, এখানে একজন সলিমুদ্দির অধিকার আর একজন মন্ত্রীর অধিকার সমান। একজন এমপি ট্রেনের কাউন্টারে লাইনে দাঁড়াবেন একজন বেকার যুবকের পেছনে, যুবকটির টিকিট কাটা হয়ে যাওয়ার পরেই কেবল বিবেচনা করা হবে এমপি সাহেব টিকিট পাবেন কি পাবেন না।
আমরা শুনতে চাই, এই দেশে কোনো রাজাকার নেই, সবাই দেশপ্রেমিক।
আমাদের শোনান যে, ফলে মাছে দুধে সবজিতে ফরমালিন নেই, কীটনাশক কিংবা রাসায়নিক নেই আমে জামে কলায় লিচুতে।
আমাদের এই খবর দিন যে আমাদের গণতন্ত্রের মধ্যেও কোনো ফরমালিন নেই, কীটনাশক নেই, রাসায়নিক নেই, ভোট মানে উৎসব, মানুষের আছে বেছে নেওয়ার ক্ষমতা।
পোলিওমুক্তির খবরের পাশে আমরা শুনতে চাই আমাদের নদীগুলো দূষণ ও দখলমুক্ত, ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণমুক্ত, মন্ত্রিসভায় একজনও নেই, যিনি ঘুষ খান। সরকারের সর্বোচ্চ মহল দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে রত, তাই ক্রমান্বয়ে স্তরে স্তরে দেশ হয়ে যাচ্ছে দুর্নীতিবিহীন।
শুনতে চাই, প্রশাসন দলীয় রাজনীতিমুক্ত, রাজনীতি মাস্তানমুক্ত। মেধা আর যোগ্যতাই সর্বত্র কাজ পাওয়ার, ব্যবসা পাওয়ার, পদ পাওয়ার, পদোন্নতি পাওয়ার একমাত্র মাপকাঠি।
আমরা শুনতে চাই, সব জাহাজ, লঞ্চ, নৌযান বৈজ্ঞানিকভাবে নকশা করা; পরিদর্শকেরা নিয়মিত চেক করেন, মালিকেরা নিয়ম মানেন, চালকেরা দক্ষ, এ বছর থেকে বাংলাদেশে কোনো লঞ্চ ডুববে না নৌপথে।
আমরা শুনতে চাই, আমাদের দেশে কোনো যানজট নেই—না ঢাকায়, না জেলা শহরে, না রাজপথে, না মহাসড়কে।
আমরা দেখতে চাই, আমাদের প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আছে মাঠ, আছে লাইব্রেরি, আছে কম্পিউটার ল্যাব, স্বাস্থ্যবান শিশুদের পিঠে বইয়ের বোঝা নেই, তারা খেলছে-পড়ছে, কম্পিউটার চর্চা করছে, গান গাইছে, নাচছে—সবই করছে আনন্দের সঙ্গে।
নারী-পুরুষের মর্যাদায় স্বীকৃতিতে মূল্যায়নে কোনো পার্থক্য নেই। কোনো মানুষই নির্যাতিত হন না, নারী কিংবা শিশুদের তো মর্যাদা ও নিরাপত্তা দেওয়া হয় চোখের মণির মতো।
আমাদের বলুন, আমরা এমন সিস্টেম তৈরি করতে পেরেছি, সারা দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে খেলাধুলা করা হচ্ছে, প্রশিক্ষণ হচ্ছে, আমরা পরিকল্পিতভাবেও খেলোয়াড় তৈরি করছি, বাংলাদেশ তাই চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছে—ক্রিকেটে কিংবা হকিতে।
আমাদের বলুন যে আইনের শাসন দিয়ে চলছে দেশ, কোনো হানাহানি নেই, মারামারি নেই, কেউ কাউকে ফুলের টোকাও মারে না।
আমাদের অন্তত এ কথা বলুন যে গতকালের চেয়ে ভালো যাবে আজ, আজকের চেয়ে ভালো যাবে আগামীকাল।
বলুন যে ক্যানসারের প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়েছে, ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা যাচ্ছে সহজেই, জিনপ্রযুক্তির মাধ্যমে। চিকিৎসার জন্য কাউকে বিদেশে যেতে হয় না, গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো চলছে ঠিকমতো, থানা সদরেই চিকিৎসা পাওয়া যায় মানসম্পন্ন। জেলা হাসপাতাল থেকে রোগী ফিরে যায় হাসতে হাসতে।
বলুন যে এ দেশে কেউ গাছ কাটে না, মাঠ দখল করে না, বন রক্ষা করে নিজের সন্তানের মতো, আকাশ ঝকঝকে, বাতাস নির্মল, পানি দূষণমুক্ত।
প্রত্যেক মানুষের পেটে ভাত, পরনে কাপড়, পায়ে জুতা, সবার মুখে হাসি। ঘরে ঘরে শান্তি আর স্বস্তি। বাঙালি কি অবাঙালি, পাহাড়ি কি সমতলী, আদিবাসী কিংবা সংখ্যাগুরু, মুসলিম কি হিন্দু, বৌদ্ধ কি খ্রিষ্টান—সবাই সমান মর্যাদা, সমান নিরাপত্তা, সমান স্বস্তি ও স্বাধীনতা নিয়ে দিন যাপন করছে।
২০১৪-এর চেয়ে ভালো যাবে ২০১৫।
বলুন যে ২০১৫-এর চেয়েও ভালো যাবে ২০১৬।
সৈয়দ শামসুল হকের নুরলদীনের সারা জীবন কাব্যনাট্যে নুরলদীনের সংলাপের মতো করে বলি:
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ,
নবান্নের পিঠার সুঘ্রাণে দ্যাশ ভরি উঠিতেছে।
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ,
হামার গাভীন গাই অবিরাম দুধ ঢালিতেছে।
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ,
মানুষ নির্ভয় হাতে আঙিনায় ঘর তুলিতেছে।
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ,
নিশীথে কোমল স্বপ্ন মানুষের চোখে নামিতেছে।…
সুখে দুঃখে অন্নপানে সকলেই একসাথে আছে
সোনার বাংলার সোনা বাংলাদেশে আছে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।