ঘোড়া প্রতিনিধিত্ব করে উদ্দামতার। গরু করে পরিশ্রমের। হিংস্র বাঘ সাহসিকতার। আর নিরীহ প্রাণী খরগোশ করে সতর্কতার। চীনা প্রবাদ। দ্বিপদ ও চতুষ্পদ প্রাণীদের সুবিধা হলো, ওরা কথা বলতে পারে না, কথা বলতে পারে একমাত্র মানুষ। কথা বলার এবং প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষমতা ঈশ্বরই দিয়েছেন দ্বিপদ জন্তু মানুষকে।
সমাজের অবহেলিত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর প্রতিনিধিত্ব করে আসছে এক শ্রেণির মানুষ অনাদিকাল থেকে। পৃথিবীর সব দেশেই যাঁরা প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান, তাঁরা সবাই যে সফল সেটি বলা সমীচীন না হলেও ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যায় তার অজস্র প্রমাণ। কলাকৌশলে প্রতিনিধিত্বকারী অথবা কারিণী, তিনি যেই হোন না কেন, স্বপদ, অধিকৃত চেয়ার, এমনকি প্রতিনিধিত্বকারী ভদ্রলোকটি যদি সেনাবাহিনীর জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত হন, তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লক্ষণীয় হয়ে ওঠে, স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর প্রাধান্যটাই বেশি হয়ে দাঁড়ায় ক্ষেত্রবিশেষে। মহারাজ বিক্রমাদিত্য একবার নগর ভ্রমণে বের হয়েছিলেন, সঙ্গে নিয়েছিলেন লব্ধ প্রতিষ্ঠিত কবি ‘বররুচি’ ও উদীয়মান নব্য কবি ‘কালিদাস’কে।
কবি বররুচি রাশভারী লোক ছিলেন। তিনি পারতপক্ষে যেখানে-সেখানে যেতে পছন্দ করতেন না, এমনকি ঘুরে বেড়াতেও। একদিন কবির কণ্ঠে দণ্ডকারণ্যের গুরুগম্ভীর বর্ণনা শুনে স্বয়ং মহারাজ তাকে ভয় করে চলতেন। যেহেতু মহারাজ- তাই তিনি একদিন প্রবীণ কবি ও নবীন কবিকে সঙ্গে নিয়ে নগর ভ্রমণে বেরিয়ে হঠাৎ করেই দেখতে পেলেন রাস্তার মাঝখানে পড়ে আছে একখণ্ড শুকনো কাঠ। সেই কাঠ দেখে মহারাজ বিক্রমাদিত্যের মনে কাব্যপিপাসা জেগে উঠল। তখন তিনি কবি বররুচিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিমেতৎ’ অর্থাৎ বররুচি, ওটা কী পড়ে আছে, তোমাকে পদ্যাকারে বলতে হবে। ঠিক তক্ষুনি বররুচি অনুষ্টুপের একটি চরণ রচনা করে বললেন, ‘শুষ্কং কাষ্টং তিষ্টত্যাগ্নে’। তক্ষুনি মহারাজ বিক্রমাদিত্য একটু হেসে তরুণ কবি কালিদাসের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁকে বললেন, কালিদাস, তুমি বলো। তরুণ কবি অতি সহজ বাংলায় কবিতা রচনা করেই বললেন, মহারাজ ‘নীরস তরুবর পুরতোভাতি’।
সঙ্গে সঙ্গে রাজা বিক্রমাদিত্য তাঁর গলা থেকে মুক্তার একটি মালা খুলে কালিদাসের গলায় পরিয়ে দিয়েই আবার হাসলেন। আমার ধারণা, সেকালের রাজা-মহারাজারা বোধকরি এক ডজন মুক্তার মালা ২৪ ঘণ্টাই নিজের গলায় ঝুলিয়ে রাখতেন। কখন, কোথায়, কী কাজে প্রয়োজন হয় বলা তো যায় না। মহারাজ বিক্রমাদিত্য কবি কালিদাসের প্রতি প্রচণ্ড রকমের অন্ধ স্নেহের বশবর্তী হয়ে বৃদ্ধ কবি বররুচির প্রতি অবিচারই করেছিলেন। একখানা মরা কাঠ, উপরন্তু দেখতেও ভালো নয়, তার পরও প্রধান কবি, মহারাজকে তিন-তিনটি অনুপ্রাস দিয়ে খুশি করতে চেয়েই হয়তো তাকে বলতে হয়েছিল, শুষ্কং কাষ্টং তিষ্টতাগ্নে। বররুচি যদি সংস্কৃত না বলে শুদ্ধ বাংলা ভাষায় বলতেন, তাহলে মহারাজের গলার মুক্তার মালা তাঁর গলায়ই শোভা পেত। যেহেতু বিক্রমাদিত্য মহারাজা ছিলেন, তিনি সেদিনই বররুচির কপালের লিখন পড়েই বুঝতে পেরেছিলেন, বররুচির কাল শেষ। কালিদাসের কাল শুরু। কাল যেহেতু নিরবধি, তাকে অনাগতের দিকেই যেতে হয়। এরই মধ্যে জাতকের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল, একাধারে ৯ বছর দোর্দণ্ড প্রতাপে চালিয়েছিলেন বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটি। এবং একই সঙ্গে সেই জেলখানা নামক গৃহটিতে অবস্থান করতে হয়েছিল পাঁচ থেকে ছয় বছরকাল। জাতকের কথা অমৃত সমান।
মহারাজ বিক্রমাদিত্য আজও রয়ে গেছেন ভূ-ভারতে, তিনি নিজে কবি না হয়েও কবি কালিদাসকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন হেতুই কালিদাস আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন ‘মেঘদূত’। তবে বাংলাদেশের চাটুকার, দূতেরা সেই মহাপরাক্রমশালীর ‘উদ্দামতার প্রতীক’, তিনিই একদিন তাঁর সমুদয় ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে মাটিচাপা দিলেন চাটুকারদের পদতলে। মহামতি লেনিনকে একবার তাঁর চাটুকাররা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলে মহামতি বলেছিলেন, ‘আমি নিজের রক্তে সিক্ত হতে রাজি নই।’ অন্যদিকে দার্শনিক হেগেলের দর্শনতত্ত্বের উক্তি হচ্ছে, ‘বুদ্ধিমানরা ইতিহাসের সঙ্গে যায়/আর নির্বোধেরা ইতিহাস থেকে নিজেদের দূরে রাখে, অর্থাৎ টেনে নিয়ে যায় অন্ধকারে।’ উইলিয়াম শেকসপিয়ার কবি-নাট্যকার। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, ‘বিষধর সাপের চেয়ে অকৃতজ্ঞ সন্তানের দংশন অধিক বেদনাময়।’
আমাদের সাবেক রাষ্ট্রপতি কবি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কেন যে দিকভ্রান্ত হয়েছিলেন তাঁর পারিষদবর্গের চাটুকারিতায়- যেহেতু তিনি দিকভ্রান্ত হওয়ার আগেই স্থির করেছিলেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান- এই ঘোষণাটি তিনি দেবেন। কিন্তু তিনি পারলেন না, কেন পারলেন না, তার সেই মর্মবেদনার কথা অকপটে স্বীকার করলেন মাত্র ২২-২৩ বছর পর। কেন তাঁর এই অনুতাপ, কেন তাঁর ভ্রান্তি, পিতাকে পিতা বলে সম্মোধন করতে? বিগত আগস্ট মাসের ১৮ তারিখ সোমবার তাঁর বোধোদয় হয়েছিল, তিনি তাঁর অতীতের সাতকাহন বাংলাদেশ প্রতিদিনের লাখ লাখ পাঠককে জানাবেন, তাঁর চাটুকারদের নিকট পরাজয়ের সাতকাহন। এ দেশের অগণিত পাঠক নিশ্চয়ই বিস্মৃত হয়েছেন, সেই সোমবার ১৮ আগস্টে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের লিখিত অমৃত বাণীগুলো। আজ তাঁরই বক্তব্য পুনরায় লিখছি, সহৃদয় পাঠক ক্ষমা করবেন। রাষ্ট্রক্ষমতার স্বর্ণশিখরে বসে তিনি কেন যে শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা বলে স্বীকৃতি দিতে পারলেন না, সেটি জানার পর সাবেক জেনারেলকে ভীতু বৈ অন্য কিছু ভাবার আর কোনো অবকাশ থাকল না।
‘জাতীয় শোক দিবসে নিন্দনীয় জন্মোৎসব এবং আমার কিছু অনুতাপ’ প্রথম বাক্যটিতে প্রমাণিত হয়েছে তাঁর পরাজয়ের গ্লানি। ‘আমি এমন একটি সুযোগ হাতছাড়া করেছি, যা আর কেউ কোনো দিন ফিরে পাবে না। তার জন্য আফসোস আমাকে আজও দংশন করে।… আমি একটি সিদ্ধান্ত নিলাম; কিন্তু বাস্তবায়ন করতে পারলাম না। ফেঁসে গেলাম সবার মতামত গ্রহণ করতে গিয়ে। অথচ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সেটি যদি অন্যের মতের তোয়াক্কা না করে কার্যকর করে দিতাম, তাহলে ওই ক্ষেত্রে আমার নামটি এক মহান মানুষের পাশে ছোট করে হলেও ইতিহাসে থেকে যেত।’
একদা জেনারেল এরশাদের মনে পড়েছিল নানা কথা, তিনি তাঁর পূর্বসূরি আরেক জেনারেলের কথাও বলেছেন, আরো বলেছেন- ওই যে লাল-সবুজ পতাকাটা উড়ছে, ওটাই বা কার দান? কার অবদান, যাঁর অবদান তাঁকে আমরা সবাই চিনি ও জানি। তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, কিন্তু তাঁর স্বীকৃতি কোথায়? তিনি একটি জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিলেন, একটি দেশের জন্ম দিলেন, সেই জন্মদাতাকে পিতা বলতে আমাদের কণ্ঠ স্তব্ধ কেন?… তাই সেই ভাবনা থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমি সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের জাতির পিতা বলে ঘোষণা দেব, কিন্তু আমি তা পারলাম না।’
কেন পারলেন না, সেটিও তিনি জানিয়েছেন। তিনি একজন জেনারেল, তারপর দেশের রাষ্ট্রপতি। তাঁর পরাজয় হলো তাঁরই চাটুকারদের বাক্যবাণে। যেটি অকল্পনীয়। যেমন মহারাজ বিক্রমাদিত্যের ব্যবহারে দুঃখ পেয়েছিলেন কবি বররুচি, খুশি হয়েছিলেন কবি কালিদাস। কবি, রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আরো জানিয়েছেন তাঁর ওই কলামে কিছু মজার তথ্য। ‘বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন ১৫ আগস্ট ছিল না।… বেগম জিয়ার এমন কী প্রয়োজন ছিল যে শেষ বয়সে এসে শুধু বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত দিবসটিকে বিদ্রূপ করার জন্য তাঁকে একটি সাজানো জন্মদিন পালন করতে হবে? কোনো নথিপত্র, প্রমাণাদি বলছে না যে ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন। তিনি প্রথম যেবার ক্ষমতায় এলেন তখনো তাঁর জন্মদিন ১৫ আগস্ট ছিল না।’
আমার বিশ্বাস, যদি এরশাদ সাহেব তাঁর চাটুকারদের কথায় নিজেকে সঁপে না দিতেন, তাহলে তিনি সেই চীনা প্রবাদের হিংস্র বাঘ হয়েই পরিচয় দিতেন সাহসিকতার। কিংবা প্রতিনিধিত্ব করতেন উদ্দামতার। যেহেতু তিনি নিরীহ প্রাণী, শুধু পরিশ্রম করেছিলেন সতর্কতায়। আরেকটি উদাহরণ। ‘সাপ কখনোই বিস্মৃতিপ্রবণ প্রাণী নয়, অত্যন্ত হিংসাপরায়ণ; যদি কেউ তাকে আঘাত করে, সেই আঘাতে যদি তার মৃত্যু না হয়, তাহলে সেই সাপ সুযোগ ও সুবিধা পেলে প্রতিশোধ নিতে একটুও দ্বিধাবোধ করবে না।’ যেমন করেছিল ১৯৯১-৯৬ সালের সরকার। পাঁচ থেকে ছয় বছর কারারুদ্ধ ছিলেন খালেদা জিয়ার অপার স্নেহে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, একদিন যে স্নেহ পেয়েছিলেন কবি কালিদাস মহারাজ বিক্রমাদিত্যের- অনেকটা সেই রকম।
– See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2015/01/01/169965#sthash.du9u9Ida.dpuf